Wednesday, October 4, 2023
spot_img
Homeলাইফস্টাইলবোনম্যারো ট্রান্সপ্লান্টেশন

বোনম্যারো ট্রান্সপ্লান্টেশন

থ্যালাসেমিয়ার একমাত্র নিরাময়যোগ্য চিকিৎসা

৮ মে বিশ্ব থ্যালাসেমিয়া (রক্তরোগ) দিবস

থ্যালাসেমিয়ায় স্বাভাবিক হিমোগ্লোবিন তৈরির হার কমা নির্ভর করে এক বা দুটি জিনই ত্রুটিপূর্ণ কি না তার ওপর। থ্যালাসেমিয়া বাহকের বেলায় একটি এবং থ্যালাসেমিয়া মেজরের বেলায় দুটি জিনই ত্রুটিপূর্ণ থাকে।

থ্যালাসেমিয়ার প্রাদুর্ভাব ভূমধ্যসাগরীয়, মধ্যপ্রাচ্য ও এশিয়ার দেশগুলোতে বেশি। বাংলাদেশে প্রায় ৭ থেকে ১০ শতাংশ হিমোগ্লোবিন-বিটা ও হিমোগ্লোবিন-ইর বাহক রয়েছে এবং প্রতিবছর প্রায় সাত হাজার শিশু হিমোগ্লোবিন-ই/বিটা ও থ্যালাসেমিয়া মেজর নিয়ে জন্ম গ্রহণ করছে।

বেশির ভাগ থ্যালাসেমিয়া রোগীর নিয়মিত রক্ত দিতে হয়। কেননা ব্লাড ট্রান্সফিউশন ছাড়া তাদের হাড়ের বিকৃতি দেখা দেয়, পাশাপাশি লিভার ও প্লিহা বড় হয়ে যায়। রক্ত না নিলে জীবন বাঁচে না আবার নিয়মিত রক্ত নিলে শরীরের নানা অংশে (বিশেষ করে লিভার, হার্ট, অ্যানড্রোক্রাইন গ্রন্থি) বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়।

নিয়মিত সারা জীবন মেডিক্যালথেরাপি বা ব্লাড ট্রান্সফিউশন ও আয়রন চিলেশন (অতিরিক্ত আয়রন বের করার চিকিৎসা) নেওয়া সব রোগীর পক্ষে সম্ভব হয় না। এতে খরচ অনেক বেশি হয়। প্রতিবছর ন্যূনতম ৫০ হাজার থেকে এক লাখ টাকা প্রয়োজন হয়। থ্যালাসেমিয়া রোগী, যারা নিয়মিত ব্লাড ট্রান্সফিউশনের ওপর নির্ভরশীল, তাদের জন্য অ্যালোজেনিক বোনম্যারো ট্রান্সপ্লান্টেশন একমাত্র নিরাময়যোগ্য চিকিৎসা। তবে অটোলগাস বোনম্যারো ট্রান্সপ্লান্টেশন ব্যবহার করে জিনথেরাপির ব্যবহার এখনো সীমিত এবং পরীক্ষাধীন।

বোনম্যারো ট্রান্সপ্লান্টেশনের সুবিধা

♦ বোনম্যারো ট্রান্সপ্লান্টেশন থ্যালাসেমিয়া রোগীদের নিরাময়যোগ্য একটি চিকিৎসা পদ্ধতি।

♦ ট্রান্সপ্লান্টেশনের জন্য যথাযথভাবে নির্বাচিত করা রোগীদের বেলায় ৮৭ থেকে ৯০ শতাংশ পর্যন্ত সম্পূর্ণ নিরাময় সম্ভব।

♦ সারা জীবনের ব্লাড ট্রান্সফিউশন ও চিলেশন চিকিৎসা ব্যয় থেকে পরিত্রাণ পাওয়া যায় এবং সেই সঙ্গে জীবন হয় থ্যালাসেমিয়ামুক্ত।

♦ খরচ বাবদ এককালীন আট থেকে ১০ লাখ টাকার প্রয়োজন হলেও তা সারা জীবনের ব্লাড ট্রান্সফিউশন ও চিলেশন চিকিৎসা ব্যয় থেকে অনেক কম হবে।

চ্যালেঞ্জগুলো

বোনম্যারো ট্রান্সপ্লান্টের ক্ষেত্রে উন্নত প্রযুক্তিনির্ভর ও ব্যয়বহুল এককালীন চিকিৎসা পদ্ধতি, সঠিকভাবে উপযুক্ত থ্যালাসেমিয়া রোগী নির্বাচন, উপযুক্ত বোনম্যারো ডোনার পাওয়া ও ট্রান্সপ্লান্ট-পরবর্তী জটিলতা, যেমন—GVHD, Graft Failure, মৃত্যুঝুঁকি ইত্যাদি হলো কিছু চ্যালেঞ্জ।

যারা উপযুক্ত

ভালো ফল পেতে ও ট্রান্সপ্লান্ট জটিলতা কমাতে সঠিকভাবে যথাযথভাবে থ্যালাসেমিয়া আক্রান্ত রোগী নির্বাচন করা অপরিহার্য। বিশেষ করে (ক) যারা নিয়মিতভাবে ও কঠোরভাবে ব্লাড ট্রান্সফিউশন ও চিলেশন নিয়ে থাকে। (খ) ১৪ বছরের কম শিশু (অথবা ১৭ বছরের কম) যাদের শুরু থেকেই আয়রন নিয়ন্ত্রণে এবং লিভার স্বাভাবিক রয়েছে। (গ) HLA ম্যাচ ডোনার যাদের রয়েছে।

উল্লিখিত বিষয়গুলো ভালোভাবে মেনে বোনম্যারো ট্রান্সপ্লান্ট করলে ৯০ শতাংশ ক্ষেত্রে আরোগ্য লাভের সম্ভাবনা রয়েছে এবং এতে মৃত্যুঝুঁকি ৪ শতাংশেরও কম।

আয়রন চিলেশনের গুরুত্ব

ঝুঁকি পর্যালোচনা করে বোঝা যায়, সঠিক ও নিয়মিত চিলেশন কতটা গুরুত্ব বহন করে বোনম্যারো ট্রান্সপ্লান্টেশনের বেলায়। দীর্ঘদিন অধিক আয়রনের উপস্থিতি দেহের অনেক অঙ্গ, বিশেষ করে লিভার (লিভার সিরোসিস), ও হার্টের (হার্টফেইলিওর) ক্ষতি করে, যা পরবর্তী সময়ে বোনম্যারো ট্রান্সপ্লান্টেশনের ফলাফল অনেকাংশে ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং মৃত্যুঝুঁকি বেড়ে যায় (প্রায় ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ পর্যন্ত)।

তাই থ্যালাসেমিয়া রোগী, যারা বোনম্যারো ট্রান্সপ্লান্ট করাতে চায়, তাদের শুরু থেকেই নিয়মিত এবং কঠোর আয়রন চিলেশনের প্রতি দৃষ্টি দিতে হবে এবং প্রথম ব্লাড ট্রান্সফিউশনের ১৮ মাসের মধ্যে চিলেশনথেরাপি শুরু করতে হবে।

যে বয়স উপযুক্ত

থ্যালাসেমিয়া রোগীদের শিশুকালে বা অল্প বয়সে বোনম্যারো ট্রান্সপ্লান্টেশন করালে ভালো ফল পাওয়া যায়। কারণ এতে অধিক আয়রনজনিত জটিলতা এড়ানো সম্ভব হয়। যদিও ট্রান্সপ্লান্টের সুনির্দিষ্ট কোনো বয়সসীমা বেঁধে দেওয়া হয়নি, তবে ১৪ বছরের কম বয়সে ট্রান্সপ্লান্ট করা হলে থ্যালাসেমিয়ামুক্ত হয়ে বেঁচে থাকার সম্ভাবনা প্রায় ৮৩ থেকে ৯৩ শতাংশ এবং সেই সঙ্গে ট্রান্সপ্লান্টজনিত মৃত্যুহার কমে যায় প্রায় ৪ শতাংশ। 

ডোনার নির্বাচন

বোনম্যারো ট্রান্সপ্লান্টেশনের জন্য ডোনার (যিনি স্টেমসেল দান করবেন) নির্বাচন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।

♦ থ্যালাসেমিয়া রোগীদের জন্য সম্পূর্ণ HLA ম্যাচ (৬/৬) ভাই-বোন যাদের থ্যালাসেমিয়া মেজর বা হিমোগ্লোবিন-ই/বিটা থ্যালাসেমিয়া থাকবে না, তাদের আদর্শ ডোনার হিসেবে গ্রহণ করা হয়।

♦ থ্যালাসেমিয়া বাহক (মাইনর) ডোনার হতে পারবে।

♦ বিকল্প ডোনার হিসেবে অনাত্মীয় ডোনার ও হেপ্লো-আইডেনটিক্যাল ডোনার নেওয়ার সুযোগ তৈরি হচ্ছে। 

বোনম্যারো ডোনার রেজিস্ট্রি

২৫ থেকে ৩০ শতাংশ ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ ম্যাচ ভাই-বোন ডোনার পাওয়া যায়। ফলে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে অনাত্মীয় বোনম্যারো-ডোনারের ওপর নির্ভর করতে হয়। ব্লাড ডোনেশন সংস্থার মতো স্বেচ্ছায় যারা বোনম্যারো (স্টেমসেল) ডোনেট করতে চায়, তাদের নিয়ে দেশে দেশে জাতীয়ভাবে বা আন্তর্জাতিকভাবে বোনম্যারো ডোনার রেজিস্ট্রি তৈরি করা হয়েছে। তাদের নাম (HLA Typing-সহ) ডোনার রেজিস্ট্রিতে অন্তর্ভুক্ত থাকে। তারা স্বেচ্ছায় অন্যের প্রাণ বাঁচাতে বোনম্যারো ডোনেট করে। আমাদের দেশেও এরূপ ‘বাংলাদেশ ম্যারো-ডোনার রেজিস্ট্রি (BMDR)’ ২০১৯ সালে চালু হলেও এর কার্যক্রম খুবই সীমিত। এ জন্য প্রয়োজন সবার সহযোগিতা।

থ্যালাসেমিয়া রোগীদের একমাত্র নিরাময়যোগ্য চিকিৎসা পদ্ধতি হচ্ছে বোনম্যারো ট্রান্সপ্লান্টেশন এবং যথাসময়ে সঠিক নিয়মে এই চিকিৎসা গ্রহণ করলে সম্পূর্ণ নিরাময় হওয়ার সম্ভাবনা প্রায় ৯০ শতাংশ। সুতরাং বাংলাদেশে কয়েক লাখ থ্যালাসেমিয়া রোগীর জন্য সরকারি ও বেসরকারিভাবে বোনম্যারো ট্রান্সপ্লান্টেশন সুলভে করার উদ্যোগ নেওয়ার সময় এখনই।

লেখক : সাবেক বিভাগীয় প্রধান ও

প্রতিষ্ঠাতা, হেমাটোলজি ও বিএমটি বিভাগ

ডিএমসিএইচ, ঢাকা উপদেষ্টা, বাংলাদেশ

থ্যালাসেমিয়া সমিতি হাসপাতাল, ঢাকা

RELATED ARTICLES
- Advertisment -
Google search engine

Most Popular

Recent Comments