Friday, March 29, 2024
spot_img
Homeনির্বাচিত কলামবৈশ্বিকভাবে প্যাটেন্ট মুক্ত ওষুধ উৎপাদনের লক্ষ্যে সামাজিক ব্যবসা মডেল অনুসরণের এখনই সময়

বৈশ্বিকভাবে প্যাটেন্ট মুক্ত ওষুধ উৎপাদনের লক্ষ্যে সামাজিক ব্যবসা মডেল অনুসরণের এখনই সময়

মুহাম্মদ ইউনূস

World Health Assembly, যা মহামারি শুরু হওয়ার পর প্রথমবারের মতো জেনেভায়  বৈঠকে
মিলিত হতে যাচ্ছে, ভবিষ্যতে আগত মহামারিগুলোর মোকাবিলায় একটি কাঠামো প্রণয়নে একমত হয়েছে। কিন্তু বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এই সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী কার্যালয়টি, যার  ডেলিগেটদের মধ্যে বহু মধ্য ও নিম্ন আয়ের দেশ রয়েছে, এক কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি হয়েছে: বিশ্বজুড়ে করোনা মহামারি মোকাবিলায় আমরা আমাদের ভয়ানক ব্যর্থতার মাত্রা উপলব্ধি করতে শুরু করলেও পৃথিবীর ধনী দেশগুলো মহামারিকে আর কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বলে মনে করছে না।

পরবর্তী মহামারির জন্য প্রস্তুতি নিতে World Health Assembly-র ডেলিগেটদের নিকট  থেকে প্রতিশ্রুতির চেয়েও বেশি কিছু প্রয়োজন হবে। এজন্য প্রয়োজন হবে একটি অধিকতর ন্যায়ভিত্তিক বৈশ্বিক স্বাস্থ্য কাঠামো প্রতিষ্ঠায় প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার, যেখানে ক্ষমতা ভ্যাকসিন ও ওষুধ উৎপাদনের একটি সামাজিক ব্যবসা মডেলের মাধ্যমে আরও ন্যায্যভাবে বণ্টিত হবে। সামাজিক ব্যবসা টেকসই উপায়ে সমাজের বিভিন্ন সমস্যা সমাধানের নীতির উপর প্রতিষ্ঠিত ব্যবসার  সেই ধরন, যেখানে এর মালিকরা একটি নির্দিষ্ট  মেয়াদের মধ্যে বিনিয়োগকৃত মূল অর্থ ফেরত পাবার বাইরে ব্যবসা থেকে কোনোরূপ মুনাফা প্রত্যাশা করেন না। সামাজিক ব্যবসা হলো একটি লভ্যাংশবিহীন কোম্পানি যার লক্ষ্য সমাজের  কোনো সমস্যার সমাধান করা, ব্যক্তিগত মুনাফা নয়।

এ ধরনের একটি কাঠামোর দিকে অগ্রসর হতে বিশ্ব নেতৃবৃন্দ কিছু সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ নিতে পারেন। সরকারসমূহ যদি ভ্যাকসিন তৈরি ও এর বণ্টনের জন্য ওষুধ কোম্পানিগুলোকে শত শত  কোটি ডলার অনুদান দিতে পারে, তাহলে তারা সামাজিক ব্যবসা ওষুধ কোম্পানিতেও এই তহবিলগুলো বিনিয়োগ করতে পারে যাতে দরিদ্র জনগোষ্ঠী সহজে ভ্যাকসিনের সুবিধা পেতে পারে।

এই মহামারি বৈশ্বিক অসমতাকে আরও প্রকট করে তুলেছে: পৃথিবীতে দুই কোটিরও বেশি মানুষ কোভিড-১৯ এর কারণে মৃত্যুবরণ করেছে যাদের অধিকাংশই দরিদ্রতর দেশগুলোর নাগরিক। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এ বছরের মাঝামাঝি সময়ের মধ্যে পৃথিবীর ৭০ শতাংশ মানুষকে ভ্যাকসিনের আওতায় নিয়ে আসার টার্গেট হাতে নিয়েছিল। আমরা উক্ত সময়সীমার কাছাকাছি  পৌঁছে গেলেও নিম্ন আয়ের দেশগুলোর মাত্র ১৬ শতাংশ মানুষ এখন পর্যন্ত ভ্যাকসিনের একটি  ডোজ পেয়েছে। এই হারে চললে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার টার্গেট অর্জনে দরিদ্রতম দেশগুলোর আরও দুই থেকে আড়াই বছর সময় লেগে যাবে।
নিম্নতর আয়ের দেশগুলো এক বছরেরও বেশি সময় ভ্যাকসিন না পেলেও শেষ পর্যন্ত কিছু ডোজ  পৌঁছাতে শুরু করেছে। ভ্যাকসিনের এই সরবরাহগুলো হঠাৎ করেই বড় আকারে একসঙ্গে আসতে শুরু করে এবং প্রায় ক্ষেত্রেই মেয়াদ সমাপ্তির কাছাকাছি সময়ে।

ডোজগুলো যখন আসে তখন কোন ভ্যাকসিনগুলো সরবরাহ করা হচ্ছে, কী পরিমাণে এবং কোন টাইমলাইনে- এসব বিষয়ে দরিদ্রতর  দেশগুলোর কিছু বলার তেমন কোনো সুযোগই থাকে না।

ফলে টিকাদান কর্মসূচি পরিকল্পিতভাবে পরিচালনা করা তাদের পক্ষে একরকম অসম্ভব হয়ে পড়ে। টিকা উৎপাদন এরই মধ্যে উত্তর গোলার্ধেই কেন্দ্রীভূত হয়ে  থেকেছে।
আর এখন এন্টিভাইরাল পিলের মতো কার্যকর চিকিৎসা উদ্ভাবিত হওয়ার পর পুরো প্রক্রিয়াটিরই পুনরাবর্তন শুরু হয়ে গেছে।

ধনী দেশগুলো এরই মধ্যে Pfizer-এর Paxlovid  এবং Merck-এর Lagevrio ২০২২ সালের প্রায় পুরো সরবরাহই কিনে রেখেছে। এই কোম্পানিগুলো নজরদারি করছে কোন কোন দেশ এই ওষুধ তৈরি করতে পারবে, এবং কারা পারবে না- যার মধ্যে প্রায় পুরো ল্যাটিন আমেরিকা রয়েছে। Pfizer  অনেকটা অশোভনভাবেই দাবি করছে যে,  ডোমিনিকান রিপাবলিকে Paxlovid উৎপাদনের কোনো প্রচেষ্টা কোম্পানিটির “মানবাধিকার” লঙ্ঘন বলে বিবেচিত হবে।

সম্পদই ক্ষমতা। আর কোভিড-১৯ এর ভ্যাকসিন ও চিকিৎসায় নিষ্ঠুর রকমের অসম বৈশ্বিক বণ্টন সম্পদের ক্রমবর্ধমান কেন্দ্রীকরণ এবং মুনাফা সর্বোচ্চকরণের উপর একক মনোযোগেরই পরিণতি। আজকের ওষুধ শিল্প সর্বোচ্চ মুনাফার জন্য সর্বোচ্চ দরদাতার কাছে ওষুধ বিক্রি করে থাকে। ন্যায্যতা ও সুযোগের অধিকারকে গণসংযোগ ইস্যুগুলোর চেয়ে তেমন একটা বেশি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা হয় না।

এই প্রকট অসমতার বিপরীতে যা অত্যাবশ্যক তা হলো কোভিড-১৯ ভ্যাকসিনের বিশ্বব্যাপী বিতরণের জন্য তাৎক্ষণিক তহবিলের ব্যবস্থা,  কোভিড পরীক্ষা এবং চিকিৎসা। পৃথিবীর সবচেয়ে ধনী দেশসমূহ অর্থাৎ জি-১০ দেশগুলো- যারা সম্পদ কেন্দ্রীকরণের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাটির সুবিধাভোগী- তারাই বর্তমান ফার্মাসিউটিক্যাল মডেলটির সুবিধা নিচ্ছে যদিও এর জন্য মূল্য দিতে হচ্ছে অন্যদের। ভ্যাকসিন অসমতা কমিয়ে আনার প্রয়োজনীয় সব সম্পদই তাদের কাছে আছে এবং তারা চাইলেই এটা করতে পারে। আর এটা শুরু করতে সম্প্রতি আমি অন্যান্য কয়েকজনের সঙ্গে মিলে প্রেসিডেন্ট বাইডেনকে অনুরোধ করেছি বিশ্বব্যাপী টিকাদান কর্মসূচিকে সহায়তা করার জন্য ৫ বিলিয়ন ডলারের একটি তহবিল গঠনের নেতৃত্ব দিতে।

ভ্যাকসিনের উৎপাদন ক্রমাগত বৃদ্ধি পেলেও  সেগুলো সঠিক জায়গায় সঠিক মানুষগুলোর কাছে  পৌঁছাচ্ছে না। যখন নতুন ও আরও কার্যকর ভ্যাকসিন তৈরি হবে, আবারো সেগুলো সর্বোচ্চ দরদাতার কাছে বিক্রি হবে, এবং নিম্ন আয়ের  দেশগুলোকে গতকালের ভ্যাকসিন দিয়ে আজকের নতুন ভার্সনের ভাইরাসের সঙ্গে যুদ্ধ করতে হবে। এই ব্যবস্থাটির পরিবর্তন খুবই জরুরি। ভ্যাকসিন ও চিকিৎসাগুলো কোথায় তৈরি হচ্ছে, কাদের দ্বারা, কী উদ্দেশ্যে, এবং এগুলো কীভাবে সুলভে সবার কাছে পৌঁছে দেয়া যায়- এ বিষয়ে সুস্পষ্ট সিদ্ধান্ত প্রয়োজন। আর এর চাবিকাঠি হচ্ছে  কোভিড-১৯ ভ্যাকসিনকে মুনাফা ও প্যাটেন্ট  থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত করা।

এ কারণে আমি সোশ্যাল বিজনেস ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানি প্রতিষ্ঠার সুপারিশ করছি। এই কোম্পানিগুলো  লভ্যাংশের অনুসন্ধান করবে না। তারা ভ্যাকসিন ও ওষুধ তৈরি করবে  সেসব স্থানে ও মানুষদের কাছে পৌঁছাতে বর্তমান ব্যবস্থায় যারা সবসময় বঞ্চিত থেকে যায়। তাদের কাছে এগুলো বিক্রি করা হবে উৎপাদন খরচে,  কোনো রকম মুনাফা না করে, এবং নিম্নতম আয়ের মানুষদের কাছে ক্রস-সাবসিডির মাধ্যমে, যাতে এগুলোর দাম তাদের সাধ্যের মধ্যে থাকে। স্বাস্থ্য খাতের কাছে তার সবচেয়ে জরুরি একটি সমস্যার মোকাবিলায়, একেবারে নিচে থেকে উপরের দিকে প্রত্যেকের কাছে পৌঁছানোর এটি হতে পারে একটি সুস্পষ্ট পদক্ষেপ। কিন্তু এজন্য প্রয়োজন বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পত্তি আইনের মতো বাধাগুলো দূর করা এবং সামাজিক ব্যবসা উদ্যোগ। বিশ্বব্যাপী ভ্যাকসিনের উৎপাদন বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে প্যাটেন্ট-মুক্ত ভ্যাকসিন উৎপাদনের আবেদনে কিছুটা গতি এলেও একটি কার্যকর কর্মপন্থার প্রয়োজনে এটি যথেষ্ট নয়।

সংকটের এই গভীরতা ও ব্যাপ্তির মধ্যে এই উদ্যোগ নেয়ার এখনই সর্বোত্তম সময়। আমরা যদি একটি চ্যারিটি মডেল থেকে সামাজিক ব্যবসা মডেলে ক্রমান্বয়ে উত্তরণের জন্য সিদ্ধান্ত নিই, তাহলে আমরা স্থানীয় পর্যায়ে ভ্যাকসিনের উৎপাদন ও বিতরণ, পরীক্ষা এবং চিকিৎসার ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করতে পারবো। নেতারা প্যাটেন্ট অগ্রাহ্য করে এবং সামাজিক লক্ষ্যে পরিচালিত জেনেরিক ওষুধ উৎপাদনে বিনিয়োগ করে পরবর্তী প্রজন্মের করোনাভাইরাস ভ্যাকসিন দিয়ে শুরু করতে পারেন, যাতে দক্ষিণ গোলার্ধকে গতকালের হাতিয়ার দিয়ে আগামীকালের ভ্যারিয়েন্টগুলোর মোকাবিলার চেষ্টা করতে না হয়।
এ মাসে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার বৈঠকে বিশ্ব নেতারা  কোভিড-১৯ এর সঙ্গে সম্পর্কিত যাবতীয় ওষুধের  ক্ষেত্রে বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পত্তি আইনগুলোর সর্বাঙ্গীণ স্বত্বত্যাগ সমর্থন করে জেনেরিক ভ্যাকসিন উৎপাদন এবং ভাইরাসের চিকিৎসার অন্তরায়গুলো দূর করতে পারেন। একই সঙ্গে তারা ওষুধ  কোম্পানিগুলোকে ভ্যাকসিন, পরীক্ষা এবং চিকিৎসা প্রযুক্তি দক্ষিণ গোলার্ধের নিকট সহজলভ্য করতে তাদের সকল ক্ষমতা ব্যবহার করতে পারেন।

তবে এর বিপরীতে ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাজ্য এবং সুইজারল্যান্ড বরং এক বছরেরও  বেশি সময় ধরে বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পত্তির স্বত্বত্যাগ বাধাগ্রস্ত করে রেখেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কোভিড চিকিৎসায় এসব বাধা অপসারণে সমর্থন দিতে অস্বীকার করেছে এবং শুধু ভ্যাকসিনের ক্ষেত্রে এই স্বত্বত্যাগের উপর জোর দিয়ে আসছে। তারা বুঝতে পেরেছে যে, কোভিড-১৯ এর উপর রাজনৈতিক চাপ ক্ষীণ হয়ে আসছে। ফলে আলাপ-আলোচনা অগ্রসর হলেও ধনী দেশগুলো একই কাতারে চলে আসছে।
কোভিড-১৯ এ যারা অনাবশ্যক মৃত্যুবরণ করেছেন তাদের ক্ষেত্রে অবশ্য যেকোনো অর্থপূর্ণ অগ্রগতির জন্য এখন অনেক বেশি দেরি হয়ে  গেছে। কিন্তু আমাদের আজকের উদ্যোগ আগামী দিনের ভ্যারিয়েন্টগুলোর মোকাবিলায় আমাদের কর্মপন্থার ভুল-ত্রুটিগুলো সংশোধন করতে পারে এবং ভবিষ্যতের স্বাস্থ্য সংকটগুলো মোকাবিলায় একটি কার্যকর মডেল তৈরি করতে পারে। বিশ্বনেতাদের কাছে এখনো সময় আছে স্বাস্থ্যসেবায় পৃথিবীর প্রতিটি মানুষের অধিকার নিশ্চিত করার এবং একটি ন্যায়ভিত্তিক বৈশ্বিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থা- যা কতিপয় ওষুধ কোম্পানির মুনাফার চেয়ে মানুষের জীবনকে প্রাধান্য দেবে- তার প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হবার।
– STAT News- এ প্রকাশিত লেখার অনুবাদ

RELATED ARTICLES
- Advertisment -
Google search engine

Most Popular

Recent Comments