দেশে রিজার্ভের পরিমাণ কমছে। রেমিট্যান্স তো বটেই, রপ্তানি আয় থেকেও কাঙ্ক্ষিত মুদ্রা অর্জিত হচ্ছে না। এমন অবস্থায় ঋণ পরিশোধ করতেই হচ্ছে। এতে দ্রুত কমছে রিজার্ভ। এর ওপর যোগ হয়েছে রপ্তানি খাতের কাঁচামাল আমদানির জন্য বৈদেশিক ব্যাক টু ব্যাক এলসির দায়। শনিবার যুগান্তরের খবরে প্রকাশ-এলসির এ দায় বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১২ হাজার কোটি টাকায় বা ১০১ কোটি ডলারে। গত সেপ্টেম্বরে যা ছিল ৭৬ হাজার কোটি ডলার, তিন মাসে (অক্টোবর-ডিসেম্বর) তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৫ কোটি ডলারে অর্থাৎ ২৯৫০ কোটি টাকায়। জানা গেছে, ডলার সংকটের কারণে সাম্প্রতিক সময়ে বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ কমিয়ে দেওয়ায় এবং কিছু খাতে ঋণ পরিশোধের মেয়াদ বাড়ানোর ফলে বকেয়া স্থিতি এতটা বেড়ে গেছে।
মূলত বৈদেশিক ব্যাক টু ব্যাক এলসির মাধ্যমে রপ্তানিমুখী শিল্পের কাঁচামাল আমদানি করা হয়। রপ্তানি আয় দেশে আসার পর ওই দায় সমন্বয় করা হয়। স্থানীয় কিছু এলসির মাধ্যমেও দেশ থেকে কাঁচামাল সংগ্রহ করা হয়। আগে রপ্তানি খাতের কাঁচামাল আমদানির জন্য বৈদেশিক ব্যাক টু ব্যাক এলসির কোনো দায় বকেয়া থাকত না। কিন্তু করোনার সময় বৈশ্বিক লকডাউনের কারণে এ খাতের দায় সময়মতো পরিশোধ করা সম্ভব হয়নি, ফলে বকেয়া জমেছে। এর ওপর ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ পরিস্থিতিতে সৃষ্ট বৈশ্বিক মন্দা ও ডলার সংকটের কারণে এ দায় ক্রমেই বেড়েছে।
এলসির দায় বৃদ্ধি যে অর্থনীতির জন্য ভালো নয়, তা বলাই বাহুল্য। কারণ দেশে ডলারের দাম বাড়ায় বাড়তি টাকা দিয়ে সরকারকে তো বটেই, ব্যবসায়ীদেরও ডলার কিনে ঋণ শোধ করতে হচ্ছে। বৈদেশিক ঋণের কিস্তি পরিশোধ স্থগিত করায় রিজার্ভের হয়তো সাময়িক উপশম হয়েছে, কিন্তু দেশের বৈদেশিক দায় বেড়েছে তিন দিক থেকে : ঋণের অঙ্ক, সুদহার ও ডলারের দাম বৃদ্ধি। ফলে ঋণগ্রহীতাদের এখন তিন দিক থেকে বেশি অর্থ পরিশোধ করতে হচ্ছে। এসব কারণে ডলার তো বটেই, টাকার ওপরও চাপ বাড়ছে। কারণ ব্যাংকগুলোতে যথেষ্ট তারল্য নেই। ফলে তারা গ্রাহকদের চাহিদা অনুযায়ী ঋণ দিতে পারছে না। এছাড়া মূল্যস্ফীতির হার কমাতে সংকোচনমুখী মুদ্রানীতি গ্রহণের ফলে বাজারে টাকার প্রবাহ কমেছে। এর মাধ্যমে ব্যাংকগুলোর তারল্যে যেমন লাগাম টানা হয়েছে, তেমনি সুদের হার বাড়িয়ে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধিও কমানো হয়েছে।
আমরা মনে করি, স্থিতাবস্থায় না রেখে বৈদেশিক এলসির বকেয়া পরিশোধে উদ্যোগী হতে হবে। পাশাপাশি মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে চলমান সংকোচনমুখী মুদ্রানীতি কতটুকু কার্যকর হয়েছে, তা কেন্দ্রীয় ব্যাংককে পুনর্বিবেচনা করতে হবে। চলমান ডলার সংকটের পেছনে শুধু বৈশ্বিক পরিস্থিতি দায়ী, নাকি অন্তরালে অন্য কারণও রয়েছে, তা খতিয়ে দেখতে হবে। খেলাপি ঋণ আদায় কার্যক্রম বাড়াতে হবে। একইসঙ্গে রপ্তানি বৃদ্ধিতে গুরুত্ব দিতে হবে। প্রবাসীদের উপার্জিত অর্থ বৈধ পথে দেশে প্রেরণে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। আমদানির আড়ালে ডলার পাচার ও হুন্ডি রোধে নিতে হবে কঠোর পদক্ষেপ। তা না হলে রিজার্ভ বৃদ্ধিসহ দেশের অর্থনৈতিক সংকট নিরসনে যত ভালো পদক্ষেপই নেওয়া হোক না কেন, তাতে টেকসই সমাধান মিলবে না।