বৈদেশিক ঋণের ঝুঁকি ক্রমান্বয়ে বাড়ছে; বিশেষ করে চলমান অর্থনৈতিক সংকটের মাঝেই ২০২৩ সাল থেকে কিছু বড় প্রকল্পের বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ করতে হবে, যা ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকবে এবং ২০২৭ সালে তা সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছার পর পরবর্তী কয়েক বছর পর্যন্ত চলবে।
উল্লেখ্য, আগামী বছর থেকে চীন, ভারত এবং এশিয়ান ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংকের ঋণের সুদসহ আসল পরিশোধ শুরু হবে। এছাড়া রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পে রাশিয়া থেকে নেওয়া ঋণের রেয়াত কাল শেষ হয়ে ২০২৭ সালে শুরু হবে মূল ঋণের কিস্তি। এছাড়া ২০২৮ সালে শুরু হবে মেট্রোরেল প্রকল্পের ঋণ পরিশোধ কার্যক্রম। এর বাইরে বর্তমানে অন্যান্য খাতে নেওয়া ঋণ সুদসহ পরিশোধ করতে গিয়ে চাপে পড়েছে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ। অবশ্য স্বল্পমেয়াদি বেশকিছু ঋণের কিস্তি পরিশোধের মেয়াদ আগামী জুন পর্যন্ত বাড়িয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। জুনের পর ওইসব ঋণ পরিশোধ শুরু হলে রিজার্ভে চাপ আরও বাড়বে, এতে কোনো সন্দেহ নেই।
সম্প্রতি বিশ্বব্যাংক প্রকাশিত এক প্রতিবেদনেও বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ করতে গিয়ে বাংলাদেশ বেশ চাপে পড়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। বস্তুত ঋণের পরিমাণ বাড়ায় সুদসহ আসল পরিশোধের পরিমাণও বেড়েছে। ২০২০ সালে দীর্ঘমেয়াদি ঋণের আসল ২৮৭ কোটি ডলার এবং সুদ বাবদ ৮৬ কোটি ডলার পরিশোধ করা হয়েছিল। গত বছরে একই খাতে আসল ও সুদ বাবদ ঋণ পরিশোধ করা হয়েছে ৫৩০ কোটি ডলার। দেখা যাচ্ছে, ২০২০ সালের তুলনায় ২০২১ সালে ঋণ পরিশোধের পরিমাণ বেড়েছে ১৫৭ কোটি ডলার। আশঙ্কার বিষয় হলো, এখন প্রতিবছরই পরিশোধের এ হার বাড়তে থাকবে। এ অবস্থায় বেশি সুদ ও কঠিন শর্তযুক্ত ঋণ গ্রহণে সরকারের বিরত থাকা উচিত। একইসঙ্গে ঋণ পরিশোধে বৈদেশিক মুদ্রার মজুত ও আয়ের মূল্যায়নও জরুরি। অপ্রিয় হলেও সত্য, বর্তমানে এ জায়গাটায় কোনো স্বচ্ছতা ও মূল্যায়ন নেই। মনে রাখা দরকার, বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের ক্ষেত্রে বড় ধরনের চাপ এলে বৈদেশিক মুদ্রা লেনদেনের ক্ষেত্রে সমস্যা তৈরি হবে। শুধু তাই নয়, টাকার মান দুর্বল হওয়াসহ বিনিয়োগ কমে যাওয়া এবং মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধিসহ নানা ক্ষেত্রে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। এজন্য সতর্ক ব্যবস্থা হিসাবে ঋণের কিস্তি পরিশোধের মেয়াদ বাড়িয়ে রিজার্ভের ওপর চাপ কমানোর উদ্যোগ গ্রহণের কথা বলেছেন কোনো কোনো অর্থনীতিবিদ।
স্বস্তির বিষয় হলো, স্বাধীনতার পর থেকে এ যাবৎ বাংলাদেশ যথাসময়ে ঋণ পরিশোধে সক্ষম হয়েছে। এমনকি ঋণ পরিশোধের ক্ষেত্রে কিস্তি পুনঃতফসিলকরণের জন্য আবেদন করারও প্রয়োজন হয়নি। অর্থনীতিবিদদের মতে, সরকারের ঋণের পরিমাণ জিডিপির ৪০ শতাংশ পর্যন্ত উদ্বেগজনক নয়। বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণ নেওয়ার হার বর্তমানে জিডিপির তুলনায় ১১ দশমিক ৯ শতাংশ। শ্রীলংকার ক্ষেত্রে এটি ৪১ শতাংশ ও পাকিস্তানের ক্ষেত্রে ৩৯ শতাংশ। তবে শ্রীলংকার অর্থনীতি দেউলিয়া হওয়ার পর আমাদের বাজেটে ঋণ ব্যবস্থাপনায় বড় ধরনের পরিবর্তন আনা হয়েছে। বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রী ‘বিদেশি ঋণ’ ঝুঁকিসীমার নিচে রাখার নির্দেশ দেওয়ায় বৈদেশিক ঋণের প্রতি ঝোঁক অনেকটা কমে এসেছে। এ পরিপ্রেক্ষিতে বৈদেশিক ঋণ পরিশোধে কোনো সমস্যা হবে না বলেই মনে হয়। তারপরও এক্ষেত্রে যথেষ্ট সতর্ক থাকা উচিত বলে মনে করি আমরা।