‘মানুষ যেখান থেকে আসে, সেখানেই ফিরে যায়। কেউ কেউ জায়গা করে নেন ইতিহাসের পাতায়। কেউ নায়ক হন, কেউ হন প্রতিনায়ক। তারা ইতিহাস তৈরি করেন।’ ইতিহাস তৈরি করে অনেকটা নীরবে-নিভৃতে চলে গেলেন সিরাজুল আলম খান। নীরবতা অবশ্য ভালোবাসতেন তিনি। ফেরি করে বেড়াতেন স্বপ্ন। সঙ্গী-সাথীদের যখন স্বাধীনতার মন্ত্রে উদ্বুদ্ধ করেছেন সেটাও করেছেন অনেকটা নীরবে, নেপথ্যে। মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোতে অবশ্য ছিলেন সরব। স্বাধীন দেশে বিচ্ছিন্নতা-বিদ্রোহ। তাও কখনও সামনে আসেননি।
আড়ালের সে প্রেম ধরে রেখেছেন নিজের জীবনের শেষদিন পর্যন্ত।
গতকাল দিনের মধ্যভাগে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডেয়িার জেনারেল নাজমুল হক যখন নিশ্চিত করলেন সিরাজুল আলম খান মারা গেছেন তখন ইতিহাসের একটি অধ্যায় আসলেই শেষ হয়ে গেল। ৮২ বছর বয়সে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন সিরাজুল আলম খান (ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। পরিবারের পক্ষ থেকে ইতিমধ্যে জানিয়ে দেয়া হয়েছে, রাষ্ট্রীয় মর্যাদা চান না তারা। সিরাজুল আলম খানের শেষ ইচ্ছা অনুযায়ী তার লাশ দাফন হবে নোয়াখালীতে। দীর্ঘদিন থেকে বার্ধক্যজনিত নানা রোগে ভুগছিলেন তিনি। তার মৃত্যুতে প্রেসিডেন্ট মো. সাহাবুদ্দিন, বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ বিভিন্ন দল ও ব্যক্তি শোক প্রকাশ করেছেন।
দীর্ঘ রাজনীতির ক্যারিয়ারে সিরাজুল আলম খান পরিচিতি পেয়েছিলেন রহস্যপুরুষ হিসেবে। কেউ কেউ তাকে ডাকতেন ‘দাদা ভাই’। এ রিপোর্টের শুরুতে উদ্ধৃত অংশটুকু নেয়া হয়েছে মহিউদ্দিন আহমেদের লেখা ‘প্রতিনায়ক: সিরাজুল আলম খান’- নামের বই থেকে। ওই বইতেই আরও লেখা হয়েছে, ‘ষাটের দশকে সিরাজুল আলম খানের উত্থান ছাত্রনেতা শাহ মোয়াজ্জেম হোসেনের হাত ধরে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছায়াতলে। এ সময় আরও কয়েকজন তরুণ ছাত্রনেতা মাঠ কাঁপিয়েছেন।
তাদের সঙ্গে সিরাজুল আলম খানের ফারাক এক জায়গায়- তিনি ধারাবাহিকভাবে লেগে ছিলেন।’ ১৯৪১ সালের ৬ই জানুয়ারি নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ উপজেলার আলীপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন সিরাজুল আলম খান। ১৯৫৬ সালে ম্যাট্রিক পাস করেছিলেন তিনি। ওই বছরই ঢাকা কলেজে ভর্তি হন। পরে ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগে। ছাত্রজীবনে ফিদেল ক্যাস্ত্রোর মুক্তি সংগ্রাম, আলজেরিয়া, ফিলিস্তিন, ভিয়েতনামের সশস্ত্র সংগ্রাম তাকে উদ্বুদ্ধ করেছিল দারুণভাবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগ নেতাদের সাহচার্যে একসময় জড়িয়ে পড়েন রাজনীতিতে। একপর্যায়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শিষ্য হিসেবে পরিচিতি পান তিনি। স্বাধীনতার আন্দোলন-সংগ্রাম পরিচালনার জন্য সিরাজুল আলম খান, আব্দুর রাজ্জাক ও কাজী আরেফ আহমেদের নেতৃত্বে ষাটের দশকের প্রথমার্ধে স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ বা স্বাধীনতার ‘নিউক্লিয়াস’- গঠিত হয়। পরে ছাত্র-তরুণদের আন্দোলন সংগঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন তারা।
তবে মুক্তিযুদ্ধের পর ছাত্রলীগে পুরনো দ্বন্দ্ব নতুন করে দেখা দেয়। এরই প্রেক্ষাপটে ১৯৭২ সালের ৩১শে অক্টোবর জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল বা জাসদ গঠন করেন সিরাজুল আলম খান। যার ধারাবাহিকতায় নানা বিয়োগান্তক ঘটনাও ঘটে।
রাষ্ট্রীয় মর্যাদা চান না সিরাজুল আলমের পরিবার
মৃত্যুর পর সিরাজুল আলম খানকে রাষ্ট্রীয়ভাবে সম্মান জানানো হোক- এমনটা চান না তার পরিবার। শুক্রবার সিরাজুল আলম খানের ছোটভাই ফেরদৌস আলম খান পিয়ারু এমনটাই জানান। তিনি বলেন, দাদা ভাই সিরাজুল আলম খান সবসময় প্রচারণার বাহিরে থেকেছেন। তিনি মৃত্যুর আগে তার কিছু আশার কথা বলে গিয়েছেন। তিনি মৃত্যুর পরে রাষ্ট্রীয় মর্যাদা চান না। সিরাজুল আলম খান বলে গেছেন তাকে যেন রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দাফন করা না হয়। এমনকি দাফনের সময় তাকে কাফনের বদলে মায়ের কাপড় দিয়ে মুড়িয়ে দাফন করার ইচ্ছার কথা জানিয়ে গেছেন। তিনি বলেছেন, মায়ের শাড়িটাই আমার কাছে পতাকা। আমি এই পতাকা নিয়েই চলে যেতে চাই।
সিরাজুল আলম খানের ভাতিজি ব্যারিস্টার ফারাহ আলম খান বলেন, চাচা বলে গেছেন- মৃত্যুর পরে আমাকে কোথাও রাখার দরকার নেই। আমাকে যেন ডিসপ্লে করা না হয়। আমার জন্য হাজার হাজার ফুল আসার দরকার নেই। আমি দেশটা স্বাধীন করতে চেয়েছিলাম। আমি স্বাধীন করতে পেরেছি। সেটাই আমার বড় অর্জন। আমি কারো কাছে কিছু চাই না।
পরিবার সূত্র জানিয়েছেন, সিরাজুল আলম খানের মরদেহ বিকালে হাসপাতাল থেকে মোহাম্মদপুরের আল-মারকাজুলে নেয়া হয়েছে। সেখানে গোসল শেষে রাতে শমরিতা হাসপাতালের হিমঘরে রাখা হবে। আগামীকাল সকাল ১০টায় জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমে দক্ষিণ গেটে সিরাজুল আলম খানের প্রথম জানাজা অনুষ্ঠিত হবে। জানাজা শেষে তার মরদেহ নোয়াখালীর বেগমগঞ্জের আলীপুরে নেয়া হবে। সেখানে দ্বিতীয় জানাজা শেষে মায়ের কবরের পাশেই শায়িত করা হবে।
এর আগে দুপুর আড়াইটায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আইসিইউতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যু হয় সিরাজুল আলম খানের। ৮২ বছর বয়সী সিরাজুল আলম খান উচ্চ রক্তচাপ, শ্বাসকষ্ট, ফুসফুসে সংক্রমণসহ নানা শারীরিক জটিলতায় ভুগছিলেন। গত ৭ই মে থেকে শমরিতা হাসপাতালে চিকিৎসা চলছিল তার। পরে ২০শে মে তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়। শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে ১লা জুন তাকে কেবিন থেকে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) স্থানান্তর করা হয়। বৃহস্পতিবার রাতে তাকে লাইফ সাপোর্ট দেয়া হয়। ৮২ বছর বয়সী ‘দাদা ভাই’ উচ্চ রক্তচাপ, শ্বাসকষ্ট, ফুসফুসে সংক্রমণসহ নানা শারীরিক জটিলতায় ভুগছিলেন।
হাসপাতালে ভিড়
সিরাজুল আলম খানের মৃত্যুর খবরে হাসপাতালে ছুটে যান জাসদের সভাপতি হাসানুল হক ইনু, বাংলাদেশ জাসদের সভাপতি শরীফ নুরুল আম্বিয়া, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জেএসডি) সভাপতি আ.স.ম. আবদুর রব, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দলের (বাসদ) সাধারণ সম্পাদক খালেকুজ্জামান, নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান (মান্না), জনসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকি, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক, গণঅধিকার পরিষদের সদস্যসচিব নুরুল হক (নুর)।
এসময় আ.স.ম. আব্দুর রব বলেন, সমস্ত স্মৃতি নিয়ে শ্রদ্ধা নিয়ে চলে গেলেন সিরাজুল আলম খান দাদা ভাই। তিনি অত্যন্ত সাহসী, আত্মত্যাগী, কৌশলী, বুদ্ধিমান ব্যক্তি ছিলেন। বাংলাদেশের আন্দোলনে মুজিবুর রহমানের পরে যদি কারো নাম নিতে হয়। তবে সিরাজুল আলমের নাম নিতে হবে। অত্যন্ত সাধারণ জীবনযাপন করতেন দাদা ভাই।
জাসদ নেতা হাসানুল হক ইনু বলেন, বঙ্গবন্ধুর ডান হাত ছিলেন সিরাজুল আলম খান দাদা ভাই। বাংলাদেশের অনেক কিছুর কাণ্ডারী ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধে তার ভূমিকা ছিল অন্যতম।
মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, তার এতো অর্জন, এতো কীর্তি বলে শেষ করা যাবে না। আমার রাজনীতি শুরু তার হাত ধরেই। তার মতো অসাধারণ প্রতিভাবান সংগঠক আর হবে না। যেকোনো প্রতিকূল পরিবেশকে অনুকূল পরিবেশ কীভাবে করতে হয় সেটা তিনি ভালো জানতেন। বাংলাদেশে স্বাধীনতা আন্দোলনে শেখ মুজিবের পরে যদি কারো নাম লিখতে হয় তিনি হবেন সিরাজুল আলম খান। কারণ এই আন্দোলনকে সংগঠিত করার জন্য তিনি বড় ভূমিকা পালন করেছেন।
আজকের এই দিনটা আমাদের সমগ্র দেশের জন্য, রাষ্ট্রের জন্য কষ্টের দিন হওয়ার কথা। আমি জানি না এখন পর্যন্ত রাষ্ট্র বা সরকারের পক্ষ থেকে কেউ এখানে আসছেন কিনা। হয়তো তারা আসবেন। আসুক বা না আসুক। সিরাজুল আলম খান, সিরাজুল আলম খানই থাকবেন। তিনি আরও বড় হবেন। ছোট হবেন না। বরং রাষ্ট্র যদি তাকে সম্মান দেয় তাহলে রাষ্ট্র গৌরবান্বিত হবে।
নুরুল হক নুর বলেন, আসলে তরুণ প্রজন্মের অনেকেই সিরাজুল আলম খানকে চিনে না। তাই দেশের জন্য তার অবদান সম্পর্কেও জানেন না। প্রকৃত অর্থে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সিরাজুল আলম খান দাদা ভাই ছাড়া লেখা সম্ভব না। এবং তাকে ছাড়া স্বাধীনতার ইতিহাস অসম্পূর্ণ থাকবে। এখন রাষ্ট্র তার প্রতি কি সুবিচার করবে সেটা আমরা জানি না। যদি সঠিক ইতিহাসের মাধ্যমে আগামী প্রজন্মকে তার কীর্তিগুলো তুলে ধরা হয়। সেটাই তার প্রতি সর্বশেষ সম্মান ও শ্রদ্ধা জানানো হবে।