জলবায়ু সংবেদনশীল গ্রীষ্মমণ্ডলীয় অঞ্চলের অন্যতম রোগ ডেঙ্গু। এই রোগ বিশ্বজনীন জনস্বাস্থ্যের জন্য শীর্ষ ১০টি হুমকির অন্যতম। প্রতিবছর শতাধিক দেশে আনুমানিক ৩৯০ মিলিয়ন মানুষ সংক্রমিত হয়। তবে এখন পর্যন্ত এর চিকিৎসা নেই।
ডেঙ্গু ভাইরাস ছিল বানরের মধ্যে আর লাফিয়ে নামে মানুষের মধ্যে ৮০০ বছর আগে। ভাইরাসটি প্রথমে আফ্রিকার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় সীমাবদ্ধ ছিল মধ্য বিশ শতক পর্যন্ত। বাহক এডিস এজিপ্টাই মশার মাধ্যমে ভাইরাস ছড়িয়ে পড়লে অধিকসংখ্যক মানুষ সংক্রমিত হতে শুরু করে।
প্রথম ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয় ব্রাজিলের রেসিফ নগরে। সেটা ১৬৮৫ সালের কথা। এর সাত বছর পর মধ্য আমেরিকার দেশ এল সালভাদরে ডেঙ্গু মহামারিতে মারা যায় দুই হাজার মানুষ। ১৯৪৩ সালে এই ভাইরাস আবিষ্কার করেন জাপানের রেন কিমুরা ও সুসুমা হটটা। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ফিলিপাইন ও থাইল্যান্ডে গুরুতর ডেঙ্গু মহামারি প্রথম দেখা দেয় ১৯৫০ সালে।
ডেঙ্গুর কারণ
ডেঙ্গু হলো ভাইরাল সংক্রমণ, সংক্রমিত মশার দংশনে মানুষের মধ্যে ভাইরাস সংক্রমিত হয়। প্রধান বাহক হলো এডিস এজিপ্টাই মশা। কিছু ক্ষেত্রে এডিস এলবোপিকটাসও এই রোগ ছড়ানোর জন্য দায়ী। আরএনএ ভাইরাস ডেঙ্গু, ভাইরাস ডেনভি এর চার সেরোটাইপ।
ট্রপিকাল ও সাব-ট্রপিকাল জলবায়ুর দেশের নগর ও শহরতলিতে গুরুতর ডেঙ্গুর প্রকোপ বেশি দেখা যায়। এটি প্রতিরোধে বাহক মশার কার্যকর নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। বর্ষার সময় শহরাঞ্চলে প্রাদুর্ভাব বেশি দেখা দেয়। এই মশা বেশি কামড়ায় দিনে, বিশেষ করে ভোরে ও সন্ধ্যায়।
লক্ষণ
♦ বেশির ভাগ ক্ষেত্রে মৃদু। শিশু ও বয়স্কদের জন্য গুরুতর হতে পারে।
♦ উপসর্গ থাকে দুুই থেকে সাত দিন।
♦ সংক্রমিত মশার দংশনের পর চার থেকে ১০ দিন অতিবাহিত হওয়ার পর উপসর্গ দেখা দেয়।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দেওয়া তথ্য অনুযায়ী ডেঙ্গু দুই ধরনের হয়ে থাকে—ডেঙ্গু ও গুরুতর ডেঙ্গু।
ডেঙ্গু
খুব জ্বর, প্রচণ্ড মাথা ধরা, চোখের পেছনে ব্যথা, পেশি আর হাড়ের গিঁটে ব্যথা, ব্রেক বোন ফিভার, বমি ভাব, বমি, গ্ল্যান্ড ফোলা, র্যাশ।
গুরুতর ডেঙ্গু
♦ অসুখ শুরু হওয়ার তিন থেকে সাত দিন পর জটিলতা দেখা দিতে পারে।
♦ জ্বর কমলেও বিপদমুক্ত হওয়া যায় না।
♦ প্রচণ্ড পেট ব্যথা।
♦ অবিরাম বমি।
♦ দ্রুত শ্বাস।
♦ নাক বা মাড়ি দিয়ে রক্তক্ষরণ।
♦ অবসন্নতা।
♦ অস্থিরতা।
♦ লিভার বড় হয়ে যাওয়া।
♦ বমি আর মলের সঙ্গে রক্ত যাওয়া।
♦ হতে পারে প্রাণঘাতী।
সঠিক চিকিৎসা না থাকায় সাবধানতা অবলম্বন ও চিকিৎসা ব্যবস্থাপনা ঠিক রাখা জরুরি। ক্লাসিক্যাল ডেঙ্গু হলো ব্রেক বোন ফিভার বা হাড়ভাঙা জ্বর। হেমোরেজিক ডেঙ্গুর কারণে হয় রক্তক্ষরণ। এ ধরনের রোগীর প্লাটিলেট কমে যায়, তাই দ্রুত হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়। ডেঙ্গু শক সিনড্রোম খুব মারাত্মক, এতে মৃত্যুও হতে পারে। ডেঙ্গু শক সিনড্রোমে দেখা দেয় পানিশূন্যতা, পালস বেড়ে যায়, রক্তচাপ কমে, শরীর ঠাণ্ডা হয়ে আসে, শ্বাস-প্রশ্বাস দ্রুত হয়, রোগীর মধ্যে অস্থিরতা দেখা দেয়।
রোগ নির্ণয়ের জন্য জ্বর আসার চার-পাঁচ দিন পর এনএস-১ পরীক্ষা করতে হবে। পরবর্তী সময়ে আইজি এম ম্যাক এলাইজা পরীক্ষা করতে হবে। প্লাটিলেটের সংখ্যা এক লাখের নিচে হলে সতর্ক হতে হবে।
ডেঙ্গু শক সিনড্রোম প্রতিরোধে যা করবেন
♦ জীবাণুবাহী মশা নিয়ন্ত্রণ আর কামড় থেকে বাঁচা।
♦ বৃদ্ধির পরিবেশ ধ্বংস করা।
♦ স্থির আর পরিষ্কার পানিতে ডিম পাড়ে, সেগুলো নিধন করা।
♦ বাড়ির ভেতর আর আশপাশ যেন পানি না জমে সেদিকে লক্ষ রাখা।
♦ ভাঙা পাত্র ও টায়ারে জমে থাকা পানি ফেলে দিতে হবে।
♦ টবের নিচে তিন দিনের বেশি যেন পানি জমে না থাকে।
♦ বয়স্ক ও শিশুদের পুরো শরীর ঢেকে রাখার উপযোগী জামা পরাতে হবে।
♦ ঘুমানোর সময় মশারি টানাতে হবে।
♦ জানালায় মসকিউটো নেট লাগাতে হবে।
শিশুদের ডেঙ্গুর লক্ষণ
ঘুম নেই, অস্থির, বিরক্ত করছে, দুর্বল র্যাশ, মাড়ি ও নাক দিয়ে রক্ত ঝরা, ত্বক কালশিটে হয়ে যাওয়া, ২৪ ঘণ্টায় তিনবার বমি, মুখ, জিহ্বা, ঠোঁট শুকনা, প্রস্রাব কমে যাওয়া, চোখ গর্ত, কাঁদলে চোখে জল নেই, ঠাণ্ডা শরীর—এমন কিছু লক্ষ করলে সতর্ক হতে হবে। অবিলম্বে ডাক্তার দেখাতে হবে।
খাবারদাবার
ডেঙ্গু হলে পানিশূন্যতা দেখা দেয়। কমে যায় প্লাটিলেট। প্রচুর পানি ও তরল খাবার খেতে হবে। ডাবের পানি, ফলের রস, দরকার হলে ওরস্যালাইন পান করতে হবে। পেঁপে পাতার রস, নিমপাতা, বেদানা, দই, ব্রকোলি, পরিজ, আদা চা, লেবু, কমলা, টমেটো, জাম, পেঁপে ইত্যাদি দেওয়া যায়। তেলে ভাজা খাবার, প্রক্রিয়াজাত করা খাবার, ঝাল মসলায় রান্না খাবার, চা-কফি এড়িয়ে চলতে হবে।
লেখক : সাবেক অধ্যক্ষ
চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ