গাড়ির শোরুমের মেঝেতে বালতি উপুড় করে ঢালা হয়েছে কয়েন। বেশির ভাগই এক টাকার। কয়েকজন কর্মচারী ঘাম ঝরিয়ে গুনে চলেছেন। কয়েকটি বালতিভরা খুচরা পয়সা নিয়ে প্রায় ৭০ হাজার টাকা দামের স্কুটার কিনতে হাজির এক ছেলে।
ক্রেতা স্কুটার কিনতে টাকা নিয়ে হাজির, কী আর করা! ঘটনাটি ঘটেছে পশ্চিমবঙ্গে।
ছেলেটা একা নয়, তার বন্ধুদের নিয়ে কৃষ্ণনগরের পালপাড়া মোড়ে একটি মোটরবাইকের শোরুমে হাজির হয়েছে। একটি গাড়ি নিয়ে এসেছে তারা। গাড়ির ডিকিতে বেশ কয়েকটি প্লাস্টিকের বালতিতে চকচক করছে কয়েন। এক টাকার স্তূপে মিশে আছে কিছু ৫০ ও ২০ পয়সাও। এই দিয়েই একটা স্কুটার চাই তার!
শোরুমের লোক প্রথমে হতবাক! এত কয়েন গুনবেই বা কে, আর নেবেই বা কে? ম্যানেজার এ নিয়ে ফোন করেন ব্যাংকে। তারাও রাজি হতে চান না। কার সময় আছে ৭০ হাজার টাকার খুচরা নগদ গোনার? কিন্তু ফেরাবেনই বা কী বলে? দেশে চালু মুদ্রা নিতে তারা বাধ্য। অতএব, বেজার মুখেই ম্যানেজারকে হ্যাঁ-সূচক ঘাড় নাড়তেই হয়। ছেলেদের দল মহা-উৎসাহে শোরুমের মেঝেয় বালতি উপুড় করে দেয়।
ক্রেতার নাম রাকেশ পাঁড়ে। তার বাড়ি নদিয়ার ভীমপুরের গোবরাপোতা মাছবাজার এলাকায়। তার বাবা ভুল্লুর পাঁড়ে মারা গিয়েছেন রাকেশ ছোট থাকতেই। মা ধুলু পাঁড়ে ভিক্ষা করে দুই ছেলেকে মানুষ করেছেন। বড় ছেলে শ্বশুরবাড়িতে থাকেন, মায়ের সঙ্গে তেমন যোগাযোগ নেই। রাকেশ ছোট। কলকাতার একটি ম্যানহোলের লোহার ঢাকনা তৈরির কারখানায় খুবই সামান্য বেতনে কাজ করেন তিনি। নিজেরই ভিক্ষার ঝুলি ঝেড়ে কয়েন জমিয়েছিলেন মা।
এসব কয়েন ছেলের হাতে দিয়ে বলেছেন, যা বাপ, স্কুটার কিনে শখ মিটিয়ে নে। লাজুক হেসে রাকেশ বলেন, আসলে কী জানেন তো, আমার চেয়েও মায়ের বেশি শখ যে ঘরে একটা স্কুটার থাক।
শুধু এক টাকার কয়েন কেন? রাকেশ বলেন, অন্য সব কয়েন মা খরচ করে। শুধু এক টাকার কয়েন জমায়। আমাদের এলাকায় ছোট এক টাকার কয়েন কেউ নিতে চায় না। কিন্তু তারও সন্দেহ ছিল, দোকান কি এত কয়েন নেবে? খেদিয়ে দেবে না তো? বন্ধুদের জিজ্ঞাসাও করেন। তারা ইন্টারনেট ঘেঁটে জানান, সদ্য না কি তামিলনাড়ুতে একজন স্রেফ খুচরো দিয়ে মোটরবাইক কিনেছেন। রাকেশ পারবে না কেন?
শোরুমের ম্যানেজার গৌরব বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, প্রথমে বুঝতে পারছিলাম না, এত খুচরা নিয়ে কী করব। আমাদের ব্যাংকও নিমরাজি ছিল। কিন্তু এগুলো তো অচল টাকা নয়। নেব না বলি কী করে? সংশ্লিষ্ট বেসরকারি ব্যাংকের ব্রাঞ্চ ম্যানেজার কৌস্তভ সিংহ অবশ্য এই বিষয়ে কথা দিতে রাজি হননি। তবে নদীয়া ব্যাংকের প্রধান ম্যানেজার তপু দত্ত বলেন, ছোট এক টাকার কয়েন অচল নয়। সবাই তা নিতে বাধ্য। সে কোনো ব্যাংকই হোক বা বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান।
সেই কয়েন গুনতে বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামল, গুনতি চলছেই। ‘ভিক্ষার ধন’ গোনা হচ্ছে আর রাকেশ স্বপ্ন দেখছে, কখন মাকে পেছনে বসিয়ে স্কুটার ছোটাবে!
সূত্র : আনন্দবাজার ।