সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের বিশেষ ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেছেন, দেশের বাজেট এখন অনাথ আর আইএমএফ তার পালক পিতা। আইএমএফ যখন কোনো দেশে কর্মসূচি নিয়ে যায়, তখন সেই দেশের অর্থনীতির ওপর এক কর্তৃত্ব আরোপ করে বা
আরোপের চেষ্টা করে। সোমবার ‘আইএমএফের সময়কালে অসুবিধাগ্রস্ত মানুষের কথা জাতীয় বাজেটে কীভাবে প্রতিফলিত হতে পারে’ শীর্ষক সংলাপে ড. দেবপ্রিয় এসব কথা বলেন। বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে সিপিডি-নাগরিক প্ল্যাটফরম এ সংলাপের আয়োজন করে। এডভোকেট সুলতানা কামাল এতে সভাপতিত্ব করেন। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান। এ ছাড়া সংলাপে বক্তব্য রাখেন সিপিডি’র বিশেষ ফেলো অধ্যাপক ড. মোস্তাফিজুর রহমান, বিএনপি’র সহ-আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক ও সাবেক সংসদ সদস্য ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানা, অর্থ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সদস্য রানা মোহাম্মদ সোহেল, এমপি, সাবেক এনবিআর চেয়ারম্যান আবদুল মজিদ প্রমুখ। সংলাপে প্রারম্ভিক বক্তব্য উপস্থাপন করেন সিপিডি’র নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন।
ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, আইএমএফ যখন কোনো দেশে কর্মসূচি নিয়ে যায়, তখন অনেক সময় সে দেশে বৈষম্য বেড়ে যায়। তারা যেসব শর্ত দেয়, তার কারণেই এটি হয়।
এমনকি আইএমএফের নিজস্ব গবেষণায় এটা উঠে এসেছে।
আইএমএফ বাংলাদেশকে যে ৪৭০ কোটি ডলার ঋণ দিচ্ছে, তার শর্তের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে ভর্তুকি হ্রাস। এ প্রসঙ্গে ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, ভর্তুকি অনেক সময় ভালো হয়, আবার খারাপও হয়। বিদ্যুৎ খাতে যে বিপুল পরিমাণে ক্যাপাসিটি চার্জ দেয়া হচ্ছে, তা দিয়ে সার ও ডিজেলের মতো খাতেও ভর্তুকি বাড়ানো সম্ভব।
এ ছাড়া আইএমএফ বাড়তি কর আদায়ের কথা বলেছে। ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, এর সঙ্গে দ্বিমত করার সুযোগ নেই। কিন্তু কাদের কাছ থেকে সেই কর আদায় করা হবে, সেটাই বড় কথা। এ ছাড়া দেশে কর আদায়ের আদর্শ ব্যবস্থা নেই বলে অভিযোগ করেন তিনি।
ড. দেবপ্রিয় মনে করেন, দেশের অনেক মানুষ উত্তরাধিকারসূত্রে বিপুল সম্পদ লাভ করছেন। সেখান থেকে কর আদায় করা উচিত। ব্যাংকের সুদহার উন্মুক্ত বা বাজারের ওপর ছেড়ে দেয়ার কথা বলেছে আইএমএফ। মূল্যস্ফীতির সঙ্গে সমন্বয় করে এটা করাই উচিত। সেই সঙ্গে তিনি সতর্ক করে দিয়ে বলেন, দেশে সুদহার বৃদ্ধির অভিঘাত পড়ে মূলত এসএমই খাতে, সেদিকেও খেয়াল রাখা উচিত।
সরকারের খাদ্যবান্ধব কর্মসূচি অনেক সময় প্রচারের অভাবে গরিব মানুষের নজরে আসে না। সে জন্য তারা সেগুলোর সুবিধা নিতে পারেন না। এ ছাড়া খাদ্য সহায়তার জন্য যত কার্ড দেয়া হয় তা অপ্রতুল বলে অভিযোগ করেন ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য।
চালের কর্মসূচির বিষয়ে দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, সরকারের পক্ষ থেকে ১৫ টাকা কেজিতে ৩০ কেজি চাল দেয়ার কর্মসূচি নিয়ে সবাই অবগত নয়। এটা কীভাবে কাজ করছে আমরা দেখেছি। আমরা দেখেছি, চাহিদামতো চালের সরবরাহ নেই। অনেক চালের বস্তা ওজনে কম, মুখ খোলা। চালের মান ভালো না। পরিমাণে দেয়া হয় কম। গরিব মানুষের সঙ্গে সংযোগ হয়নি। তিনি বলেন, সংখ্যালঘু উর্দু ভাষাভাষী মানুষ দেশে বসবাস করেন। এসব মানুষসহ অসুবিধাগ্রস্ত মানুষের জন্য বেশি বরাদ্দ দিতে হবে।
আইএমএফ কর্মসূচি বাস্তবায়ন প্রসঙ্গে ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, যাদের জন্য এই আইএমএফ কর্মসূচি নেয়া হয় তাদের সঙ্গে কথা বলতে হবে। তাদের প্রতিনিধি ও নাগরিক সমাজের সঙ্গে কথা বলতে হবে। এদের মতামত না নিয়ে আইএমএফ কর্মসূচি বাস্তবায়ন করলে বাংলাদেশ আরও একটি বৈষম্যপূর্ণ দেশে পরিণত হবে। তিনি জানান, যাদের জন্য আইএমএফের ঋণ নেয়া, তাদের সঙ্গে অথবা তাদের কল্যাণে যারা চিন্তা করে সেসব প্রতিনিধিদের সঙ্গে কথা বলা জরুরি। তিনি বলেন, বাংলাদেশে আগে থেকেই বিভিন্ন ক্ষেত্রে বৈষম্য রয়েছে। এখন আইএমএফের শর্ত পরিপালনে প্রয়োজনীয় খাতে ভর্তুকি তুলে দেয়া হলে এ বৈষম্য আরও বেড়ে যেতে পারে।
তবে সিপিডি’র এমন বক্তব্যের কড়া জবাব দিয়েছেন পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান। তিনি বলেন, বাজেটের জন্য আইএমএফের কাছে সরকার নির্ভরশীল নয়, তারা ঋণ দিতে কোনো শর্ত দেয়নি। তবে কিছু রিকোয়ারমেন্ট দেয়, যেমন- ঋণে সুদ কতো, কতো বছরে পরিশোধ করবো- এসব। সংকটের এ সময়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ে কাজ করেছে সরকার। তবে দেশে প্রকল্প মানেই দালান নির্মাণ- এই সংস্কৃতি থেকে বের হতে হবে।
মন্ত্রী বলেন, আইএমএফের সঙ্গে বাজেটের সম্পর্ক কী? তারা সাইড অ্যাক্টর, বাজেট আমাদের নিজস্ব ব্যাপার। তবে আইএমএফের কিছু শর্ত থাকে। প্রয়োজনে হাত পাতি, দেয়ার দায়িত্ব আইএমএফের। অনেকে বলে দাতাগোষ্ঠী, এ শব্দের আমি ঘোরবিরোধী। কারণ তারা উন্নয়ন সহযোগী, আমরা ঋণ নিয়ে থাকি এবং সুদ আসলে পরিশোধ করি। বাজেটে উন্নয়ন সহযোগীদের অবদান মাত্র ২ শতাংশ।
এমএ মান্নান বলেন, আইএমএফ কোনো শর্ত দেয়নি, যা দিয়েছে তা শর্ত নয়। এগুলোকে শর্ত বলা ঠিক নয়। বলা যেতে পারে রিকোয়ারমেন্ট। দারিদ্র্য প্রসঙ্গে এমএ মান্নান বলেন, সাদাকে সাদা, কালোকে কালো বলাই ভালো। আমি ব্যক্তিগতভাবে বিশ্বাস করি আমাদের দরিদ্ররা বঞ্চিত। পদ্ধতিগতভাবে তারা বছরের পর বছর বঞ্চিত হচ্ছে। আমি গ্রামে যাই সরকারি মালামাল নিয়ে, এগুলো কোথায় যায় জানি না। এটা খুঁজে বের করাও কঠিন।
অর্থ পাচার নিয়ে পরিকল্পনামন্ত্রী আরও বলেন, ‘হুন্ডির সঙ্গে পারি না। আর রিজার্ভ নিয়ে বাড়াবাড়ি করি না। রিজার্ভ বাড়বে, কমবে- এটাই স্বাভাবিক। ইদানীং যেহেতু পরিমাণটা বেড়ে গিয়েছিল, তাই চোখে পড়েছে বেশি। আগে তো কেউ খবরও রাখতেন না।’
পরিকল্পনামন্ত্রী বলেন, বড় কর্মকর্তার (অফিসার) বড় গাড়ি, বড় বাড়ি- এসব জায়গায় পরিবর্তন আনতে হবে। এখন সব ক্ষেত্রে কৃচ্ছ্রসাধন চলছে।