Saturday, July 27, 2024
spot_img
Homeনির্বাচিত কলামবাইরের মানুষ, ভেতরের মানুষ

বাইরের মানুষ, ভেতরের মানুষ

পৃথিবীতে কিছু কিছু মানুষ আছে, যারা সারা জীবন দিয়েই যায়, বিনিময়ে কিছুই পায় না। সবচেয়ে অদ্ভুত বিষয় হলো, এই মানুষগুলো যে নীরবে নিভৃতে ত্যাগ করে চলেছে তারা তা নিজেরাও বুঝতে পারে না। কিংবা বুঝতে পারলেও তাতে কী আসে যায়! এ জীবন তো তাদের নিজেকে তিলে তিলে ক্ষয় করে অন্যদের জীবনকে গড়ে তোলার কঠিন তপস্যা। যে জীবনের ঝলমলে আলোয় সে মানুষটা থাকে না, বরং অন্ধকারে অযত্নে পড়ে থাকে সে মানুষটার সরল মনের তরল আকুতি।

সে আকুতিতে সে মানুষটা থাকে না, সে আকুতিতে ত্যাগের আগুনে পুড়তে পুড়তে ঝলসানো মানুষটা থাকে। অথচ কী নির্মম ট্র্যাজেডি, তাদের এ ত্যাগের মূল্য স্বার্থপর পৃথিবীর রঙিন মানুষ বুঝতেও পারে না, জানতেও পারে না! মানুষ তো নামেই মানুষ, না আছে কৃতজ্ঞতাবোধ, না আছে মানুষের প্রতি ভালোবাসা, মায়া, মমতা। যা আছে তাতে মানুষ নেই, একটা অন্তঃসারশূন্য অস্তিত্ব আছে। সে অস্তিত্বের ভিতরে স্বার্থের নাটক আছে। লোকদেখানো অভিনয়ের অতিমাত্রার আদিখ্যেতা আছে। সেখানে মানুষ যতটা না মানুষ তার থেকেও বেশি অভিনেতা। সে অভিনেতারা স্বার্থ উদ্ধারের জন্য ত্যাগী মানুষটাকে ব্যবহার করে, তারপর স্বার্থ ফুরালে ত্যাগী মানুষটাকে আঁস্তাকুড়ে ছুড়ে ফেলে দেয়।

এভাবে ত্যাগী মানুষরা প্রতিদিন নিঃস্ব হয়, রিক্ত হয়, একটার পর একটা আঘাতে জর্জরিত হয়, তারপরও মুখের হাসিটা মুখেই লেগে থাকে। বুকে চেপে থাকা বাষ্পরুদ্ধ কান্নাগুলো হাসির মধ্যে ডুবে গিয়ে কখন যে হারিয়ে যায়, সেটা হাসির মধ্যে জমে থাকা অদৃশ্য কান্নাটা জানে। যে কান্নাটার চিৎকার সে মানুষটা বোঝে, অন্য কেউ আর বোঝে না। কারণ বোবা কান্না কখনো কারও কানে পৌঁছে না। এর বাইরে খুব অদ্ভুত একটা দর্শন ও মনস্তত্ত্ব মানুষের মধ্যে কাজ করে, যেটা না করলেই হয়তো ভালো হতো।

মানুষ তার চোখে অভিনেতা দেখে, লেখক দেখে, শিল্পী দেখে, বিজ্ঞানী দেখে, চাকরিজীবী দেখে, সম্পর্ককে দেখে, অর্থনীতিবিদ দেখে, রাজনীতিবিদ দেখে অথচ তাদের ভিতরের মানুষটাকে কখনো দেখে না। আবার মানুষ তাদের সৃজনশীলতাকে বুঝতে পারলেও অনেক সময় তার মূল্যায়ন করতে পারে না। কারণ তখন মানুষ অন্ধ হয়ে যায়, সে অন্ধত্বে মানুষ কেবল নিজেকে দেখে, অন্যদের দেখে না।

চার্লি চ্যাপলিন বিখ্যাত অভিনেতা, যিনি অভিনয় দিয়ে সারা পৃথিবীর মানুষকে হাসিয়েছেন; কিন্তু নিজে ভেতরে ভেতরে কেঁদেছেন সারাটা জীবন। সে কান্নাটা স্বার্থপর মানুষ কখনো দেখেনি, দেখার চেষ্টা করেনি। বাণিজ্যিক পৃথিবীর মানুষ চার্লি চ্যাপলিনের মতো অভিনেতাকে বাজারের পণ্য বানিয়ে হেসেছে অনেক। অথচ নিজেকে অভিনয়ে বিলিয়ে দিয়ে যে মানুষটা দিনের পর দিন ত্যাগের মন্ত্র দ্বারা তাড়িত হয়েছে তার সে ত্যাগকে মানুষ টাকার অঙ্কে পরিমাপ করলেও জীবনবোধের গভীরতা দিয়ে পরিমাপ করেনি। তার অভিনয়কে মানুষ দেখেছে, মানুষ হিসাবে তার আত্মত্যাগকে দেখেনি। তার জীবনের পেছনের গল্পগুলো কেউ কান পেতে শুনেনি। নিজে দুঃখের আগুনে পুড়েছিলেন বলেই মানুষকে সুখের আনন্দে ভাসিয়েছেন।

নিজের ভেতরের অপূর্ণতাকে আড়াল করে মানুষের পৃথিবীতে জোকার সেজেছেন, নিজের ভেতরের মানুষটাকে সারা জীবন অদৃশ্য রেখে মানুষের বিনোদনের উপাদানে পরিণত হয়েছেন। হয়তো মানুষের কাছে মানুষ হিসাবে তার কোনো মূল্য ছিল না, মূল্য ছিল তার নির্বাক অভিনয়ের। সে অভিনয় ও অভিনেতার বাইরের মানুষটাকে কখনো স্বার্থপর মানুষ অন্তর দিয়ে অনুভব করেনি। অভিনয় একটা ত্যাগ, অভিনেতা একজন ত্যাগী মানুষ। সেটা বোঝার মতো শক্তি বাস্তব জীবনের অতি অভিনেতাদের মধ্যে কখনো জন্ম নেয় না। নিজের হাসিকে কান্নায় ডুবিয়ে চার্লি চ্যাপলিন বলেছেন, আমি বৃষ্টিতে হাঁটতে ভালোবাসি, কারণ তখন কেউ আমার কান্না দেখতে পায় না।

এভাবেই অবলীলাক্রমে নিজের ভিতরের মানুষটাকে নিজে বারবার দেখেছেন, খুব সহজ জীবনবোধ দিয়ে কঠিন সত্যের ভিতরের সত্যকে দেখে চোখ কান্নায় ভিজে এলেও বোকার মতো হেসেছেন। কখনো বলেছেন, আমার দুঃখ-কষ্টগুলো কারও কারও হাসির কারণ হয়ে থাকতে পারে; কিন্তু আমার হাসিগুলো যেন কখনোই কারও দুঃখের কারণ হয়ে না দাঁড়ায়। আবার কখনো বলেছেন, আমার সব থেকে ভালো বন্ধু হলো আয়না, কারণ আমি যখন কাঁদি তখন সে হাসে না।

জীবনের মাঝে জীবনকে হাতড়িয়ে বেড়িয়েছেন ক্রমাগত, কূল-কিনারা পাননি। আনমনে বলেছেন, আমার কষ্ট ঠোঁটও জানে না, তাই সে সবসময় হাসে। মঞ্চ ও সিনেমা কাঁপানো জীবন্ত অভিনেতার শিল্পকে দেখেছে মানুষ অথচ ঘুমের মধ্যে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করা চার্লি চ্যাপলিন নামের ত্যাগী ও সাধারণ মানুষটাকে কখনো খুঁজেনি কেউ। হয়তো এটাই পৃথিবীর নিয়ম। যেখানে মানুষের চেয়ে মানুষের মুখোশের দাম অনেক বেশি।

সত্যজিৎ রায়ের মনস্তাত্ত্বিক ও নিরীক্ষাধর্মী চলচ্চিত্র ‘নায়ক’। অদ্ভুত বিষয় হলো, এই সিনেমায় নায়কের ভূমিকায় ছিলেন বাংলা চলচ্চিত্রের মহানায়ক উত্তম কুমার, যিনি নায়ক হয়ে নায়কের ভূমিকায় অভিনয় করেছেন, কিন্তু অভিনয় করতে গিয়ে নিজের ভিতরের অচেনা মানুষটাকে খুঁজতে গিয়েও হারিয়ে ফেলেছেন। সাধারণ মানুষ ভাবে, সিনেমার নায়করা বুঝি আসলেই খুব সুখী। হয়তো সুখী, হয়তো সুখী না। সুখ থাকলেও মানুষ সুখী হয় না, আবার সুখ না থাকলেও মানুষ সুখী হয়।

পৃথিবীতে অনেককিছুই গাণিতিক সূত্র মেনে পরিমাপ করা গেলেও সুখকে পরিমাপ করা যায় না। কারণ সবকিছু অঙ্কের নিয়ম মেনে চলে না। মানুষ নায়ক নামের অভিনেতাকে খোঁজে, অথচ অভিনয় করা মানুষটাকে খোঁজে না। পৃথিবীর আর আট-দশটা মানুষের মতো তারও যে একাকিত্ব, অনুশোচনাবোধ, অভাববোধ, পাওয়া না পাওয়ার যন্ত্রণা, সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা থাকতে পারে, পর্দার বাইরের মানুষেরা তা কোনোভাবেই বুঝতে চায় না। নায়করাও যেন কেমন নিজেদের ইমেজ সাধারণ মানুষের কাছে ধরে রাখতে তার ভেতরের মানুষটাকে দেখাতে ভয় পায়, অথচ এই না দেখানোর অসহায়ত্বটা তাদের কুরে কুরে খায় আমৃত্যু। এই সিনেমার নায়ক অরিন্দম ও অনুসন্ধানী সাংবাদিক অদিতির সংলাপের মধ্য দিয়ে বিষয়টি দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে এভাবেই-

অদিতি : এই যে আপনার দারুণ খ্যাতি, এটা কেমন লাগে?

অরিন্দম : বেশ তো, ভালোই তো!

অদিতি : কিন্তু এই যে বেশি করে পাওয়া, এর মধ্যে একটা ফাঁক, একটা অভাববোধ, কোনো রিগ্রেটস নেই?

অরিন্দম : দেখুন মিস সেনগুপ্তা, আমাদের খুব বেশি কথা বলতে নেই। আমরা ছায়ার জগতে বিচরণ করি তো, কাজেই আমাদের রক্ত মাংসের জ্যান্ত শরীরটা জনসাধারণের সামনে খুব বেশি করে তুলে না ধরাই ভালো। কী বুঝলেন?

এ চলচ্চিত্রে একটি স্বপ্নদৃশ্যের মাধ্যমে দেখানো হয়েছে যে নায়ক ক্রমাগতভাবে টাকার চোরাবালিতে ডুবে যাচ্ছে। ডুবন্ত নায়ক সত্তা নিজেকে বাঁচানোর আকুতিতে অস্থির হয়ে উঠেছে। অথচ তাকে বাঁচানোর মতো কোথাও কেউ নেই। টাকার অতি মোহে অভিনয়ের মতো সৃজনশীলতাকে নায়ক যখন পণ্য বানিয়ে দেয়, তখন নায়ক ও সাধারণ মানুষের সম্পর্কের মধ্যে দেওয়াল তৈরি হয়। ত্যাগের মন্ত্রণাটা তখন মুখ থুবড়ে পড়ে থাকে মাটিতে। অভিনয়ে তখনো ত্যাগ থাকে; কিন্তু অভিনেতা তখন স্বার্থপর হয়ে যায়। অভিনেতাদেরওবা দোষ কী? সারা পৃথিবীর মানুষ তো এখন ত্যাগের মূল্য বুঝে না, মানুষ বুঝে কে কতটা ক্ষমতাবান, কে কত টাকার মালিক, কার কতটা বিত্ত-বৈভব। অথচ সে ক্ষমতা, টাকা বা বিত্ত-বৈভবের উৎসটা কেউ জানতে চায় না। মানুষ এভাবেই ক্রমাগত ক্ষমতা আর টাকার দাসে পরিণত হয়; কিন্তু সে সত্যটা সব সময় গোপন রাখে। দাসের সংখ্যা এভাবেই বাড়তে বাড়তে মানুষের সংখ্যার উপর আধিপত্য বিস্তার করে। ত্যাগী মানুষদের ত্যাগের সুবিধাটা মানুষ কড়ায়গণ্ডায় বুঝে নিলেও তার ভিতরের মানুষটাকে বোঝার চেষ্টা করে না কেউ। পর্দার অভিনেতারা আগে মানুষ তারপর অভিনেতা হয়। অথচ পর্দার বাইরের মানুষরা সবসময় অভিনেতা হয়, মানুষ হতে ভয় পায়।

ভারতের সংগীতশিল্পী লতা মঙ্গেশকর সারা পৃথিবীকে তার সংগীতের জাদুকরী শক্তিতে মোহিত করলেও মানুষ তার ভিতরের মানুষটাকে খোঁজেনি কখনো। মানুষ তার সংগীতকে ভালোবেসেছে, তার শিল্প সত্তাকে ভালোবেসেছে অথচ তার ত্যাগের মতো অনুভূতিশীল বিষয়টিকে কখনো কী বুঝেছে? লতা মঙ্গেশকর সংগীতশিল্পী হিসাবে যতটা না সফল, তার থেকেও বেশি সফল ত্যাগী মানুষ হিসাবে। ত্যাগী মানুষ হতে হলে বিখ্যাত মানুষ হওয়ার প্রয়োজন নেই, ত্যাগী মানুষ হতে হলে মানুষের ভিতরে সাধারণ মানুষের একটা সাদা মন থাকলেই চলে। তেমন একটা সাধারণ মানুষের সাদা মন ছিল লতা মঙ্গেশকরের। বাবার মৃত্যুর পর সংসারের হাল ধরেছেন। নির্দয় পৃথিবীর বিরুদ্ধে একাই লড়েছেন। কেউ কেউ বলেন প্রেম এসেছিল তার জীবনে, তবে নিজের ব্যক্তিত্ব, পরিবার ও কাজের জন্য ত্যাগকে বেছে নিয়েছিলেন তিনি। একাকিত্বের সঙ্গে লড়েছেন অবিরত অথচ একাকিত্ব তার কাছে হার মেনেছে। মানুষ তার সংগীত জীবনের সাফল্যকে দেখতে পেলেও তার জীবনের পেছনের গল্পের সাধারণ মানুষ হয়ে ওঠার ত্যাগের সৌন্দর্যকে কখনো দেখেনি।

পৃথিবীর মানুষ সবটাই দেখুক, বাহিরটা দেখুক, ভিতরটা দেখুক। ত্যাগের ভিতরে নিভৃতে গড়ে ওঠা সাধারণ মানুষটাকে দেখুক। মানুষের চোখ থেকে বড় হয়ে উঠুক মানুষের অনুভূতিশক্তি, চিন্তা ও বিবেক। সব হারিয়ে মানুষের মধ্যে জাগ্রত হোক ত্যাগের জয়গান।

ড. মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান চৌধুরী : অধ্যাপক, ঢাকা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, গাজীপুর

RELATED ARTICLES
- Advertisment -
Google search engine

Most Popular

Recent Comments