সিলেট, সুনামগঞ্জ ও কুড়িগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বন্যা পরিস্থিতির উন্নতির সংবাদ স্বস্তিদায়ক। তবে উদ্বেগের বিষয় হলো, বন্যার পানি কমলেও বন্যাদুর্গতদের দুর্ভোগ হ্রাস পাচ্ছে না বরং কেথাও কোথাও দুর্ভোগ আরও বেড়েছে, যা মোটেই কাম্য নয়। জানা গেছে, বন্যা উপদ্রুত বিভিন্ন অঞ্চলে, বিশেষ করে দুর্গম এলাকায় খাবার, বিশুদ্ধ পানি ও স্বাস্থ্যসেবার চরম সংকট দেখা দিয়েছে। সেখানে মানুষজন অনাহার-অর্ধাহারে দিন কাটাচ্ছেন। শিশুরা প্রয়োজনীয় খাদ্যের অভাবে অপুষ্টিতে ভুগছে। এছাড়া নেই গো-খাদ্য। এতে গবাদি পশু-পাখি নিয়েও বিপাকে পড়েছেন অনেকে। অন্যদিকে বন্যার পানি নেমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কোথাও কোথাও তীব্র নদীভাঙন দেখা দিয়েছে। এতে অনেকেই ফসলি জমিসহ বসতবাড়ি নদীগর্ভে বিলীন হওয়ার আশঙ্কায় ভুগছেন। বস্তুত সব মিলিয়ে বন্যাদুর্গত এলাকার মানুষজন যে চরম অনিশ্চয়তার মধ্যে দিনযাপন করছেন, তা বলাই বাহুল্য। বন্যা উপদ্রুত এলাকার মানুষ যাতে দ্রুত ক্ষয়ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে পারে, সেজন্য তাদের সর্বাত্মক সহযোগিতা করতে হবে। এক্ষেত্রে সরকারের পাশাপাশি ব্যাংকসহ অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানের বিশেষ কর্মসূচি গ্রহণ করে উপদ্রুত এলাকার মানুষের পাশে দাঁড়ানো উচিত।
যে কোনো দুর্যোগে সবার আগে মানবিক বিপর্যয়ের দিকগুলোর প্রতি গুরুত্ব দেওয়া জরুরি। এজন্য বন্যাকবলিত এলাকাগুলোয় অসহায় মানুষ যাতে পর্যাপ্ত পরিমাণে খাদ্য, পানীয় ও আশ্রয় পায়, এ ব্যাপারে বিশেষ যত্নবান হওয়ার পাশাপাশি তাদের স্বাস্থ্যঝুঁকির বিষয়েও নজর দেওয়া উচিত। বন্যা-পরবর্তী সংস্কার ও পুনর্বাসনের ব্যাপারেও একই কথা প্রযোজ্য। দুর্গতদের কৃষিকাজে প্রয়োজনীয় সহায়তা প্রদানের পাশাপাশি সহজ শর্তে ব্যাংকঋণের ব্যবস্থা করা দরকার। গত ৫০ বছরে দেশে প্রচুর বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ তৈরি হয়েছে। তবে বাঁধ রক্ষণাবেক্ষণের ক্ষেত্রে সরকার সাফল্যের পরিচয় দিতে পারছে না-এটি একটি বড় সমস্যা। সঠিক ব্যবস্থাপনার অভাব এবং অনিয়ম-দুর্নীতি রোধ করতে না পারাই এর মূল কারণ। কাজেই কেবল বাঁধ দিলেই হবে না; একই সঙ্গে সেগুলোর ব্যবস্থাপনা সঠিক ও দুর্নীতিমুক্ত হতে হবে। নদীর উৎপত্তি থেকে সমুদ্র পর্যন্ত নদ-নদীগুলোর দখল ও দুষণমুক্তকরণ, শাসন এবং বাঁধ নির্মাণসহ সমস্ত ব্যবস্থাপনা যদি আমরা একসঙ্গে সঠিক ও দুর্নীতিমুক্তভাবে করতে পারি; তাহলে বন্যার প্রকোপ হ্রাস পাবে বলে আশা করা যায়।
বন্যার সময় সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে ত্রাণসামগ্রী বিতরণ এক ধরনের রেওয়াজে পরিণত হয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় এবারও এ ধরনের কার্যক্রম চোখে পড়েছে। তবে এ ধরনের সাহায্য-সহযোগিতা বন্যাকবলিত মানুষের জীবনে স্থায়ী কোনো প্রভাব ফেলে না বললেই চলে। এ অবস্থায় প্রায় প্রতিবছর ছোট-বড় বন্যায় আমাদের ক্ষয়ক্ষতি বিবেচনায় নিয়ে এর প্রকোপ কমিয়ে আনতে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ, সর্বোপরি বন্যাকে স্থায়ীভাবে জয় করার উদ্যোগ নেওয়া জরুরি। এ লক্ষ্যে নদ-নদীগুলোর নাব্য বাড়াতে হবে সর্বাগ্রে। আমাদের অবিবেচনাপ্রসূত কর্মকাণ্ড ও অদূরদর্শিতায় একসময়ের খরস্রোতা নদীগুলো আজ জীর্ণ-শীর্ণ অথবা মরণাপন্ন অবস্থায় উপনীত হয়েছে। নদ-নদীগুলোকে অবশ্যই মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করতে হবে। অন্যদিকে আন্তর্জাতিক নদ-নদীগুলোর ব্যাপারে আমাদের অবস্থান ও দাবি আরও জোরালো করার লক্ষ্যে শক্ত কূটনৈতিক ভূমিকা গ্রহণ করতে হবে। বাংলাদেশ হচ্ছে ভাটির দেশ। উল্লেখযোগ্য নদীগুলোর উৎস দেশের ভূ-সীমানার বাইরে। অভিন্ন নদীগুলোর গতি-প্রবাহ স্বাভাবিক রাখার ব্যাপারে প্রতিবেশী দেশ, বিশেষ করে ভারত ও নেপালের সঙ্গে এমন গঠনমূলক উদ্যোগ নেওয়া উচিত, যাতে তা কার্যকর ও ফলপ্রসূ হয়।