Saturday, July 27, 2024
spot_img
Homeবিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবদলে যাচ্ছে ইন্টারনেট দুনিয়া

বদলে যাচ্ছে ইন্টারনেট দুনিয়া

ইন্টারনেটকে চালায় গুগল—এমন একপেশে কথাটাও কিন্তু খুব একটা ভুল নয়। প্রতিবার গুগল যখন তাদের সার্চ অ্যালগরিদম বদলায়, পুরো ইন্টারনেটেই পড়ে তার প্রভাব। আর তাতে কতটুকুই বা বদলে যাবে ইন্টারনেট দুনিয়া? সেই উত্তরই খোঁজার চেষ্টা করেছেন মোহাম্মদ তাহমিদ

ব্যবহারকারীরা যেমন কাঙ্ক্ষিত তথ্য ও সেবা খোঁজার জন্য ব্যবহার করে গুগল সার্চ, ওয়েবসাইটের মালিকরাও তার ওপর নির্ভর করে ভিজিটর ট্রাফিকের জন্য। প্রতিবার গুগল যখন তাদের সার্চ অ্যালগরিদম বদলায়, পুরো ইন্টারনেটেই পড়ে তার প্রভাব।

এ বছর গুগল তাদের সার্চ সিস্টেমে এনেছে আমূল পরিবর্তন। এর ভালো এবং খারাপ—দুই ধরনের প্রভাবই সামনে দেখা যাবে। আমাদের চিরচেনা ইন্টারনেটে আসতে যাচ্ছে বিশাল পরিবর্তন, যার গোড়ায় আছে গুগল এবং তাদের এআই, জেমিনি। বরাবরই গুগল তাদের সার্চ অ্যালগরিদম কিভাবে কাজ করে সে বিষয়ে চরম গোপনীয়তা ধরে রেখেছে।
তবে সদ্যই প্রায় আড়াই হাজারেরও বেশি নথিপত্র অনলাইনে ফাঁস হয়ে যাওয়ার পর অবশেষে গুগল ঠিক কিভাবে সার্চ রেজাল্ট মূল্যায়ন করে, তার কিছুটা ধারণা পাওয়া যাচ্ছে।গুগল সার্চের মূল্যায়ন

মার্চের ১৩ তারিখ ভুলবশত গুগলের কোড গুছিয়ে রাখার বট ইয়োশি-কোড-বট গুগল কনটেন্ট এপিআই ওয়্যারহাউসের গোপনীয় আড়াই হাজারেরও বেশি ডকুমেন্ট গিটহাবে পাবলিক অ্যাকসেসসহ আপলোড করে ফেলে। পরে সেসব দস্তাবেজ নিয়ে অনলাইন সার্চ অডিয়েন্স রিসার্চ কম্পানি স্পার্কটোরোর সহপ্রতিষ্ঠাতা র‌্যান্ড ফিশকিন এবং আইপুলর্যাংকের প্রধান নির্বাহী মাইকেল কিং গবেষণা করেন, যার ফলাফল প্রকাশিত হয়েছে কিছুদিন আগে। শুরুতে গুগল বিষয়টি নিয়ে মুখ খুলতে রাজি না হলেও তারা পরে স্বীকার করেছে, ডকুমেন্টগুলো ভুয়া নয়।

ওয়েবসাইট নিয়ে যারা কাজ করে তারা সবাই জানে সার্চ ইঞ্জিন অপটিমাইজেশন বা এসইও কতটা জরুরি। তাই ফিশকিন ও কিংয়ের প্রাপ্ত তথ্যের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে প্রতিটি ওয়েবসাইট ও কনটেন্ট নির্মাতারা।যেহেতু গুগলের কার্যকলাপ মাত্র দুই হাজার ৫০০টি নথিতে  তুলে ধরা সম্ভব নয়, ধরে নেওয়া যেতে পারে গুগল সার্চের ছোট একটি অংশের ক্রিয়াকলাপই ফাঁস হয়েছে। এর মধ্যেই রয়েছে দুই হাজার ৫৯৬টি মডিউল, যার মধ্যে আছে ওয়েবসাইট মূল্যায়নের জন্য ১৪ হাজারেরও বেশি অ্যাট্রিবিউট। তবে সেগুলোর মধ্যে কোনটার ওপর জোর বেশি দেওয়া হয় সেটা জানা যায়নি।

ওয়েবসাইট একবার র‌্যাংকিংয়ে এগিয়ে গেলেই শেষ নয়, ওয়েবসাইটে পরে মানহীন কনটেন্ট যোগ হয়েছে কি না সেটাও খেয়ালে রাখে গুগল, সেটা জানা গেছে।কিছু ক্ষেত্রে ভালোমতো এসইও করা হলেও গুগল ওয়েবসাইটের কনটেন্টকে উল্টো ডিমোটও করে থাকে। ব্যবহারকারীদের ফিডব্যাক, রিভিউ, ভেতরের কনটেন্টে পরিবর্তন বা অ্যাডাল্ট কনটেন্টের অ্যাড সাইটের র‌্যাংকিং ডিমোট করার জন্য দায়ী। প্রতিটি পেজের ২০টি করে হিস্টোরি ব্যাকআপ রাখে গুগল, যাতে র‌্যাংকিংয়ের জন্য একরকম কনটেন্ট দিয়ে পরে সেটা বদলে ফেলার মতো কাজ কেউ করতে না পারে।

ওয়েবসাইটের বিভিন্ন অংশের লিংকে ব্যবহারকারীরা কতটা ক্লিক করছে, কত সময় সাইটে কাটাচ্ছে বা ক্লিক করেই সরে পড়ছে কি না—এসইওর জন্য এসব তথ্য গুরুত্বপূর্ণ, সেটা আগেও ওয়েবমাস্টাররা জানত। এবার ফাঁস হওয়া ডকুমেন্টে বিষয়টি সত্য, তার প্রমাণ পাওয়া গেছে। সঙ্গে গুগলের ‘সাইট অথরিটি’ বলে একটি ফিচার আছে, সেটাও জানা গেছে, যার কাজ একটি ওয়েবসাইটের পুরো অংশের মান একই কি না সেটার র‌্যাংকিং তৈরি করা। সবচেয়ে বড় যে জিনিসটি আজ প্রমাণিত, গুগল সার্চ রেজাল্টের প্রথমে জায়গা পেতে হলে নিজস্ব ব্র্যান্ড শক্ত করতেই হবে। ইন্টারনেটের বাইরে যদি ব্র্যান্ডের অবস্থান শক্ত না হয়, তাহলে শুধু এসইও করে সার্চের টপে যাওয়া সম্ভব নয়।

গুগল সার্চে পরিবর্তন

মার্চে গুগল তাদের সার্চ র‌্যাংকিং অ্যালগরিদমে বড়সড় পরিবর্তন এনেছে, যার প্রভাব এর মধ্যেই পড়তে শুরু করেছে ওয়েবসাইটের মালিকদের ওপর। বিগত বছরের সেপ্টেম্বর থেকেই গুগল তাদের অ্যালগরিদমে পরিবর্তন আনা শুরু করেছে। যার ফলাফল, একই সার্চের রেজাল্টে তথ্যভিত্তিক ওয়েবসাইটগুলোর বদলে ফোরাম সাইটের অবস্থান থাকছে ওপরে। যেখানে ‘দ্য ডেস্ক’-এর ট্রাফিক কমেছে প্রায় ৯৯ শতাংশ, সেখানে ‘রেডিট’-এর ট্রাফিক বেড়েছে ১২৭ শতাংশ। নিউ ইয়র্ক টাইমস বা বিবিসির মতো সাইটগুলোরও ট্রাফিক কমে গেছে অর্ধেকেরও বেশি, কিন্তু লিংডইন, ইনস্টাগ্রাম বা কোরা-এর মতো সামাজিক যোগাযোগ বা ফোরামভিত্তিক ওয়েবসাইটের ট্রাফিক বেড়েছে দ্বিগুণেরও বেশি।

এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে গুগলের নামিদামি প্রতিষ্ঠিত ব্র্যান্ডের সাইটের গুরুত্ব বাড়ানো। এর ফলে যারা নিজস্ব ব্লগে লেখালেখি করত বা ছোট টিম নিয়ে যারা মাত্র ওয়েবসাইট তৈরি শুরু করেছে, তাদের জন্য সার্চ র‌্যাংকি বাড়ানো হয়ে গেছে আরো অনেক কঠিন। গুগল বলা যায় প্রকাশনাভিত্তিক ওয়েবসাইটের ওপর যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। সূচারুভাবে সাজানো-গোছানো লেখা ও ভিডিওর বদলে তারা বড় মিডিয়ার কনটেন্ট এবং ফোরামের আলোচনার দিকেই সার্চ ট্রাফিক ধাবিত করছে।

গুগলের সার্চ অ্যালগরিদম যত্ন করে এসইও অপটিমাইজ করে সাজানো সাইটকেও আর সার্চ রেজাল্টে ওপরের দিকে জায়গা না দেওয়ায়, ওয়েব প্রকাশনা বা খবরের ওয়েবসাইটগুলোর মালিকরা পড়েছেন বিপাকে। কয়েক মাসের ব্যবধানে লাভজনক প্রতিষ্ঠান চরম লোকসানের মুখে পড়েছে। চাকরি হারিয়েছেন অনেক লেখক, সম্পাদক, চিত্রশিল্পী ও উপস্থাপক। গুগল এককভাবে ইন্টারনেটের ওপর প্রভাব বিস্তার করায় তাঁদের বিরুদ্ধে মনোপলির মামলাও চলছে।

এদিকে ব্যবহারকারীরাও গুগলের এই পরিবর্তনে খুশি নন। কিছুদিন আগেও একটি মোবাইলের রিভিউ সার্চ করলে সহজেই বিভিন্ন প্রকাশনার লিংক পাওয়া গেলেও এখন সবার ওপরে থাকছে কোরা, রেডিট এবং সোস্যাল মিডিয়ায় চলমান আলোচনার লিংক। এসব জায়গায় থাকা তথ্যের কোনো যাচাই-বাছাই নেই, তাই সঠিক তথ্য সার্চ করে পাওয়াও হয়ে গেছে কঠিন।

 

এআইয়ের প্রভাব এবং ব্যবহারকারীদের অনাস্থা

গুগল সার্চে আর সরাসরি লিংক নয়, বরং এআইয়ের মাধ্যমে জেনারেট করা উত্তর দেখানো শুরু করেছে গুগল। যেটাকে তারা বলছে এআই ওভারভিউ। গুগল জেমিনির মাধ্যমে সেবাটি দেওয়া শুরু করেছে। এখনো বিশ্বের সব দেশে এআই ওভারভিউ চালু হয়নি, তার পরও ফিচারটি নিয়ে চলছে সমালোচনার ঝড়। জেমিনি শুধু ওয়েবসাইট নয়, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে শুরু করে বিভিন্ন ফোরামের পোস্টও তার ডাটাসেট হিসেবে ব্যবহার করে থাকে। সমস্যা হচ্ছে, জেমিনির পক্ষে মজা করে লেখা বিভ্রান্তিমূলক পোস্ট, কটাক্ষ করে লেখা ফোরামের উত্তর বা সরাসরি কৌতুকের জন্য তৈরি লেখাকে আসল তথ্যের থেকে তফাত করা সম্ভব নয়। ফলে রেডিটে দুষ্টামি করে কেউ কোনো প্রশ্নের উদ্ভট উত্তর দিয়ে থাকলেও সেটাকে ধ্রুব সত্য হিসেবেই ধরে নিচ্ছে জেমিনি। তার ফলাফল, গুগল সার্চে উদ্ভট সব উত্তর।

‘পিজ্জায় চিজ আটকাচ্ছে না, কী করা যায়?’ এ প্রশ্নের উত্তরে গুগল এআই ওভারভিউ রেজাল্ট বলছে, ‘চিজের সঙ্গে আঠা মিশিয়ে দিন।’ মজা করে দেওয়া উত্তরটিকেই জেমিনি ভাবছে সঠিক। একজন সার্চ করেছে, ‘যদি দৌড়াতে দৌড়াতে পাহারের কিনারা পার হয়ে যাই, তাহলে কি সঙ্গে সঙ্গে পড়ে যাব নাকি নিচে না তাকানো পর্যন্ত ভেসে থাকব?’ তার উত্তরে সার্চ বলছে, নিচে না তাকানো পর্যন্ত মাধ্যাকর্ষণ কাজ করে না, তাই ভেসে থাকাই স্বাভাবিক। এ ধরনের উদাহরণগুলো হাস্যকর, সহজেই বুঝা যাচ্ছে গুগল ভুল করেছে। সমস্যা হচ্ছে, গুগল যদি জটিল কিছুর উত্তর এমন ভুল দেয়, তখন সেটা হয়তো সহজে বোধগম্য না-ও হতে পারে।

 

আগামীর ইন্টারনেট

প্রকাশনাভিত্তিক ওয়েবসাইটের বদলে ফোরাম তৈরির দিকেই নজর বাড়বে বলে ধারণা করছেন বিশেষজ্ঞরা। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পোস্ট করার ওপর জোর দেবে নতুন ব্র্যান্ডগুলো, অনলাইনে নিজস্ব ওয়েবসাইট থাকার প্রয়োজনীয়তা কমবে। ছোট ছোট স্বাধীন প্রকাশনাগুলো নিরুৎসাহিত হবে, অনেকেই হয়তো আর অনলাইনে কনটেন্ট তৈরি শুরুও করতে চাইবেন না। তাঁরা বড় ব্র্যান্ডের ব্যানারে কর্মী হিসেবেই কাজ করবেন। এদিকে বিভিন্ন পণ্য নির্মাতা ও সেবাদানকারীরা আর রিভিউয়ের দিকে ঝুঁকবেন না, তাঁরা মানুষকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম আর ফোরামে তাঁদের পণ্য ও সেবা নিয়ে আলোচনা করার জন্য ভাড়া করবেন। এভাবে করে বাড়বে ভুয়া রিভিউর সংখ্যা। সবচেয়ে বড় সমস্যা, এআইয়ের উল্টাপাল্টা আচরণে গুগলের ওপরই ব্যবহারকারীদের আস্থা কমে যেতে শুরু করেছে এর মধ্যেই, ভবিষ্যতে হয়তো ইন্টারনেটে নতুন সার্চ জায়ান্টের আবির্ভাবও হতে পারে।

RELATED ARTICLES
- Advertisment -
Google search engine

Most Popular

Recent Comments