শ্বাসতন্ত্রের যাবতীয় রোগের মধ্যে ফুসফুস টিউমার ক্যান্সার সবচেয়ে মারাত্মক ব্যাধি। রোগটির বিভিন্ন ধাপ রয়েছে। শুরুতে শনাক্ত করে চিকিৎসা নিলে জটিলতা এড়ানো যায়। লিখেছেন ইনজিনিয়াস হেলথকেয়ার লিমিটেডের চেয়ারম্যান, আনোয়ার খান মডার্ন মেডিক্যাল কলেজের অধ্যাপক ডা. মো. রাশিদুল হাসান
ফুসফুসের শ্বাসনালি, বায়ুথলি ও এপিথেলিয়াম কোষ থেকে সৃষ্ট টিউমার ক্যান্সার হলো ফুসফুস টিউমার ক্যান্সার বা ব্রংকোজেনিক কারসিনোমা। বিভিন্ন কারণে শরীরের কোষগুলোর ডিএনএ ক্ষতিগ্রস্ত হয় ও অনিয়ন্ত্রিতভাবে দ্রুত অস্বাভাবিক বৃদ্ধি লাভ করে আশপাশের সুস্থ কোষগুলোকে ধ্বংস করে ফেলে। রক্তনালি ও লসিকানালি দিয়ে সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ে। ফুসফুসে যখন এই টিউমার ক্যান্সার তৈরি করে, তখন তাকে প্রাইমারি ফুসফুস টিউমার ক্যান্সার বলে। শরীরের অন্য স্থান থেকে টিউমার ক্যান্সার ফুসফুসে ছড়িয়ে পড়লে তাকে সেকেন্ডারি ফুসফুস টিউমার ক্যান্সার বলা হয়।
ধরন
টিউমার ক্যান্সার কোষের ভিত্তিতে ফুসফুসের টিউমার ক্যান্সারকে স্মল ও নন-স্মল সেল—এই দুই ভাগে ভাগ করা যায়। ভাগগুলো হলো—স্কোয়ামাস, এডিনোকরলিনোমা ও লার্জ সেল।
কারণ
* প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ধূমপান (৮০ শতাংশ ক্ষেত্রে দায়ী)
* তামাকজাত দ্রব্য সেবন, পান-সুপারি, জর্দা ইত্যাদি গ্রহণ
* ঘন ঘন ফুসফুসের সংক্রমণ
* নিকেল, ক্রোমিয়াম ও জৈব পদার্থ, বেনজিন, বেনজোপাইরিন বায়ুর সঙ্গে ফুসফুসে প্রবেশ
* পেট্রোলিয়াম কেমিক্যাল বা রাবার কারখানায় কাজের প্রভাব
* বংশে কারোর এই ক্যান্সার থাকা
* র্যাডন গ্যাস, এসবেস্টসের প্রভাব, বিকিরণ ও অন্যান্য দূষণ
* অন্যের দ্বারা উৎপাদিত ধোঁয়ায় শ্বাস নেওয়া ইত্যাদি।
লক্ষণ
* ঘন ঘন কাশি, ২১ দিনের বেশি কাশি থাকা
* ঘন ঘন বুকে সংক্রমণ, যেমন ব্রংকাইটিস বা নিউমোনিয়া
* কাশির সঙ্গে রক্ত যাওয়া
* শ্বাসকষ্ট
* বুকে কফ জমা হওয়া
* গলার স্বর পরিবর্তন বা স্বর ভেঙে যাওয়া
* অরুচি, খিদে কমে যাওয়া
* কোনো কারণ ছাড়াই ওজন কমে যাওয়া ইত্যাদি।
পরীক্ষা
এক্স-রে : ফুসফুস ক্যান্সার নির্ণয়ের সবচেয়ে প্রয়োজনীয় পরীক্ষা এক্স-রে। যেকোনো ব্যক্তির, বিশেষ করে পঞ্চাশোর্ধ্ব, ধূমপায়ীর দীর্ঘমেয়াদি কাশি হলে অবশ্যই
এক্স-রে করা উচিত।
সিটি স্ক্যান : এক্স-রের চেয়ে আরো সূক্ষ্মভাবে ফুসফুসের ক্ষত ধরা পড়ে সিটি স্ক্যানের মাধ্যমে।
ব্রংকোস্কপি : এর সাহায্যে টিউমার ক্যান্সার টিস্যুর বায়োপসি নিয়ে পরীক্ষা করা হয়।
এফএনএসি : ফুসফুসের ক্ষত থেকে রস নিয়ে ক্যান্সার নির্ণয় করা হয়।
পেট সিটি স্ক্যান : টিউমার ক্যান্সার অন্য কোথাও ছড়িয়ে পড়েছে কি না তা নির্ণয়ের জন্য পেট সিটি স্ক্যান করা হয়ে থাকে।
এ ছাড়া প্লুুরাল ইফ্যুশন, লিম্ফনোড বায়োপসি পরীক্ষায়ও ফুসফুসের ক্যান্সার নির্ণয় হয়।
চিকিৎসা
ফুসফুস টিউমার ক্যান্সারের প্রচলিত চিকিৎসা হলো সার্জারি, কেমোথেরাপি, রেডিওথেরাপি। আরো আধুনিক চিকিৎসা পদ্ধতি আবিষ্কৃত হচ্ছে। সর্বাধুনিক ও অত্যন্ত কার্যকর চিকিৎসা ও মাইক্রোওয়েভ অ্যাবলেশন। যাদের সার্জারি করা যায় না বা করতে চায় না তাদের এ চিকিৎসা দেওয়া হয়। এটি কার্যকর ও ব্যাপক জনপ্রিয়তা ও স্বীকৃতি অর্জন করেছে।
বাংলাদেশে গত চার বছরে ২৮০টি ফুসফুস টিউমার ক্যান্সার চিকিৎসা করেছি। এর মধ্যে ৮৫ শতাংশ রোগী এক বছর ভালো আছে, ৭৫ শতাংশ দুই বছর ভালো আছে, ৬৫ শতাংশ তিন বছর ভালো আছে, ৫৭ শতাংশ চার বছর ভালো আছে।
চিকিৎসা
সার্জারি : ফুসফুস ক্যান্সারের জন্য সার্জারি হলো অন্যতম প্রধান চিকিৎসা। সার্জারি নির্ভর করে ক্যান্সার টিউমারের ধরন, আকৃতি, অবস্থান এবং রোগীর শারীরিক অবস্থার ওপর। ক্যান্সার প্রাথমিক পর্যায়ে থাকলে সার্জারির মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ টিউমার অপসারণ করা যায়। অনেক ক্ষেত্রে অসুখের মাঝামাঝি পর্যায়েও সার্জারি করা হয়। আবার সার্জন সম্পূর্ণ ফুসফুসটিও অপসারণ করতে পারেন।
কেমোথেরাপি : এতে ওষুধ প্রয়োগের মাধ্যমে ক্যান্সার কোষ সংকুচিত বা ধ্বংস করার চেষ্টা করা হয়। তবে অতিরিক্ত বমি ভাব, চুল পড়া, ওজন হ্রাসসহ এর কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া রয়েছে।
টার্গেটেড থেরাপি : টার্গেটেড থেরাপি হলো এক ধরনের ক্যান্সারের চিকিৎসা, যা ওষুধ বা অন্যান্য পদার্থ ব্যবহার করে নির্দিষ্ট ক্যান্সার কোষগুলোকে সুনির্দিষ্টভাবে শনাক্ত করতে পারে। ফলে ক্যান্সার কোষ বৃদ্ধি, বিভাজন ও ছড়িয়ে পড়া নিয়ন্ত্রণ হয়। এই থেরাপি অন্যান্য চিকিৎসা যেমন কেমোথেরাপি, সার্জারি বা রেডিয়েশন থেরাপির পাশাপাশিও চলতে পারে।
আধুনিক চিকিৎসা মাইক্রোওয়েভ অ্যাবলেশন
ফুসফুস ক্যান্সার অপারেশন করে কেটে ফেলা দেওয়াই মূল চিকিৎসা হলেও অনেক রোগীর ক্ষেত্রে তা সম্ভব হয় না। সে ক্ষেত্রে এর ভালো চিকিৎসা স্টেরিওট্যাকটিক বডি রেডিওথেরাপি (এসবিআরটি), মাইক্রোওয়েভ অ্যাবলেশন (এমডাব্লিউএ) ইত্যাদি। সিটি স্ক্যানের মাধ্যমে সার্বিক অবস্থা দেখে মাইক্রোওয়েভ অ্যাবলেশন করা হয়, যাতে ক্যান্সার টিউমারটি সম্পূর্ণ ধ্বংস করা সম্ভব হয়। আশার কথা, বাংলাদেশেও এই চিকিৎসাপদ্ধতি চালু আছে।
ওয়ার্ল্ড কংগ্রেস অব ইন্টারভেনশনাল অনকোলজি, ইউরোপিয়ান সোসাইটি অব ইন্টারভেনশন অনকোলজি, রাপচার স্টাডি গ্রুপের (বিশ্বের সব নামি ক্যান্সার হাসপাতালের ফুসফুস টিউমার ক্যান্সার বিশেষজ্ঞ নিয়ে গঠিত গ্রুপ) গবেষণার প্রাপ্ত ফলাফল হলো—
* যাদের ফুসফুস ক্যান্সার টিউমার চার সেন্টিমিটারের নিচে তাদের ৯৭ শতাংশ রোগীর টিউমার মাইক্রোওয়েভ অ্যাবলেশন (এমডাব্লিউএ) দিয়ে সম্পূর্ণ ধ্বংস করা সম্ভব। পাশাপাশি রেডিওথেরাপি প্রয়োগের মাধ্যমে ৯৫ শতাংশ এক বছর, ৮৫ শতাংশ দুই বছর, ৭৫ শতাংশ তিন বছর, ৬২ শতাংশ রোগী পাঁচ বছর রোগমুক্ত থাকে।
* যাদের ফুসফুস ক্যান্সার টিউমার চার সেন্টিমিটারের বেশি, তাদের ৮৭ শতাংশ রোগীর টিউমার এমডাব্লিউএ দিয়ে সম্পূর্ণ ধ্বংস করা সম্ভব। পাশাপাশি রেডিওথেরাপি এবং কোনো ক্ষেত্রে কেমোথেরাপি প্রয়োগ করে ৫৭ শতাংশ রোগী তিন বছর রোগমুক্ত থাকে।
* যাদের ফুসফুস ক্যান্সার টিউমার পাঁচ সেন্টিমিটার বেশি, বুকের সঙ্গে লেগে থাকে, হৃৎপিণ্ড বা রক্তনালির সঙ্গে লেগে থাকে— তাদের টিউমার ক্যান্সার কেমোথেরাপি, রেডিওথেরাপি, এমডাব্লিউএ দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করা যায়। শুধু রেডিওথেরাপি ও কেমোথেরাপির চেয়ে এটা অনেক ভালো।
* অ্যাডভান্স টিউমার ক্যান্সারের ক্ষেত্রে ব্যথা, কাশির সঙ্গে রক্ত যাওয়া ইত্যাদি সফলভাবে দূর করতে এমডাব্লিউএ বেশ কার্যকর।
প্রতিরোধে করণীয়
ফুসফুস ক্যান্সার সম্পূর্ণ নিরাময়যোগ্য নয়। তবে প্রতিরোধযোগ্য। অর্থাৎ আগেভাগে সচেতন হলে এই ক্যান্সার প্রতিরোধ করা যায়। এ জন্য কিছু করণীয় হলো—
* ধূমপান একদম নয়, কেউ ধূমপায়ী হলে পুরোপুরি ত্যাগ করতে হবে। ধূমপান করে এমন ব্যক্তির সংস্পর্শও এড়িয়ে চলতে হবে। কেননা পরোক্ষ ধূমপানও এর জন্য দায়ী।
* গড়ে তুলুন সঠিক খাদ্যাভ্যাস। সবুজ তাজা শাক-সবজি ও ফলমূল নিয়মিত খান।
* শিল্প-কারখানা, গাড়ির নির্গত কালো ধোঁয়া থেকে বিরত থাকুন।
* ক্রোমিয়াম, এসবেস্টস, ক্যাডমিয়াম ইত্যাদি বিভিন্ন রাসায়নিক পদার্থ সম্পূর্ণরূপে এড়িয়ে চলুন। এসব পদার্থ রয়েছে এমন পরিবেশে কাজ করা থেকে বিরত থাকুন।
* যক্ষ্মা, ব্রংকাইটিস, নিউমোনিয়া, অ্যাজমা ইত্যাদি হলে দ্রুত চিকিৎসা করান। এসব রোগের কারণে ফুসফুসের আক্রান্ত স্থানে ক্যান্সার দেখা দিতে পারে।
* যারা খুব বেশি ধূমপান করে তাদের উচিত ফুসফুসের ক্যান্সারের স্ক্রিনিং করা। প্রাথমিক পর্যায়ে ধরা পড়লে জটিলতা কমানো যায়।