দিনটি ছিল ৮ই জিলহজ। হজের দিন। দুনিয়ার নানা প্রান্ত থেকে মুসলমানরা মক্কায় এসেছে লাব্বাইকের গানে গানে। আর হোসাইন (রা.) রওনা করেছেন কুফায় এজিদের অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে।
তিনি জানতেন, শক্তিধর এজিদ বাহিনীর বিরুদ্ধে দাঁড়ানো মানে নিশ্চিত মৃত্যু। যখন মুক্তির সব পথ বন্ধ তখন মৃত্যুই মুক্তির রূপে নেমে আসে। তাই মরণকেই হাসিমুখে বরণ করে নিলেন তিনি। হোসাইন (রা.)-এর শাহাদাত এজিদের নিষ্ঠুরতা কিয়ামত পর্যন্ত পৃথিবীবাসীর চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেবে। একইভাবে যারা এজিদকে নির্দোষ প্রমাণের জঘন্যতম চেষ্টা করে, তাদের স্বপ্নেরও কবর রচনা করে দিয়েছে রক্তরাঙা কারবালা। প্রিয় পাঠক! ইমাম হোসাইনের কাটা শিরের সঙ্গে এজিদের নিষ্ঠুরতা সম্পর্কে নির্ভরযোগ্য বর্ণনায় চোখ বুলিয়ে নিই, আসুন।
‘আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া’ গ্রন্থে ঐতিহাসিক ইবনে কাসির (রহ.) লিখেছেন, যখন হোসাইন (রা.)-এর কাটা মাথা এজিদের সামনে আনা হলো তখন এজিদ হাতের লাঠি দিয়ে ইমামের মাথা মোবারক খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে দেখছিলেন। একবার ডানে খোঁচা দেয়, আরেকবার বাঁয়ে। এরপর ঠোঁটের কাছে লাঠি নিয়ে এলো। লাঠি দিয়ে ঠোঁট দুটি ফাঁক করল। সঙ্গে সঙ্গে ইমামের নুরানি দাঁতগুলো ঝলক দিয়ে উঠল। পাপিষ্ঠ এজিদ তাঁর দাঁতে মুখে এমনভাবে খোঁচাতে লাগল যে আহলে বাইত প্রেমিকরা সহ্য করতে পারলেন না। দরবারে থাকা আবু বোরজা (রা.) জীবনের মায়া ত্যাগ করে সাহসের সঙ্গে দাঁড়িয়ে বলেন, রে বদখত এজিদ! তুই কোন ঠোঁটে আঘাত করছিস! আমি অসংখ্যবার দেখেছি এই ঠোঁটে আল্লাহর রাসুল (সা.) চুমু খেতেন আর বলতেন, ‘আমার আদরের কলিজার টুকরা নাতি! তোমরা দুজন বেহেশতি যুবকদের সর্দার। তোমাদের যারা হত্যা করবে তাদের জন্য জাহান্নামের নিকৃষ্ট আবাস। ’
ইতিহাসবিদ ইবনে আসাকেরের মতে, আবু বোরজা দৃপ্ত কণ্ঠে আরো বলেছেন, ‘নাপাক এজিদ! ভেবে দেখ, কিয়ামতের দিন তোর পাশে থাকবে পাপিষ্ঠ ইবনে জিয়াদ, আর হোসাইনের পাশে থাকবে তার নানা নবীয়ে কায়েনাত (সা.)। সেদিন তুই কিভাবে নবীজিকে মুখ দেখাবি। ’
ইবনে আসাকের লিখেছেন, ইমামের মাথা খোঁচাতে খোঁচাতে এজিদ কবিতা আবৃত্তি করছিল। কবিতার সারমর্ম ছিল এ রকম—‘হে হুসাইন! তোমার নানা মুহাম্মদ (সা.) বদরে আমার পূর্বপুরুষ উতবাকে হত্যা করেছে। আজ আমি ফোরাতে তোমাকে হত্যা করে তার প্রতিশোধ নিলাম। ’
ইবনে হাজার মাক্কি (রহ.) বলেন, এরপর এজিদ এমন কথা বলেছে, যা সুস্পষ্ট কুফুরি। এজিদ বলেছে, ‘তোমার নানা আরবদের নিয়ে অনেক খেলেছেন। অথচ তার কাছে কোনো বাণী আসেনি, কোনো ওহিও আসেনি। তোমাকে হত্যা করে প্রমাণ করেছি, আমি উতবার যোগ্য উত্তরসূরি। ’
হাফেজ আবুল খাত্তাব ইবনে ওয়াজিহ (রহ.) বলেন, ইমাম হোসাইনের কাটা শির শহর-গঞ্জে ঘোরানোর ঘটনা দেখার পর প্রখ্যাত তাবেঈ খালেদ বিন গাফরা (রহ.) এক মাস লোকালয় থেকে আত্মগোপনে চলে যান। পরবর্তী সময়ে তাঁর নির্জনবাসের কারণ সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আফসোস! তোমরা দেখছ না কী বীভৎস সময় পার করছি আমরা! পাপিষ্ঠ এজিদ ইমাম হোসাইনকে হত্যা করে আসলে রাসুল (সা.)-কে হত্যা করেছে। কোরআন রুহানিয়াত ও ইসলামের প্রাণ মুছে ফেলেছে। ’
তথ্যসূত্র : আল কামিল ফিত তারিখ, খণ্ড ৩, পৃষ্ঠা ৪৬। তাবাকাত ইবনে সাআদ, খণ্ড ৩, পৃষ্ঠা ৬৪। আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া, খণ্ড ৮, পৃষ্ঠা ১২৪। আল ইসতিআব, খণ্ড ২, পৃষ্ঠা ৬০৪।