Friday, July 26, 2024
spot_img
Homeধর্মপ্রাচীন ইসলামী শিক্ষাব্যবস্থায় আধ্যাত্মিকতার চর্চা

প্রাচীন ইসলামী শিক্ষাব্যবস্থায় আধ্যাত্মিকতার চর্চা

প্রাচীন শিক্ষাব্যবস্থার ধারক-বাহক ও দায়িত্বশীলদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল, তারা তাদের জ্ঞানের গভীরতা, পাণ্ডিত্য, সম্মান-মর্যাদা ও খ্যাতির শীর্ষ চূড়ায় অবস্থান করেও আত্মশুদ্ধি, আত্মিক পবিত্রতা ও আল্লাহর সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনেও পুরোপুরি মনোযোগী ছিল। তারা যেভাবে বাহ্যিক জ্ঞানার্জনের জন্য শাস্ত্রীয় পণ্ডিত ও বিশেষজ্ঞ আলেমদের সেবায় নিয়োজিত হওয়াকে নিজের দায়িত্ব মনে করত, তেমনি আহলে দিল ও আধ্যাত্মিক রাহবারদের দরবারে উপস্থিত হওয়াকে নিজের জন্য আবশ্যক মনে করত। একদিকে তারা রাজা-বাদশাহ ও মন্ত্রী-শাসকদের সামনে আত্মমর্যাদা ও রাজকীয় ভঙ্গি নিয়ে থাকত, অন্যদিকে আধ্যাত্মিক সাধকদের সামনে সীমাহীন বিনয় ও বিনম্রতা প্রকাশ করত। আত্মমর্যাদা ও বিনয়ের বিরল সমন্বয় ঘটেছিল এসব আলেমের ভেতর।

ভারতবর্ষের শিক্ষাব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত যেসব ব্যক্তিত্বকে আল্লাহ সাধারণ গ্রহণযোগ্যতা ও অমর খ্যাতি দান করেছিলেন এবং যাঁরা শত শত বছর ধরে শিক্ষাব্যবস্থা পরিচালনা করেছেন, তাঁদের সঙ্গে সমকালীন কোনো না কোনো আধ্যাত্মিক সাধক ও বুজুর্গের অবশ্যই সম্পর্ক ছিল। ভারতবর্ষের মুসলিম শাসনের প্রথম যুগে শিক্ষাব্যবস্থা ও শিক্ষা কেন্দ্রগুলোর ওপর তিন ব্যক্তির প্রভাব লক্ষ করা যায়। তাঁদের শিষ্য ও শিষ্যের শিষ্যরা কয়েক শতাব্দী পর্যন্ত জ্ঞানের প্রদীপ প্রজ্বালিত রেখেছেন। তাঁরা হলেন দিল্লির তিনজন খ্যাতিমান শিক্ষক আল্লামা আবদুল মুকতাদির থানেশ্বরী (মৃত্যু ৭৯১ হি.), তাঁর ছাত্র মাওলানা খাজেগি দেহলভি (মৃত্যু ৮০৯ হি.), শায়খ আহমদ থানেশ্বরী (মৃত্যু ৮০১ হি.)। তাঁরা তিনজনই ‘চেরাগে দিল্লি’ (দিল্লির প্রদীপ) শায়খ নাসিরুদ্দিন (রহ.)-এর দীক্ষাপ্রাপ্ত মুরিদ ছিলেন।

শিক্ষাধারায় দ্বিতীয় কেন্দ্রীয় ব্যক্তিত্ব ছিলেন আল্লামা ওয়াজিহুদ্দিন বিন নাসরুল্লাহ গুজরাটি (মৃত্যু ৯৯৮ হি.)। তিনি ৬৭ বছর আহমেদাবাদে কোরআন-হাদিস ও নানা জাগতিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের পাঠ দান করেছেন। তাঁর জীবদ্দশাতেই আহমেদাবাদ থেকে লাহোর পর্যন্ত তাঁর ছাত্র-শিষ্যরা জ্ঞান বিতরণে ছড়িয়ে পড়ে। ‘উস্তাজুল আসাতিজা’ (শিক্ষককূলের শিক্ষক)-এর মর্যাদাকর আসন তিনি জীবদ্দশাতেই লাভ করেছিলেন। জাহানাবাদ, অমৃতসর ও লখনউ শহরের পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য তিনি ছিলেন প্রদীপতুল্য। আল্লামা ওয়াজিহুদ্দিন শায়খ মুহাম্মদ গাউস গোয়ালিয়ারি (রহ.)-এর মুরিদ ও খলিফা ছিলেন। তিনি তাঁর নেক দোয়া লাভ করেছিলেন। (তারিখে গুজরাট, মাওলানা সাইয়েদ আবদুল হাই (রহ.)

সর্বশেষ যে শিক্ষাধারা ও পাঠ্যক্রম বৈশ্বিক মর্যাদা লাভ করেছিল এবং যার প্রচলন ভারতবর্ষ থেকে আফগানিস্তান ও পারস্য পর্যন্ত ঘটেছিল, তার রূপকার মোল্লা নিজামুদ্দিন সাহালভি (মৃত্যু ১১৬১ হি.) ছিলেন কাদেরিয়া তরিকার সঙ্গে যুক্ত। তিনি কাদেরিয়া তরিকার বিখ্যাত পীর শায়খ সাইয়েদ আবদুর রাজ্জাক বানসাভি (রহ.)-এর সঙ্গে শুধু পীর-মুরিদি ও সেবার সম্পর্ক রাখতেন না; বরং তিনি নিজের পীরের প্রতি দ্বিধাহীন আস্থা রাখতেন এবং তার ভালোবাসায় ছিলেন আত্মভোলা।

দারুল উলুম দেওবন্দের প্রতিষ্ঠাতা মাওলানা মুহাম্মদ কাসেম নানুতবি (রহ.) (মৃত্যু ১২৯৭ হি.) এবং দারুল উলুম দেওবন্দের অপর পৃষ্ঠপোষক ও মুরব্বি মাওলানা রশিদ আহমদ গাঙ্গুহি (রহ.) (মৃত্যু ১৩২৩ হি.) তারা উভয় হাজি ইমদাদুল্লাহ মুহাজিরে মক্কি (রহ.)-এর অনুমতিপ্রাপ্ত ও খলিফা ছিলেন। নদওয়াতুল উলামা আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা মাওলানা সাইয়েদ মুহাম্মদ আলী মুঙ্গেরি (রহ.) ছিলেন মাওলানা ফজলে রহমান গঞ্জমুরাদাবাদি (রহ.)-এর খলিফা ছিলেন। এমনিভাবে ভারতবর্ষের শিক্ষাধারা প্রত্যেক যুগে, প্রতিটি বাঁকবদলে কোনো না কোনো আল্লাহসাধক বুজুর্গ ব্যক্তির ছায়া ও পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করেছে। যে সম্পর্ক ও সংশ্রব তার ভেতর নিষ্ঠা, আল্লাহর জন্য আত্মনিবেদন ও সাধারণ গ্রহণযোগ্যতার গুণ সৃষ্টি করেছে।

একটি বিষয় বড়ই শিক্ষণীয় ও লক্ষণীয় যে বেশির ভাগ বিখ্যাত আলেম ও শিক্ষক নিজ যুগের এমন একজন বুজুর্গ ব্যক্তির সঙ্গে আধ্যাত্মিক সম্পর্ক গড়ে তুলেছেন যাঁরা কখনো কখনো প্রাতিষ্ঠানিক ও পারিভাষিক অর্থে আলেম ছিলেন না। সেই যুগের লোকেরা তাঁকে ‘জ্ঞানী’ মনে করত না। তাঁর উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হলো মাওলনা মুহাম্মদ ইসমাইল শহিদ (রহ.) ও মাওলানা আবদুল হাই বোরহানি (রহ.)-এর কালজয়ী আলেম সাইয়েদ আহমদ শহিদ (রহ.)-এর মতো, মোল্লা নিজামুদ্দিনের মতো পণ্ডিত ব্যক্তি সাইয়েদ আবদুর রাজ্জাক বানসাভি (রহ.)-এর মতো, মাওলানা মুহাম্মদ কাসেম নানুতবির মতো মুজতাহিদ আলেম হাজি ইমদাদুলুল্লাহ মুহাজিরে মক্কি (রহ.)-এর মতো ব্যক্তির হাতে মুরিদ হয়েছেন এবং উপকৃত হয়েছেন।

এসব ঘটনা সুগভীর জ্ঞানের অধিকারী আলেমদের নিষ্ঠা, আল্লাহপ্রেমের তৃষ্ণা, উচ্চদৃষ্টি ও বিনয়ের অকাট্য দলিল। আল্লাহর জন্য এই নিষ্ঠা ও নিবেদন তাদের কাজ ও কাজের ধারাগুলোকে বিস্তৃতি, স্থিতি ও সাধারণ গ্রহণযোগ্যতা দান করেছে। জ্ঞানে পাণ্ডিত্য অর্জন, অধ্যয়ন ও অনুসন্ধানের আনন্দের সঙ্গে সঙ্গে নিজের আত্মিক প্রয়োজন ও অপূর্ণতাগুলো অনুভব করা এবং আত্মিক পরিশুদ্ধি ও পূর্ণতা লাভ, নিষ্ঠা ও আল্লাহর সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের আকাঙ্ক্ষা ছিল প্রাচীন শিক্ষাব্যবস্থার একটি আলোকিত অধ্যায়। যার ফলে শিক্ষাব্যবস্থার ধারক-বাহকদের সঙ্গে সাধারণ মানুষের সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল এবং তাঁরা সাধারণ মানুষের জীবনকে প্রভাবিত করতে পেরেছিলেন। পাশাপাশি তাঁরা নিজ নিজ সময়ের বস্তুবাদী তৎপরতা, লোভ-লালসা, সুলতান ও শাসকদের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন ও নৈকট্য লাভের প্রলোভনসহ বহু নৈতিক দুর্বলতা থেকে নিজেদের রক্ষা করতে পেরেছিলেন। নিছক জ্ঞান ও প্রতিভা দ্বারা যা থেকে আত্মরক্ষা করা দুঃসাধ্য। যে একাগ্রতা, অধ্যবশায়, নিষ্ঠা ও প্রতাপের সঙ্গে এসব আলেম ও শিক্ষকরা সাত শ থেকে আট শ বছর নিজের দায়িত্ব পালন করেছেন এবং অঞ্চলের পর অঞ্চল আলোকিত করেছেন তাতে এসব সম্পর্ক ও তারবিয়তের অনেক বড় ভূমিকা আছে। ভূমিকা আছে সেসব শিক্ষা, শিষ্টাচার, নৈতিকতা ও আত্মশুদ্ধির যা তারা এসব আধ্যাত্মিক কেন্দ্র ও পুণ্যাত্মা মানুষদের কাছ থেকে অর্জন করেছে।

শেষ পর্যন্ত আরবি ধারার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে এই রীতি চালু হয় যে তারা শাস্ত্রীয় জ্ঞানার্জনের পর নিজের আত্মিক ও আধ্যাত্মিক পূর্ণতা অর্জনের জন্য একজন কোনো বুজুর্গ ব্যক্তি বা কোনো আধ্যাত্মিক কেন্দ্র (খানকা) মুখী হতেন। যার প্রতি তাঁর বা তাঁর শিক্ষকদের সুধারণা ও আত্মিক সম্পর্ক থাকত। সেখানে তারা লাগাতার কিছু দিন অবস্থান করে বা নিয়মিত যাতায়াত ও যোগাযোগ রক্ষা করে নিজের আত্মিক পূর্ণতা লাভ করত। যে পূর্ণতা শুধু জ্ঞানার্জন ও মাদরাসায় অবস্থানের দ্বারা অর্জন করা সম্ভব নয়।

তামিরে হায়াত থেকে

মো. আবদুল মজিদ মোল্লার ভাষান্তর

RELATED ARTICLES
- Advertisment -
Google search engine

Most Popular

Recent Comments