Saturday, July 27, 2024
spot_img
Homeনির্বাচিত কলামপ্রাকৃতিক বিপর্যয় আমাদেরই কারণে

প্রাকৃতিক বিপর্যয় আমাদেরই কারণে

একের পর এক প্রাকৃতিক বিপর্যয় পৃথিবীতে নেমে আসছে। মহামারি, বন্যা, জলোচ্ছ্বাস, অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, তাপদাহ, ভূমিকম্প ইত্যাদি একটার পর আরেকটা জনপদের পর জনপদকে কাঁপিয়ে তুলছে। কোভিট-১৯ ভাইরাস গত দু’বছরের অধিক সময় ধরে পৃথিবীকে অস্থির করে তোলে, যার তা-ব এখনো থেমে যায়নি। ইউরোপের দক্ষিণাঞ্চল এবং আফ্রিকার এক বড় অংশজুড়ে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে গেল তাপদাহ। সেই দাবদাহের ফলে ফ্রান্স, স্পেন, পর্তুগাল, গ্রীস, মরক্কোসহ বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়েছিল দাবানল, যা সামাল দিতে গিয়ে অনেক হিমশিম খেতে হয়েছে। ব্রিটেনের ইতিহাসেও এত গরম কখনো পড়েনি। এর ফলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেয়ার পাশাপশি জরুরি সতর্কতা ঘোষণা করা হয়েছিল। তুরস্ক ও সিরিয়ায় ঘটে গেলো ইতিহাসের ভয়াবহতম ভূমিকম্প। পঞ্চাশ হাজারের বেশি মানুষ নিহত হয়েছে এতে। ঘর-বাড়ি মাটির সাথে মিশে গেছে। বাংলাদেশে একটার পর একটা বিস্ফোরণে অনেক মানুষ হতাহত হচ্ছে। এগুলো আমাদের হাতের উপার্জন। নিচে এই সমস্ত দুর্যোগের কিছু কারণ উল্লেখ করা হলো।

(১) জুলুম: যখন কোন জনপদে জুলুম-নির্যাতন বেড়ে যায়, তখন সেই জনপদে আল্লাহর আযাবসমূহ একটার পর একটা নেমে আসে। আল্লাহতা’আলা বলেন, ‘জালেমদের কর্মকান্ড সম্পর্কে আল্লাহকে উদাসীন মনে করো না। আল্লাহ তাদের শুধু একটি নির্দিষ্ট দিন পর্যন্ত বিলম্বিত করেন, যেদিন চক্ষুসমূহ বিস্ফারিত হবে, তারা মাথা নিচু করে দৌড়াতে থাকবে, তাদের নিজেদের দিকে ফিরবে না, এবং তাদের হৃদয়সমূহ দিশেহারা হয়ে যাবে। মানুষকে আযাব সমাগত হওয়ার দিন সম্পর্কে সাবধান করে দাও। সেদিন জুলুমবাজরা বলবে, হে আমাদের প্রভু! অল্প কিছু দিন আমাদেরকে সময় দিন, তাহলে আমরা আপনার দাওয়াত কবুল করবো এবং রাসূলদের অনুসরণ করবো। তোমরা কি ইতিপূর্বে কসম খেয়ে খেয়ে বলতে না যে, তোমাদের পতন নেই! যারা নিজেদের ওপর জুলুম করেছো, তোমরা তোমাদের বাসস্থানেই বসবাস করছো এবং সেই সব জালিমের সাথে আমি কি আচরণ করেছি, তা তোমাদের কাছে স্পষ্ট হয়ে গেছে। উপরন্তু আমি তোমাদের জন্য বহু উদাহরণ দিয়েছি।’ (সুরা ইবরাহিম: ৪১-৪৫)। আল্লাহতা’আলা বলেন, ‘শুধু তাদের বিরুদ্ধেই ব্যবস্থা গ্রহণ করা যায় যারা মানুষের ওপর অত্যাচার করে থাকে। জুলুমবাজরা তাদের অত্যাচারের পরিণতি অচিরেই জানতে পারবে।’ (সুরা শুরা: ২২৭)। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘আল্লাহ তা’আলা জালিমকে দীর্ঘ সময় দিয়ে থাকেন। অবশেষে যখন পাকড়াও করেন তখন তাকে আর রেহাই দেন না। তারপর তিনি এ আয়াত পাঠ করেন: তোমার প্রভুর পাকড়াও এ রকমই হয়ে থাকে, যখন তিনি জুলুমরত জনপদ সমুহকে পাকড়াও করেন। তাঁর পাকড়াও অত্যন্ত যন্ত্রণাদায়ক, অপ্রতিরোধ্য।’ (বুখারী, মুসলিম, তিরমিযি)।

(২) স্বহস্তের উপার্জন: আল্লাহ তা’আলা বলেন, ‘মানুষের কৃতকর্মের দরুন জলে ও স্থলে বিপর্যয় ছড়িয়ে পড়েছে। যার ফলে তাদেরকে তাদের কিছু কৃতকর্মের স্বাদ আস্বাদন করানো যায়, হয়তো তারা ফিরে আসবে।’ (সুরা রুম: ৪১)।

মানুষের স্বহস্তের উপার্জন অর্থ হচ্ছে ফাসেকী, অশ্লীলতা, জুলুম ও নিপীড়ন এবং অবাধ্যতা, কুফরী ও পাপাচারের কারণে কখনও কখনো মহান আল্লাহ তা’আলা এসব দুযোর্গ দিয়ে সতর্ক করেন, যাতে তারা আখিরাতের শাস্তি লাভ করার পূর্বে আল্লাহ এ দুনিয়ায় মানুষের সমস্ত নয় বরং কিছু খারাপ কাজের ফল এ জন্য ভোগ করান যে, এর ফলে সে প্রকৃত সত্য উপলব্ধি করবে এবং নিজের চিন্তাধারার ভ্রান্তি অনুধাবন করে সঠিক পথে চলে আসে।
(৩) উপলব্ধি ও ফিরে আসার সুযোগ: আল্লাহ তা’আলা বলেন, ‘সেই বড় আযাবের আগে আমি দুনিয়াতে তাদেরকে কোন না কোন ছোট আযাবের স্বাদ ভোগ করাতে থাকবো। হয়তো এরা তাদের বিদ্রোহত্মক আচরণ থেকে বিরত হবে।’ (সুরা আস সাজদা: ২১)।

দুনিয়ার মাঝে ব্যক্তিগত ও জাতিগত পর্যায়ে আযাব নাযিল করে আল্লাহ তা’আলা তাদেরকে এ কথা স্মরণ করিয়ে দিতে চান যে, ওপরে কোন উচ্চতর শক্তি তাদের ভাগ্যের ফায়সালা করছে। তাঁর ফায়সালা পরিবর্তন করার শক্তি কেউ রাখে না। তবে যারা অন্ধকারে ডুবে আছে তারা এ ঘটনাবলী থেকে পূর্বেও শিক্ষা গ্রহণ করেনি এবং ভবিষ্যতেও কখনো করবে না। দুনিয়াতে যেসব বিপর্যয় আসে তারা তার অর্থ বোঝে না। তাই তারা এসব বিপর্যয়ের এমন এমন সব ব্যাখ্যা করে, যা তাদেরকে সত্য উপলব্ধি করা থেকে আরো দূরে নিয়ে যায়।

(৪) কয়েকটি গুনাহ ও তার কুফল: হযরত ইবনে আব্বাস রা: থেকে বর্ণিত। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ক) যে সম্প্রদায় মাপে কম দেয় এবং ওজনে কম করে আল্লাহ তা’আলা তাদের জন্য বৃষ্টি বন্ধ করে দেন। খ) যে সম্প্রদায়ের মধ্যে অশ্লীলতা ও কুকর্ম বৃদ্ধি পায়, তাদের মধ্যে মৃত্যুর হার বেড়ে যায়। গ) যে সম্প্রদায়ের মধ্যে সুদি লেনদেন বেড়ে যায়, আল্লাহ তাদের মধ্যে পাগলামী ও মস্তিস্ক বিকৃতি বৃদ্ধি করে দেন। ঘ) যে সম্প্রদায়ের মধ্যে হত্যা ও খুন-খারাপি বেড়ে যায়, তাদের ওপর আল্লাহ তা’আলা তাদের দুশমনদের চাপিয়ে দেন। ঙ) যে সম্প্রদায়ের মধ্যে লুত আ. এর সম্প্রদায়ের কাজ (সমকামিতা) হতে থাকে, তাদের মধ্যে ভূমিধস হওয়া ব্যাপক হয়ে যায়। চ) যে সম্প্রদায় সৎকাজের আদেশ অসৎ কাজের নিষেধ পরিত্যাগ করে, তাদের আমল ও কাজকর্মের উন্নতি হয় না এবং তাদের দু’আ কবুল হয় না। (সুনানুল কুবরা: ৩/৩৪৬-৩৪৭)।

(৫) সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধ বন্ধ থাকা: হযরত আয়েশা রা. বলেন, একবার রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমার নিকট এমন অবস্থায় আগমন করলেন যে, তাঁর শ্বাস-প্রশ্বাস ভারী হচ্ছিল। তিনি এসে কোন কথা বললেন না। এরপর তিনি অজু করলেন এবং বাইরে বের হলেন। আমি হুজরায় বসা ছিলাম। তিনি মিম্বরে উঠে আল্লাহর হামদ ও সানা পাঠ করে বললেন, হে লোকসকল! আল্লাহ তা’আলা তোমাদেরকে বলেছেন যে, তোমরা নেক কাজের আদেশ করো আর অসৎ কাজ থেকে নিষেধ করো, সেই সময় আসার পূর্বে যখন তোমরা আমার কাছে দু’আ করবে আর আমি তোমাদের দু’আ কবুল করবো না। তোমরা আমার কাছে চাইবে আর আমি দান করবো না। তোমরা আমার কাছে সাহায্য প্রার্থনা করবে আর আমি তোমাদেরকে সাহায্য করবো না।’ (সহীহ ইবনে মাযাহ: ৪০০৪)।

হযরত কায়েস বিন আবু হাতিম বলেন, একবার হযরত আবু বকর সিদ্দিক রা.এই আয়াত পাঠ করেন, ‘হে মু’মিনগণ! তোমরা নিজেদের চিন্তা করো। তোমরা যদি সৎপথে পরিচালিত হও, তবে যে ভ্রান্ত পথ রয়েছে সে তোমাদের কোন ক্ষতি করতে পারবে না।’ (সুরা মায়িদা: ১০৫)। ‘এবং বলেন, লোকেরা এই আয়াতটির যথাযথ অর্থ করতে পারে না। অথচ আমি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছি, যে সম্প্রদায় কোন জালিমের জুলুম দেখেও বাধা দেয় না অথবা কোন অন্যায় ও পাপ কাজ দেখেও তা প্রতিরোধ করে না, আল্লাহ তা’আলা তাদেরকে শাস্তিতে নিপতিত করবেন।’ (ইবনু জারির তাবারী)

(৬) পাঁচটি গুনাহের পরিণতি: হযরত ইবনে উমর রা. বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নিকট মুহাজিরদের দশজন ব্যক্তি বসা ছিল। তাদের মধ্যে আমি ছিলাম দশম ব্যক্তি। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর চেহেরা মুবারক ঘুরিয়ে আমাদের দিকে মনোনিবেশ করলেন এবং বললেন, হে মুহাজির সম্প্রদায়! পাঁচটি স্বভাব এমন, যা থেকে আমি আল্লাহর কাছে পানাহ্ চাই, যাতে তোমরা তাতে পতিত না হও।

এক, যে সম্প্রদায়ের মধ্যে নির্লজ্জতা ও অশ্লীলতা সাধারণ বিষয় হয়ে যায় এবং মানুষ তা প্রকাশ্যে করতে থাকে, তখন তাদের মধ্যে প্লেগ এবং এমনসব রোগ-ব্যাধি প্রকাশ পায় যা তাদের পূর্ববর্তীদের মধ্যে কখনো হয়নি। দুই, আর যে সম্প্রদায় মাপে ও ওজনে কম করবে, তারা দুর্ভিক্ষ, কষ্ট-কাঠিন্য এবং বাদশাহ ও শাসকদের অত্যাচারের শিকার হবে। তিন, আর যে সম্প্রদায় যাকাত প্রদান করা বন্ধ করে দেয় তারা বৃষ্টির রহমত থেকে বঞ্চিত হয়। যদি জন্তু-জানোয়ার না থাকতো তবে একেবারেই বৃষ্টি হতো না। চার, আর যে সম্প্রদায় চুক্তি ভঙ্গ করবে তাদের ওপর তাদের দুশমনদেরকে প্রবল করে দেয়া হয় যারা তাদের মাল-সম্পদের উপর কর্তৃত্ব নিয়ে নেয়। পাঁচ, আর যে সম্প্রদায়ের শাসকবর্গ আল্লাহর নাযিলকৃত বিধানের উপর আমল করে না এবং কুরআনের হুকুম-আহকামকে মূল্যায়ন করে না তখন আল্লাহ তা’আলা তাদেরকে নিজেদের মধ্যে ঝগড়া-বিবাদ ও শাস্তিতে জড়িয়ে দেন।’ (মুস্তাদরাক হাকিম)।

(৭) দুনিয়া হাসিল করার ধান্ধা: আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, শেষ যামানায় এমন কিছু লোকের আবির্ভাব ঘটবে, যারা দীনের নামে দুনিয়া হাসিল করবে। লোকদের দেখানোর জন্য সুফি বেশ ধারণ করবে। তাদের জবান হবে চিনির চেয়েও মিষ্ট, অথচ তাদের অন্তর হবে নেকড়ে বাঘের মতো। আল্লাহ তা’আলা বলেন, তুমি কি আমাকে ধোঁকা প্রদান করো অথবা দুঃসাহস দেখাও? আমার নিজের সত্তার কসম! আমি তাদের উপর এমন ফিতনা ছড়িয়ে দেবো, যা তাদের মধ্যে সহনশীল-বুঝমান লোককেও হয়রান-পেরেশান করে তুলবে। (তিরমিযি: কিতাবুল যুহদ)।
খুব দ্রুত তাওবা করে আল্লাহর রহমতের সীমানায় প্রবেশ করতে হবে। অবশ্যই আমরে বিল মারূফ ও নাহি আনিল মুনকার তথা সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজের নিষেধ-এর অপরিহার্য দায়িত্ব পালন করতে হবে। জমিনে ছড়িয়ে পড়া সকল প্রকার অশ্লীল ও বেহায়াপনার মুলোৎপাটন করতে হবে। রাষ্ট্রীয় জুলুমসহ সকল প্রকার জুলুম-নির্য়াতন বন্ধ করতে হবে। করুণার আধার মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন ফিরে আসার সদর দরজা খুঁলে রেখেছেন। সুতরাং তাঁর দয়া ও অনুগ্রহের সীমানার মধ্যে যত দ্রুত চলে আসা যায়, ততই কল্যাণ।

লেখক: নিবন্ধকার

RELATED ARTICLES
- Advertisment -
Google search engine

Most Popular

Recent Comments