আমরা উন্নতির সুউচ্চ যুগে বসবাস করছি। আল্লাহ তায়ালার অফুরন্ত নেয়ামত চারদিকে ভরপুর। তাঁর দেয়া নেয়ামতকে কাজে লাগিয়ে আরো কত প্রয়োজনীয় বস্তু বানাতে আমরা তৎপর এবং সফলও হচ্ছি। বিজ্ঞানের অনেক আবিষ্কার আমাদের জীবন চলাকে সহজ করে দিয়েছে। তবে যতই উন্নত হচ্ছি, ততই যেন মানবিক মূল্যবোধের চরম ধস নামছে। ছোটদের কান্নার আওয়াজে ঘরের কয়েকজন ছুটে গেলেও বৃদ্ধদের আর্তনাদে তার কাছে কেউ যাওয়ার কল্পনাই করি না। আজ আমার সাজানো সংসার এই বৃদ্ধ পিতা-মাতার অবদান। তাদের জায়গা হচ্ছে বৃদ্ধাশ্রম, অনাদর আর অবহেলায়। যারা আজ পাশ্চাত্যে বসবাস করছে, যারা সভ্য পৃথিবীর সভ্য নাগরিক বলে দাবি করে, তাদের কাছে পিতা-মাতা অবহেলার পাত্র না কি গ্রামের সেই অশিক্ষিত কৃষক ছেলেটির কাছে?
বড়রা সমাজের মগজ আর যুবকরা সমাজের হার্ট বা শক্তি, প্রাণচাঞ্চল্য। একটির সাথে অপরটির গভীর সংযোগ রয়েছে। একদিন এক বৃদ্ধ সাহাবি রাসূলুল্লাহ সা:-এর কাছে এলেন। অনেক সাহাবি সেখানে বসা ছিলেন। রাসূলুল্লাহ সা:-এর কাছে ওই বৃদ্ধ সাহাবির রাস্তা করে দিতে অন্যান্য সাহাবার একটু দেরি হচ্ছিল। এই সময়ক্ষেপণকে রাসূলুল্লাহ সা: ভালোভাবে নেননি। তিনি বললেন, যে আমাদের ছোটদের স্নেহ করে না, বড়দের সম্মান করে না। সে আমাদের দলভুক্ত নয়। (সুনাতে তিরমিজি) আবু দাউদের এক রেওয়ায়েতে আছে, যে আমাদের ছোটদের প্রতি রহম করে না। বড়দের হক বুঝে না সে আমাদের দলভুক্ত নয়।
রাসূলুল্লাহ সা: কখনো বৃদ্ধদের নিজের কাজে ডেকে পাঠাতেন না। রাসূলুল্লাহ সা: নিজে গিয়েই তাদের সাথে দেখা করতেন। মক্কা বিজয়ের সময় রাসূলুল্লাহ সা: মসজিদে হারামে প্রবেশ করলেন এমন সময় আবু বকর রা: তাঁর পিতা আবু কুহাফাকে নিয়ে হাজির হলেন। রাসূলুল্লাহ সা: তাকে দেখে বললেন, তুমি বৃদ্ধকে বাড়িতে রাখলে না কেন? আমি নিজে গিয়েই দেখা করতাম। আবু বকর রা: জবাবে বললেন, হে রাসূলুল্লাহ সা: আপনি তার কাছে যাওয়ার চেয়ে তিনিই আপনার কাছে হেঁটে আসা সমীচীন মনে করি। রাসূলুল্লাহ সা: বললেন, তাকে আমার সামনে বসাও। আবু কুহাফাকে রাসূলুল্লাহ সা:-এর সামনে বসানো হলো। রাসূলুল্লাহ সা: তার বুক মুছে দিলেন এবং বললেন, ইসলাম কবুল করুন। আবু কুহাফা ইসলাম গ্রহণ করলেন। তার চুল ও দাড়ি সাদা হয়ে গিয়েছিল। রাসূলুল্লাহ সা: বললেন, তোমরা কোনো কিছু দিয়ে তার চুলের রঙের পরিবর্তন করে দাও।
রাসূলুল্লাহ সা: সালামের আদব সম্পর্কে বলেন, ছোটরা বড়দের সালাম দেবে। হেঁটে যাওয়া ব্যক্তি বসে থাকা ব্যক্তিকে সালাম দেবে। অল্পসংখ্যক লোক বেশি সংখ্যক লোককে সালাম দেবে। এভাবে প্রায় সব কাজে রাসূলুল্লাহ সা: বড়দের প্রাধান্য দিতেন।
মানুষ বৃদ্ধ অবস্থায় সবচেয়ে অসহায়ত্ব বোধ করে। এই সময় তার দৃষ্টি শক্তি কমে যায়। গায়ে জোর থাকে না। কারো সাহায্য ছাড়া অনায়াসে চলতে পারে না। স্মরণশক্তি কাজ করে না, মতিভ্রম হয়। বোধশক্তি বুদ্ধিমত্তায় তালগোল পাকিয়ে যায়। শারীরিক অক্ষমতা দেখা দেয়। একটু ভেবে দেখি তো এই সময়ে মানুষ সবচেয়ে বেশি অসহায়, না অন্য সময়ে? এই সময়ে তার সবচেয়ে বেশি সেবার প্রয়োজন, না অন্য সময়ে? এই সময়ে তাকে বেশি সময় দেয়ার দরকার, না অন্য সময়ে? আবু মূসা আশয়ারী রা: থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, যে বৃদ্ধ মুসলিম, কুরআনের প্রতি সীমালঙ্ঘন করেনি, কুরআনকে উপেক্ষা করেনি এমন কুরআনের ধারকগণ এবং ন্যায়পরায়ণ শাসককে সম্মান করা আল্লাহ তায়ালাকে সম্মান করার অন্তর্ভুক্ত। (সুনানে আবু দাউদ)
আমরা যদি উপরোক্ত হাদিসের দিকে তাকাই। তাহলে দেখি আলেম, শাসকের আগে বৃদ্ধ লোকটি সম্মান পাওয়ার হকদার। মুসলিম শাসকগণও ছিলেন এই ক্ষেত্রে অনেক অগ্রগামী। ইবনে কাছির রাহ: বর্ণনা করেন, হজরত তালহা ইবনে ওবায়দুল্লাহ রা: বলেন, প্রচণ্ড আঁধার রাত। চারদিক নিকশ কালো। আমি দেখলাম ওমর রা: একটি বাড়িতে প্রবেশ করছেন। আমি চিন্তা করতে থাকলাম। রাতে আর খবর নিলাম না। পরদিন সকালে আমি সেই বাড়িতে গিয়ে উপস্থিত হই। এই বাড়িতে কোনো লোক নেই। দেখি একজন অন্ধ ও বৃদ্ধা লোক বসে আছেন। আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম আপনার কাছে রাতে একজন লোক এসেছিলেন। তিনি কেন এসেছিলেন? বৃদ্ধা জবাব দিলেন, এই লোকটি প্রতি রাতে আমার কাছে আসে। প্রতিদিন রাতে এত সময় ধরে আমার সেবা করে। একটু চিন্তা করে দেখি তো, অর্ধ জাহানের একজন বাদশা। যার দাপটে তৎকালীন দুই পরাশক্তি রোম-পারস্য ভয়ে কম্পমান। এমন একজন বাদশা রাতের আঁধারে একজন অন্ধ বৃদ্ধা মহিলার সেবা করার জন্য লোকচক্ষুর আড়ালে ছুটে যান। কী তাদের আদর্শ। কী তাদের মাওলার কাছে চাওয়া।
আবু বকর রা: থেকে বর্ণিত, এক লোক রাসূলুল্লাহ সা:কে প্রশ্ন করলেন, হে আল্লাহর রাসূল, সর্বোক্তম লোক কে? রাসূলুল্লাহ সা: জবাবে বললেন, যার বয়স বেশি এবং ভালো আমলের অধিকারী। আবার লোকটি জিজ্ঞেস করলেন, সবচেয়ে মন্দ লোক কে? রাসূলুল্লাহ সা: জবাবে বললেন, যার বয়স বেশি এবং সাথে সাথে আমলও মন্দ। আরো এক বর্ণনায় হুবহু একই ভাষায় বলা হয়েছে, রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, তোমাদের মধ্যে সর্বোত্তম ওই ব্যক্তি যে তোমাদের মধ্যে বয়োজ্যেষ্ঠ এবং ভালো আমলের অধিকারী।
বড়দের প্রতি সম্মানের আরো উজ্জ্বল নমুনা দেখি রাসূলুল্লাহ সা:-এর সাহাবাগণের মধ্যে। রাসূলুল্লাহ সা:-এর অল্প বয়স্ক সাহাবি সামুরা ইবনে জুনদুব (ওহুদ যুদ্ধে অংশ গ্রহণকারী সবচেয়ে ছোট সাহাবি) বলেন, রাসূলুল্লাহ সা:-এর জামানায় আমি বয়সে ছোট ছিলাম। আমি রাসূলুল্লাহ সা:-এর কাছ থেকে অনেক কিছু শিখতাম। রাসূলুল্লাহ সা:-এর মজলিসে আমি কোনো কথা বলতে পারতাম না। এর একমাত্র কারণ ছিল এখানে অনেক লোক থাকতেন, যারা আমার চেয়ে বয়সে বড়।
আবদুল্লাহ ইবনে ওমর রা:-এর ঘটনা। একদিন আবদুল্লাহ ইবনে ওমর রাসূলুল্লাহ সা:-এর এক মজলিসে উপস্থিত ছিলেন। ওই মজলিসে ওমর রা: এবং আবু বকর রা:-ও উপস্থিত ছিলেন। এই মজলিসে রাসূলুল্লাহ সা: সবাইকে লক্ষ্য করে একটি প্রশ্ন করলেন। আবদুল্লাহ ইবনে ওমর এই প্রশ্নের উত্তর জানতেন। কিন্তু আবু বকর ও ওমর রা:-এর সম্মানের দিকে চেয়ে তিনি কোনো প্রশ্নের জবাব দানে বিরত থাকেন। রাসূলুল্লাহ সা: প্রশ্ন করেছিলেন যে, আমাকে এমন একটি গাছের নাম বলো যার দৃষ্টান্ত হলো একজন মুসলিমের মতো। যে প্রত্যেক মৌসুমে তার প্রতিপালকের নির্দেশ অনুযায়ী ফল দান করে। তার পাতা ঝরে পড়ে না। আবদুল্লাহ ইবনে ওমর রা: বলেন, আমার মনে হলো এটা খেজুর গাছ। কিন্তু আমি উত্তর দেয়াটা পছন্দ করলাম না। কারণ এখানে আবু বকর ও ওমর রা: উপস্থিত। তাঁরা দু’জন কোনো জবাব দিলেন না। তখন রাসূলুল্লাহ সা: বলে দিলেন, এটা খেজুর গাছ। মজলিস শেষ হলে আমি আমার পিতার সাথে বের হলাম। তাঁকে আমি বললাম, হে আমার পিতা, আমি মনে মনে বুঝতে পেরেছিলাম যে এটা খেজুর গাছ। তিনি বললেন, তাহলে কেন তুমি বললে না। তুমি যদি জবাব দিয়ে দিতে তাহলে আমার কাছে এটা ওটার চেয়ে প্রিয় হতো। আবদুল্লাহ রা: জবাব দিলেন আমি আপনাকে এবং আবু বকর রা: কে কিছু বলতে না দেখে নিজে কিছু বলতে অপছন্দ করলাম। আর এটাই আমার জবাব না দেয়ার কারণ।
এই ছিল সোনালি যুগের ইসলামের চিত্র। রাসূলুল্লাহ সা: এই আদর্শই আমাদের জন্য রেখে গেছেন। আমরা যদি মুসলিম সমাজের সদস্য হিসেবে থাকতে চাই, রাসূলুল্লাহ সা:-এর উম্মত হিসেবে পরিচয় দিতে চাই। তাহলে অবশ্যই আমাদের বড়দের শ্রদ্ধা করতে হবে। নতুবা আমাদের মিল্লাতের সদস্য পদ হুমকির মধ্যে পড়বে।