Sunday, March 26, 2023
spot_img
Homeআন্তর্জাতিকপাকিস্তানে সরকার ও বিরোধী দলে স্নায়ুযুদ্ধ

পাকিস্তানে সরকার ও বিরোধী দলে স্নায়ুযুদ্ধ

প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের বিরুদ্ধে অনাস্থা ভোটকে কেন্দ্র করে সরকার ও বিরোধী দলগুলোতে স্নায়ুযুদ্ধ তুঙ্গে। এই যুদ্ধ এখন এক ক্লাইম্যাক্স বা রহস্যের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। এই চ্যালেঞ্জের মুখে সরকার যেসব পদক্ষেপ নিচ্ছে তা দৃশ্যত বিলম্ব, আইনি পদক্ষেপ, জনসমাবেশ এবং বিরোধীদলীয় নেতাদের দিকে অবমাননাকর মন্তব্য। উপরন্তু অন্তঃসারশূন্য বার্তা প্রচার করা হচ্ছে। বলা হচ্ছে, বিরোধীদের অনাস্থা প্রস্তাব হলো আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের ফল। এতে পরিস্থিতি বোঝার ক্ষেত্রে সরকারের বোঝার ঘাটতি আছে তাই প্রকাশ হচ্ছে। তারা বুঝতে পারছেন না এই চ্যালেঞ্জ হলো রাজনৈতিক। এর জবাব দিতে হবে রাজনৈতিকভাবে।এতে আরও বুঝায় যে, ক্ষমতাসীন পিটিআইয়ের নেতারা এখনো বিরোধীদের আক্রমণকে কাউন্টার দেয়ার জন্য রাজনৈতিক কৌশল তৈরির চেষ্টা করছে। শুরুতে দেখে মনে হয়েছিল সরকার বিরোধীদের পরিকল্পনা, ঐক্য এবং সমস্যাকে সমাধানের জন্য গুরুত্ব দিয়ে আমলে নেয়নি। তারা বিরোধী নেতাদের উপহাস করেছে। ঘোষণা দিয়েছে যে, তাদের এই পরিকল্পনা কখনো সফল হবে না। কিন্তু যখন প্রতিভাত হলো যে, বিরোধীদের পরিকল্পনা এই সরকারের চার বছরের ক্ষমতার মেয়াদে সবচেয়ে বড় হুমকি হিসেবে আসছে, তখন প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান তার অর্ধভগ্ন জোটের কাছে বিলম্বে এবং ভাঙা হৃদয়ে হাজির হলেন। কিন্তু তাদের বেদনার কথা বা কষ্টের বিষয়ে দৃষ্টি দেয়া হবে এবং সমাধান করা হবে- এ বিষয়ে নিশ্চয়তা দিলেন সামান্যই। যখন ক্ষমতাসীন দলের বিদ্রোহীরা প্রকাশ্যে এলেন, তারা প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের সরকারের বিষয়ে সন্দেহ পোষণ করলেন, তখন যেন ক্ষমতাসীন দলে বিকট শব্দে ফাটল দেখা দিলো। এতে কেঁপে উঠলো সরকার। জাহাঙ্গীর খান তারিন অনেক আগে থেকেই ভিন্নমত পোষণকারী। তার সঙ্গে ক্ষমতাসীন দলের বিদ্রোহীদের সংখ্যা ফুলে ফেঁপে উঠতে লাগলো।
এর জবাবে ক্ষমতাসীন দল যে প্রতিক্রিয়া দিয়েছে তাতে বিরোধীদের ওপর ডিম ছোড়া হয়েছে। যেমন সিন্ধু হাউজে ঝড়োগতিতে তারা আক্রমণ করেছে। সেখানে লাথি মেরে ভেতরে প্রবেশ করেছে। তাদের সঙ্গে ছিলেন মন্ত্রীরাও। তারা ভিন্নমতাবলম্বীদের নাম ধরে ডাকাডাকি করেছে। দলে বিদ্রোহীদের সংখ্যা বাড়ার বিপদের মধ্যে সরকার সুর নরম করে। তারা ভিন্নমতাবলম্বীদের মনোযোগ পরিবর্তন করে দলে ফিরে যাওয়ার আহ্বান জানায়। এক্ষেত্রে তাদেরকে সব ক্ষমা করে দেয়ার কথাও বলা হয়। কিন্তু এরপরেই প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান তার গতিপথ পরিবর্তন করলেন। তিনি বললেন, হর্স-ট্রেডিংয়ে যুক্ত হওয়ার চেয়ে তিনি প্রয়োজনে ক্ষমতা হারাবেন। তিনি বিরোধীদের সঙ্গে লড়াইকে ভালো এবং মন্দের মধ্যে লড়াই বলে অভিহিত করেন। এটা করতে গিয়ে তিনি ধর্মকে ব্যবহার করেন। যারা যারা নিজেদেরকে নিরপেক্ষ হিসেবে দেখাতে চেয়েছেন তিনি তাদেরকে ‘পশু’ হিসেবে বেছে নিয়েছেন। এর সঙ্গে সতর্কতা দেয়া হয়। বলা হয়, দলীয় বিদ্রোহীরা জনগণের ক্ষোভের মুখে পড়বেন।
সরকারের এইসব বক্তব্য ও কর্মাকাণ্ড সরকারের পদস্থ কর্মকর্তাদের মধ্যে আস্থা ফেরাতে অথবা সরকারের অবস্থানকে শক্তিশালী করতে খুব সামান্যই অবদান রেখেছে। পক্ষান্তরে এর নেতারা জ্বালাময়ী এবং অসংলগ্ন বক্তব্য, মন্ত্রীদের পক্ষ থেকে মিডিয়ার ওপর আক্রমণ এবং সংবাদ সম্মেলনের বক্তব্য পরিচিতি পেয়েছে কুরুচিপূর্ণ বক্তব্য হিসেবে। সারা দেশের জনগণের প্রতি আপিল হিসেবে রোববার দলীয় র‌্যালিকে ‘ঐতিহাসিক’ বলে হিসেবে বর্ণনা করেছেন ইমরান খান। তিনি এই র‌্যালিকে ‘গ্যাং অব থিভস’ বা দুর্বৃত্তদের গ্যাসের বিরুদ্ধে ক্ষমতার প্রদর্শন হিসেবেও বর্ণনা করেছেন। বক্তব্য প্রসারিত না করেই তিনি বলেছেন, (অনাস্থা প্রস্তাবে) ভোটের দিন রুক্ষ্ম এক হতাশার মুখোমুখি হতে যাচ্ছে বিরোধীরা। যারাই বলেছেন, সরকারকে উৎখাত করা হবে, তাদেরকে নিয়েই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপক ট্রোল করেছে পিটিআই। রাজনৈতিক লড়াইয়ে ‘এস্টাবলিশমেন্টকে’ নিরপেক্ষ থাকার জন্য অনেকেই তীর্যক সমালোচনা করছেন। ভিন্নমতাবলম্বীদের বাড়ির বাইরে নেতাকর্মীরা যে বিক্ষোভ করেছে এতে ক্ষমতাসীন দলের মধ্যে বেপরোয়াভাব দেখা গেছে এবং তারা ট্রাম্পিয়ান স্টাইল অবলম্বন করেছে ভীতি প্রদর্শনের।
ওআইসি’র পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের সম্মেলনকে কেন্দ্র করে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন বিলম্বিত করার কৌশল নেয়া হয়। ২১শে মার্চে না করে এই অধিবেশন আহ্বান করা হয় ২৫শে মার্চ। এখানে উল্লেখ্য, অনাস্থা প্রস্তাব উত্থাপন করলে তা পরবর্তী ১৪ দিনের মধ্যে কার্যপ্রণালি বিধিতে তুলতে বাধ্য পার্লামেন্ট তার সংবিধানের অধীনে। কিন্তু ২৫শে মার্চ অধিবেশন শুরু হলেও অনাস্থা প্রস্তাব সেদিন তুলতে দেয়া হয়নি। আবার ২৮শে মার্চ এই অধিবেশন আহ্বান করা হয়। এতে জাতীয় পরিষদের স্পিকার আসাদ কায়সার ভয়াবহ পক্ষপাতিত্ব দেখিয়ে নিজে বিতক্যের কেন্দ্রে চলে এসেছেন। ফলে বিরোধীরা তার বিরুদ্ধে সংবিধান লঙ্ঘনের অভিযোগ উত্থাপন করেছেন।
ইমরান খানের পুরো জীবনে সবচেয়ে বড় পরীক্ষার মুখে তিনি। তার রাজনৈতিক দক্ষতা এবং তার ঘনিষ্ঠ বলয়ে যারা আছেন তাদের মধ্যে অপরিপক্বতা দেখা দিয়েছে। জাতীয় পরিষদের দিকে ফোকাস না করে এবং রাজনৈতিকভাবে অনাস্থা প্রস্তাবকে পরাজিত করতে সমর্থন আদায়ে চেষ্টা করেছে সরকার। তারা সংবিধানের ৬৩ (এ)-এর বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের কাছে মতামত চেয়ে রেফারেন্স পাঠিয়েছে। কথিত দলত্যাগের অংশে ওইসব আইনপ্রণেতাদের বিষয়ে বলা আছে, যারা দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে ভোট দেবেন। সরকারের যুক্তি এই ধারাকে ব্যবহার করে এসব সদস্যদের আসন শূন্য করা যাবে, তাদের ভোটকে গণনা করা হবে না অথবা সারা জীবনের জন্য তারা অযোগ্য হবেন। কিন্তু পার্লামেন্টের বাইরে গিয়ে সরকার রাজনৈতিক সমস্যা সমাধানের উদ্যোগ নিয়েছে। এতেই প্রমাণ হয় যে, জাতীয় পরিষদে সরকারের আস্থায় সংকট রয়েছে। রাজনৈতিক ইস্যুকে সুপ্রিম কোর্টে নিয়ে যাওয়া একটি সুপরিচিত পন্থা। কিন্তু আসল ঘটনা থেকে দৃষ্টি অন্যদিকে সরিয়ে দেয়া হলে এসব বিষয় রাজনৈতিক নেতারা এবং আইনপ্রণেতারা সমাধান করলে সেটাই উত্তম।
সরকারের প্রচেষ্টার সঙ্গে দ্বিমত প্রকাশ করে একটি ধারণা বেরিয়ে আসে সুপ্রিম কোর্ট বার এসোসিয়েশন থেকে। তারা আদালতে লিখিতভাবে জানায় যে, জাতীয় পরিষদে ভোট হলো প্রতিজন সদস্যের ব্যক্তিগত অধিকার। সংবিধানের অধীনে জাতীয় পরিষদের সব সদস্যই এই অধিকার অবাধে চর্চা করতে পারা উচিত। তারা আরও বলে যে, সংবিধানের ৬৩ (এ) ধারায় আলাদাভাবে কোনো আইনপ্রণেতার পদক্ষেপকে অযোগ্য হতে দেয়া উচিত নয়।
সামনেই পার্লামেন্টে শোডাউন। সরকারের সঙ্গে এখনো জোটে আছে তিনটি দল। তাদের অবস্থানের ওপর অনেক কিছু নির্ভর করছে। এর মধ্যে পিএমএলকিউ, এমকিউএম এবং বেলুচিস্তান আওয়ামী পার্টির মোট ভোট আছে ১৭টি। ইমরান খানকে তারাই উল্টে দিতে পারেন, যদি তারা বিরোধীদের পদক্ষেপে সমর্থন করেন। এতে সরকারের বর্ণনা আরও দুর্বল হবে যে, বিরোধী দল অর্থ ব্যবহার করে ভিন্নমতাবলম্বী পার্লামেন্ট সদস্যদের কিনে নিয়েছে। এখন জোটের হিসেবে ওই তিনটি অংশীদার নিশ্চয় সরকার ও বিরোধী দল উভয়ের সঙ্গে কঠোর দরকষাকষি করবে। তারা সরকারের সঙ্গে দরকষাকষি করবে তাদের দাবিকে দীর্ঘদিন উপেক্ষিত রাখার জন্য।
যদিও সরকারের বিরুদ্ধে যাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে প্রতিকূলতা, তবু এখনো এই ভোট যেকোনো দিকে ঘুরে যেতে পারে। এখনো যেহেতু ভোটের কয়েকদিন বাকি তাই এর ফল কি আসবে সে সম্পর্কে পূর্বাভাস দেয়া বিপজ্জনক। তবে যা সুনিশ্চিত তা হলো রাজনৈতিক উত্তেজনাকর পরিস্থিতিকে ঠাণ্ডা করতে সহায়ক হবে না বিলম্ব। সরকার ও বিরোধী দলগুলোর আয়োজিত র‌্যালি একে আরও উদ্বায়ী করে তুলেছে। বিপুল জল্পনাকল্পনা আছে যে, প্রধানমন্ত্রী বড় ও বিস্ময়কর প্রতিশ্রুতি দিয়ে পরিস্থিতিকে তার নিজের পক্ষে নিতে পারেন। অনাস্থা ভোটে যে পক্ষই বিজয়ী হোক না কেন, এরপর পাকিস্তানে একটা সময় পর্যন্ত অস্থিতিশীলতা থাকবে। এমনকি অশান্তি অপেক্ষা করছে সামনে। দুর্ভাগ্যজনক হলো পাকিস্তানের রাজনীতিতে প্রচলিত একটি ধারা আছে। তা হলো পরাজিতরা খুব কমই পরাজয় মেনে নেয়।
(লেখক যুক্তরাষ্ট্র, বৃটেন ও জাতিসংঘে পাকিস্তানের সাবেক রাষ্ট্রদূত। তার এ লেখাটি অনলাইন ডন থেকে অনুবাদ)   

RELATED ARTICLES
- Advertisment -
Google search engine

Most Popular

Recent Comments