চাঞ্চল্যকর জান্নাতুল ফেরদৌস হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যে কী- এ নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। চুরির ঘটনাকে কেন্দ্র করে হত্যাকাণ্ডের বিষয়টি মেনে নিচ্ছে না নিহতের স্বজনরা। এমন কি বাসা থেকে কোনো কিছু খোয়া না যাওয়া ও একজন ব্যক্তি কর্তৃক মেডিকেল কলেজের ছাত্রী জান্নাতকে হত্যার বিষয়টি রহস্যময় বলে দাবি করেছেন তারা। এই হত্যার নেপথ্যে জান্নাতের স্বামীর ‘পরকীয়ার সম্পর্ক’ অন্যতম কারণ বলে অভিযোগ করেছেন জান্নাতের স্বজনরা। এ বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত অব্যাহত রেখেছে বলে জানিয়েছে পুলিশ।
নিহতের ঘনিষ্ঠরা জানান, জান্নাতুল ফেরদৌস ছিলেন চাপা স্বভাবের। সহজে কিছু বলতেন না। প্রায় সাত বছর আগে প্রেম করে বিয়ে করেছিলেন ট্র্যাভেল এজেন্সিতে কর্মরত মোস্তাফিজুর রহমান সোহেলকে।
প্রেমের বিয়ে হওয়ার কারণে স্বামীর অনেক অত্যাচার নীরবে সহ্য করতেন জান্নাত। সহজে কষ্টের কথা বলতেন না। হত্যাকাণ্ডের আগের দিন বড় বোন লাকীকে বলেছিলেন, ‘এই পৃথিবীতে আমার কোনো শত্রু নেই, সোহেলের (স্বামী) ভাবী ছাড়া।’ নিহতের স্বজনরা জানান, মোস্তাফিজুর রহমান সোহেলের সবুজবাগের দক্ষিণগাঁও এলাকার বাসার পাশেই মোস্তাফিজের ভাবী তারিকা খানমের বাসা। তিনি একজন শিক্ষিকা। তার স্বামী চাকরির সুবাদে ঢাকার বাইরে থাকেন। জান্নাতের স্বজনদের অভিযোগ, ভাবীর সঙ্গে অন্তরঙ্গ সম্পর্ক সোহেলের। হত্যাকাণ্ডের আগে এ বিষয়ে জান্নাত তাদের জানিয়েছে, অফিস থেকে ফিরে সোহেল প্রথমে ভাবীর বাসায় যেতেন। সেখানে দেড়-দু’ঘণ্টা থাকার পর বাসায় ফিরতেন তিনি। এ নিয়ে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে দ্বন্দ্ব বাড়তে থাকে। বাসাবো নন্দীপাড়ার ১০ নম্বর সড়কের ৬৩ নম্বর বাড়িতে উঠার আগে ভাবী তরিকা খানমের পাশের ফ্ল্যাটেই স্ত্রী জান্নাতকে নিয়ে ভাড়া থাকতেন সোহেল। সেখানে থেকেই কলহের শুরু।
জান্নাতের পরিবারের সদস্যরা অভিযোগ করেছেন, দেবর-ভাবীর মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক রয়েছে। ওই সম্পর্কে বাধা হওয়ার কারণেই জান্নাতকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে। চাঞ্চল্যকর এই হত্যা মামলায় শরীয়তপুর জেলার গোসাইরহাটের চরদীপুর গ্রামের মঙ্গল হাওলাদারের পুত্র মনির হাওলাদারকে পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে। সে নন্দীপাড়ার ওই বাড়িতে নির্মাণ শ্রমিক হিসেবে কাজ করতো। এ ঘটনায় ১৬৪ ধারায় আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিও দিয়েছে মনির। জবানবন্দিতে মনির জানিয়েছে, গত ১৪ই সেপ্টেম্বর রাত সাড়ে ৮টার দিকে চুরি করার উদ্দেশ্যে বাসায় ঢুকে মনির। এসময় জান্নাত তাকে দেখে চিৎকার করলে ছুরি দিয়ে তাকে আঘাত করে। একপর্যায়ে গলায় ছুরি দিয়ে আঘাত করে জান্নাতকে হত্যা করে।
পুলিশ জানিয়েছে, আশেপাশের লোকজন জান্নাতের চিৎকার শুনে বিষয়টি ফোনে তার স্বামীকে জানায়। পরে স্বামী মোস্তাফিজুর রহমান সোহেল বাসায় ফিরে জান্নাতের পিতা রোস্তম আলীসহ স্বজনদের ফোনে বাসায় ডেকে নেন। খবর পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছে লাশ উদ্ধার করে। এর কিছু সময় পরে পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নেতৃত্বে ওই বাড়িতে অভিযান পরিচালনা করা হয়। এ সময় ষষ্ঠ তলার নির্মাণাধীন ছাদে সাটারিংয়ের বাঁশের চিপায় মনিরকে দেখতে পায় পুলিশ। তাৎক্ষণিকভাবে ধারালো অস্ত্র দিয়ে পুলিশের ওপর হামলা চালায় মনির। এসময় পুলিশের দুই কর্মকর্তা আহত হন। তখন পুলিশ এক রাউন্ড গুলি বর্ষণ করে। তাৎক্ষণিকভাবে চাপাতিসহ মনিরকে গ্রেপ্তার করা হয়।
এ ঘটনায় দায়েরকৃত মামলার বাদী জান্নাতের পিতা রোস্তম আলী অভিযোগ করেন, ৫০ হাজার টাকার বিনিময়ে মনিরকে দিয়ে জান্নাতকে হত্যা করানো হয়েছে। গ্রেপ্তারের পর মনির বিষয়টি প্রথমে স্বীকার করেছে। কিন্তু আদালতে এ বিষয়ে তথ্য দেয়নি। এ ঘটনায় জান্নাতের স্বামী মোস্তাফিজুর রহমান সোহেল ও তার ভাবী তারিকা খানম জড়িত। পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী মনির বাসায় ঢুকে তার মেয়েকে গলা কেটে হত্যা করেছে বলে অভিযোগ করেন তিনি। রোস্তম আলী বলেন, হত্যাকাণ্ডকে চুরির ঘটনা হিসেবে সাজানো হয়েছে। অথচ ঘর থেকে কিছুই খোয়া যায়নি। জান্নাতের গলায় স্বর্ণের চেইন ছিল, ঘরে টাকা-পয়সা ছিল। সবুজবাগ থানার পরিদর্শক (তদন্ত) খন্দকার নাসির উদ্দিন বলেন, মূলত চুরি করতে বাধা দেয়ায় এই হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। এখন পর্যন্ত এই হত্যাকাণ্ডে মনির ছাড়া অন্য কারও সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যায়নি। তবে নিহতের পরিবারের অভিযোগকে তদন্তে গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে বলে জানান তিনি।
জান্নাতুল উত্তরার কানাডা-বাংলাদেশ মেডিকেলের শিক্ষার্থী ছিলেন। একসময় তিনি মোস্তাফিজুর রহমান সোহেলের ভাবী তারিকা খানমের কাছে প্রাইভেট পড়তেন। সেই থেকেই সোহেলের সঙ্গে জান্নাতের প্রেমের সম্পর্ক গড়ে উঠে। প্রায় সাত বছর আগে পরিবারের অমতে সোহেলকে বিয়ে করেন জান্নাত। সবুজবাগের কুসুমবাগের বাসিন্দা রোস্তম আলীর তিন সন্তানের মধ্যে সবার ছোট জান্নাত। তাদের গ্রামের বাড়ি চাঁদপুরের মতলব উপজেলার মাসুনডা গ্রামে। জারিফ বিন নামে সোহেল-জান্নাত দম্পতির দেড় বছরের একটি ছেলে সন্তান রয়েছে। মা-হীন শিশুটি এখন নানার বাড়িতে বড় হচ্ছে। জান্নাত হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে তার স্বামী মোস্তাফিজুর রহমান সোহেল জানান, দু’জনের মধ্যে কোনো কলহ ছিল না। তিনি স্ত্রীকে অত্যন্ত ভালোবাসতেন। নিজ ভাবীর সঙ্গে প্রেমের সম্পর্কের অভিযোগের বিষয়ে তিনি বলেন, তিনি আমার মায়ের মতো। আমি যখন সপ্তম শ্রেণিতে পড়ি, তখন তিনি বড় ভাইয়ের বউ হয়ে এই বাড়িতে আসেন। তিনি বলেন, এই হত্যাকাণ্ডে আমাকে ফাঁসানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। শ্বশুরবাড়ির লোকজন আমার বাচ্চাকেও দেখতে দিচ্ছে না।