নিউইয়র্কের বাঙালী অধ্যুষিত জ্যামাইকায় ‘লিটল বাংলাদেশ এভিনিউ’র নামফলক উন্মোচন করা হয়েছে। ২১ ফেব্রুয়ারি সোমবার অপরাহ্নে জ্যামাইকার ১৬৯ স্ট্রিট এবং হোমলান অ্যাভিনিউ এলাকায় আনুষ্ঠানিকভাবে নামফলক উন্মোচন করেন রাস্তার রি-নেমিং ‘লিটল বাংলাদেশ এভিনিউ’র রূপকার স্থানীয় কাউন্সিলম্যান জেমস এফ জিনারো। এখান থেকে হিলসাইড এভিনিউ ধরে অন্তত দু’টি ব্লক ‘লিটল বাংলাদেশ এভিনিউ’ নামে পরিচিত হবে। এসময় শত শত প্রবাসী বাংলাদেশি জয়-বাংলা স্লোগান আর বিপুল করতালির মধ্য দিয়ে আনন্দ-উল্লাসে মেতে ওঠেন। প্রবাসীরা এ ঐতিহাসিক উদ্যোগের জন্য কাউন্সিলম্যান জেমস এফ জিনারোসহ সংশ্লিষ্টদের প্রতি গভীর কৃতজ্ঞতা জানান।
কাউন্সিলম্যান জেমস জিনারো নামফলক নিয়ে অনুষ্ঠান স্থলে আসার আগে এই নামকরণের কৃতিত্ব নিয়ে অনেকে নানামুখি বক্তব্য দেন। এনিয়ে বিবাদমান জ্যামাইকার বাংলাদেশী কমিউনিটির মধ্যে চাপা উত্তেজনা দেখা দেয়। এমন উত্তেজনার মধ্যেই কাউন্সিলম্যান জেমস এফ জিনারো পুলিশ ডেকে নিজ ব্যবস্থাপনায় উদ্বোধনী পর্বটি নিজে পরিচালনা করেন। এ সময় বক্তব্য রাখেন স্টেট এসেম্বলীওমেন জেনিফার রাজকুমার, এসেম্বলীম্যান ডেভিড ওয়েপ্রিন, কুইন্স ডিষ্ট্রিক্ট এটর্নি মেলিন্ডা কার্টজ, কাউন্সিলওমেন নাতাশা উইলিয়ামস, নিউইয়র্কে বাংলাদেশের কনসাল জেনারেল ড. মোহাম্মদ মনিরুল ইসলাম, মূলধারার রাজনীতিক আমিন উল্লাহ, আব্দুর রশিদ প্রমুখ। অনুষ্ঠানে শহীদ মুক্তিযোদ্ধা এবং ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে এক মিনিট নিরবতা পালন করা হয়। এর পর শ্রীচিন্ময় সেন্টারের শিল্পীরা বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় সঙ্গীতের পর মহান একুশের অবিস্মরণীয় সেই ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি-আমি কী ভুলিতে পারি’-গানটি পরিবেশ করেন।
এসময় কাউন্সিলম্যান জেমস জিনারো ‘লিটল বাংলাদেশ এভিনিউ’ রি-নেমিং ফলক উম্মোচনের দিনটিকে ২১ ফেব্রুয়ারি বেছে নেয়া প্রসঙ্গে বলেন, বায়ান্নর ২১ ফেব্রুয়ারি মাতৃভাষার জন্য বাঙালি তরুণেরা জীবন উৎসর্গ করেছেন। সেই আন্দোলনের পথ ধরে একাত্তরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের ডাকে বাঙালিরা স্বাধীনতা অর্জন করেন। পরবর্তীতে ২১ ফেব্রুয়ারিকে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’-এ পরিণত করে জাতিসংঘ। এমন একটি ঐতিহাসিক-স্মরণীয় দিনে ‘লিটল বাংলাদেশ এভিনিউ’র উদ্বোধন হওয়ায় প্রবাসী বাংলাদেশীরা আরো উৎফুল্ল হন।
নিউইয়র্কে বাংলাদেশের কন্সাল জেনারেল ড. মনিরুল ইসলাম ব্যস্ততম হিলসাইড এলাকায় ‘লিটল বাংলাদেশ এভিনিউ’ রি-নেমিং করায় কাউন্সিলম্যান জেমস জিনারোকে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ জানান। ড. মনিরুল ইসলাম বলেন, বহুজাতিক এই সমাজে বাঙালিরা তাদের মেধা আর শ্রমে অবদান রাখছেন। এর মূল্যায়নও ঘটছে নানাভাবে। ‘লিটল বাংলাদেশ এভিনিউ’ রাস্তার নামকরণে তা আরো দৃশ্যমান হলো। তিনি মাতৃভূমি বাংলাদেশের চলমান উন্নয়ন আর সমৃদ্ধির স্বার্থে প্রবাসীদের ঐক্যবদ্ধ থাকার আহ্বান জানান।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে কাউন্সিলম্যান জেমস জিনারো বেশ ক’জন বাংলাদেশীর নামোল্লেখ করে ধন্যবাদ জানানোর সময় তুমুল হৈচৈ শুরু হয়। এনিয়ে কয়েকজন আপত্তি তুলে বলেন, সত্যিকার অর্থে যারা কমিউনিটির উন্নয়নে মূলধারায় কাজ করছেন, তারা এখানে উপেক্ষিত হয়েছেন। এ অবস্থায় বিব্রত কাউন্সিলম্যান নিজের সীমাবদ্ধতার কথা স্বীকার করে বলেন, যারা এই রাস্তার নামকরণে নানাভাবে সহায়তা করেছেন শিগগিরই তাদের নিয়ে সংশোধিত তালিকা প্রকাশ করা হবে।
এদিকে ‘লিটল বাংলাদেশ এভিনিউ’র নামফলক উন্মোচনের পর জ্যামাইকা বাংলাদেশ ফ্রেন্ডস সোসাইটির পক্ষ থেকে সভাপতি ফখরুল ইসলাম দেলোয়ার ও সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আল আমীন রাসেল সহ কয়েকজন কাউন্সিলম্যান জেমস জিনারোকে কমিউনিটির পক্ষ থেকে কৃতজ্ঞতাসূচক ক্রেস্ট প্রদান করেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, সিটি হলে গত বছরের ডিসেম্বর মাসে ‘লিটল বাংলাদেশ এভিনিউ’ সংক্রান্ত বিলটি পাস হয়। এই বিল পাশে স্থানীয় কাউন্সিল ডিস্ট্রিক্ট-২৪ এর কাউন্সিলম্যান জিম এফ জিনারোর উদ্যোগ ও ভূমিকা ছিল। বাংলাদেশ বা দেশের বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের নামে জ্যামাইকায় একটি রাস্তার নামকরণ হোক। সেই দাবির লক্ষ্যে দীর্ঘদিন ধরে স্থানীয় কাউন্সিলম্যান জিম এফ জিনারোর মাধ্যমে কুইন্স বরো হল ও সিটি প্রশাসনের কাছে বিভিন্ন পর্যায়ে লবিং চলছিল। জানা গেছে. একটি মহলের পক্ষ থেকে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-এর নামে এবং অপর একটি মহল বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষক শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান বীরউত্তম-এর নামে একটি রাস্তার নামকরনের দাবি উঠেছিল। এই দুই মহলের বাইরে অপর একটি মহল ‘বাংলাদেশ’ নামে রাস্তার নামকরণের দাবি করেন যাতে কোনো রাজনৈতিক বিভেদ সৃষ্টি না হয়। অবশেষে ‘লিটন বাংলদেশ এভিনিউ’ নামকরণ চূড়ান্ত করা হয় সিটি হলে। সিটি হলে পাস হওয়া বিলের নম্বর হচ্ছে- আইএনটি ২৪৭৭-২০২১। সিটি কাউন্সিলে বিলটি উত্থাপন করেন কাউন্সিল ডিস্ট্রিক্ট-২৪ এর কাউন্সিলম্যান জিম এফ জিনারো। সম্প্রতি নিউইয়র্ক সিটি কাউন্সিলে সিটির ১৯৯টি রাস্তার নাম বিশিষ্ট ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান ও দেশের নামে রি-নেমিং করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। এই সিদ্ধান্তের মধ্যে ‘লিটল বাংলাদেশ এভিনিউ’ রয়েছে।
নিউইয়র্ক সিটির পাঁচটি বরোর মধ্যে কুইন্সের জ্যামাইকা অন্যতম। জ্যামাইকা মুসলিম সেন্টারকে কেন্দ্র করে সেখানে বিস্তৃতি ঘটেছে বাংলাদেশি অভিবাসীদের। বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার বিপুল সংখ্যক বাংলাদেশি স্থায়ীভাবে বাস করছেন জ্যামাইকা এলাকায়। গড়ে উঠেছে একটি চমৎকার পরিবেশ। জ্যামাইকার হিলসাইড এভিনিউর সাটফিন থেকে শুরু করে কুইন্স ভিলেজসহ আশপাশের এলাকায় বিপুল সংখ্যক বাংলাদেশি বসবাস করছেন। হিলসাইড এভিনিউর সাটফিনের ১৪৪ স্ট্রিট থেকে ১৭৫ স্ট্রিট পর্যন্ত বিশাল এলাকা জুড়ে গড়ে উঠেছে বাংলাদেশিদের ব্যবসা বাণিজ্য। এলাকাটি এক টুকরো বাংলাদেশে পরিণত হয়েছে। আর এই এক টুকরো বাংলাদেশকেই আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি প্রদানের উদ্যোগ নিয়েছে নিউইয়র্ক সিটি কর্তৃপক্ষ। জ্যামাইকার হিলসাইড এভিনিউ ১৪৪ স্ট্রীট থেকে বাংলাদেশি ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের কেন্দ্র বিন্দুকে ‘লিটল বাংলাদেশ এভিনিউ’ নামকরণ করা হয়েছে। বিশেষ করে ১৬৯ স্ট্রিট, হোমলন স্ট্রিট ও হিলসাইড এভিনিউর সংযোগস্থলটি প্রাধান্য পেয়েছে এই নামকরণের কেন্দ্র হিসেবে। এর আগে জ্যামাইকা মুসলিম সেন্টারের সামনে ১৬৮ স্ট্রিটটির নামকরণ করা হয় ‘জেএমসি ওয়ে।’
সেখানে উপস্থিত একজন প্রবাসী বলেন, অবশেষে দীর্ঘ্য ৫০ বছর পর বাংলাদেশী কমিউনিটি কিছু অর্জন ও স্বীকৃতি পেল। প্রবাসী বাংলাদেশিদের দীর্ঘদিনের দাবির মুখে সিটি প্রশাসন হিলসাইড এভিনিউ থেকে হোমলন এভিনিউ পর্যন্ত ‘লিটল বাংলাদেশ এভিনিউ’ নামকরণের এ সিদ্ধান্ত নেয়।