Monday, March 27, 2023
spot_img
Homeনির্বাচিত কলামনভেম্বর এলেই প্রশ্ন জাগে ডা. মিলন, নূর হোসেনরা কেন জীবন দিলেন?

নভেম্বর এলেই প্রশ্ন জাগে ডা. মিলন, নূর হোসেনরা কেন জীবন দিলেন?

কাজল ঘোষ

প্রশ্ন হচ্ছে, রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় আসবে দেশ চালাবে একটি শক্তিশালী নির্বাচনী ব্যবস্থার মধ্যদিয়ে ক্ষমতার রদবদল হবে। এটাই স্বাভাবিকভাবে হওয়ার কথা। কিন্তু এখানে পরিস্থিতি পুরনো পথেই হাঁটছে। কেন নির্বাচনী ব্যবস্থা নিয়ে বিবদমান দলগুলোর মধ্যে দশকের পর দশক লড়াই চালিয়ে যেতে 
হবে? দুঃখের বিষয় হচ্ছে, বর্তমানে সরকারে ও বিরোধী দলে থাকা সকল রাজনৈতিক দলই গণতন্ত্রের জন্য রাজপথে লড়েছেন, ভোটের অধিকার নিয়ে সোচ্চার ছিলেন কিন্তু যখনই যারা ক্ষমতা পেলেন তখনই তাদের আসল চেহারা বেরিয়ে এলো। মুখে যতই গণতন্ত্রের কথা বলুক তারা তা কি তাহলে মুখোশ

প্রশ্নটি কোনো রাজনৈতিক দলের কাছে নয়। প্রশ্নটি একান্তই নিজের কাছে। নিজের বিবেকের কাছে। রাজনীতিক বা রাজনৈতিক দলের কাছে করলে এটি দায়সারা হয়ে যাবেই বলে মনে হয়। নূর হোসেন পুরনো ঢাকার বনগ্রামের গলিপথের মানুষ ছিলেন। আমারও বেড়ে ওঠা পুরনো ঢাকার ওই গলিপথেই।

খানিকটা একই এলাকার বলেই কি? না তা নয়। নূর হোসেন আজ কোনো সাধারণ ব্যক্তির নাম নয়। নূর হোসেন একটি ইতিহাস। কিন্তু সেই রক্তাক্ত ইতিহাসের পরিণতি কি? তিনি বুকে- পিঠে যে স্লোগান লিখে জীবন দিলেন তার মর্যাদা দেশের রাজনীতিকরা কতটা রেখেছেন। টগবগে যুবক নূর হোসেন রাজপথের লড়াইয়ে মুষ্টিবদ্ধ হাত উঁচু করে মিছিলে নামলেন। ‘স্বৈরাচার নিপাত যাক, গণতন্ত্র মুক্তি পাক’। বুলেটে বক্ষ বিদীর্ণ করে তাজা রক্তে ভেসে গেল ঢাকার রাজপথ। দুনিয়াজুড়ে নতুন বাংলাদেশে দেখলো মানুষ। যেখানে গণতন্ত্রের জন্য মানুষ জীবন দেয়। একইরকম ঘটনা ডা. মিলনের ক্ষেত্রেও হয়েছে। আন্দোলনে যোগ দেয়ার পথেই দুর্বৃত্তরা তার বুক ঝাঁঝরা করে দিয়েছে গুলিতে।

আমি তখন খুব ছোট। নিয়মিত খবরের কাগজ পড়ি। দেশের রাজনীতির খবরাখবরে পিতার ইচ্ছাতেই যুক্ত থাকি। ইচ্ছাতে বললাম এই জন্য, আমার প্রয়াত পিতা তখন চোখের সমস্যায় ভুগছিলেন। ছোট ছোট অক্ষর দেখতে খুবই সমস্যা হতো। দিনের কোনো এক সময় আমাকে খবরের কাগজ পড়ে রাজনীতির খবরগুলো ওনাকে বলতে হতো। আমি খুব জোরে জোরে রিডিং পড়তাম। পিতাকে বলতে গিয়ে আমার নিজেরও রাজনীতির গতি-প্রকৃতি সম্পর্কে একটি ধারণা তৈরি হয়ে যায় সেই সময় থেকেই। হরতাল, অবরোধ আর সচিবালয় ঘেরাওয়ের ধারাবাহিক কর্মসূচি চলছিল পনের দল আর সাত দলের। দু’নেত্রী সভা-সমাবেশের মধ্য দিয়ে মানুষকে উজ্জীবিত করেছেন গণতন্ত্রের পথে আসতে। নয় বছরের স্বৈরশাসক এরশাদ ও তার সমর্থকরা দেশের বিভিন্ন স্থানে তৎকালীন কর্মসূচিতে বাধা দিয়ে বহুরকমের প্রতিবন্ধকতা তৈরি করেছে সে সময়। মিডিয়া বাধাবিঘ্ন আর সামরিক ফরমান উপেক্ষা করেও খবর প্রকাশে পিছপা হয়নি। মনে আছে, সে সময় প্রকৃত চিত্র জানতে মানুষের কাছে অনিবার্য ছিল বিবিসি। 

সকাল সাতটা আর সন্ধ্যে সাড়ে সাতটায় বিবিসি বাংলা রেডিওর খবর আর প্রবাহ শুনতে মানুষ হুমড়ি খেয়ে পড়তো দোকানে দোকানে। বিবিসি বাংলা ছিল ভরসা। একাধিকবার সচিবালয় ঘেরাও কর্মসূচি দেখার জন্য বাসায় না বলে লুকিয়ে লুকিয়ে বঙ্গভবনের পাশের রাস্তা দিয়ে বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে ছুটে গেছি। কিন্তু কিছু বুঝে আর না বুঝেও মনে হয়েছে দেশের মানুষের জন্য গণতন্ত্রই পারে সুশাসন নিশ্চিত করতে। একসময় সকল শ্রেণি- পেশার মানুষ রাজপথের আন্দোলনের মধ্য দিয়ে এরশাদের পতন ঘটায়। তিনদলীয় ঐক্যজোট একটি রূপরেখা প্রণয়নের মধ্য দিয়ে দেশের গণতন্ত্র বিকাশের পথকে মসৃণ করে। কিন্তু এতদিন পরেও প্রশ্ন জাগে কেন এতগুলো মানুষ সেদিন রাজপথে জীবন দিয়েছিল? ১৯৯০ এর পর থেকে এখনও পর্যন্ত প্রথম কয়েকটি নির্বাচন ছাড়া আর কোনও বিতর্ক মুক্ত নির্বাচন সম্পন্ন হয়নি দেশে। পরপর তিনবার তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। প্রথমে ক্ষমতায় আসে বিএনপি, তারপর আওয়ামী লীগ, তারপর বিএনপি, ফের আন্দোলন, মাঝখানে সামরিক সমর্থিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকার, আবারও আওয়ামী লীগ। টানা এখন এভাবেই চলেছে। যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি নিয়ে আওয়ামী লীগ দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রাম করেছে তারাই ক্ষমতায় এসে তা বাতিল করেছে। পরবর্তীতে তাদের অধীনে যে ধরনের নির্বাচন হয়েছে তাতে দেশের মানুষ হতাশই হয়েছে।  বর্তমানে বিএনপি আবারও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আন্দোলন শুরু করেছে। একই রকমের গোলকধাঁধার মধ্যেই চলছে। যখন যারাই ক্ষমতায় তারাই মসনদ আঁকড়ে ধরতে চেয়েছে। কথা হচ্ছে, যদি গণতন্ত্রের জন্যই ডা. মিলন, নূর হোসেনরা জীবন দিলেন সেই গণতন্ত্র কি বেহাত হয়ে গেল। যেই ভোটের অধিকার আদায় করতে গিয়ে আমাদের নেতানেত্রীরা রাজপথে দীর্ঘ লড়াই করলেন তারা কি সেই অধিকার প্রতিষ্ঠা এখনও করতে পারেননি, নাকি ক্ষমতায় গিয়েই জনগণকে দেয়া সেসকল প্রতিশ্রুতি বেমালুম ভুলে গেছেন?    

নূর হোসেনের শহীদ হওয়ার উত্তাল সেই দিনগুলো নিয়ে বিবিসি’র মোয়াজ্জেম হোসেন লিখেছেন,  ১০ই নভেম্বর, ১৯৮৭ সাল। প্রেসিডেন্ট এরশাদের পদত্যাগ এবং গণতন্ত্রের দাবিতে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার সচিবালয় অবরোধের ডাক দিয়েছিল বিরোধী দলগুলো। অবরুদ্ধ নগরীতে সেদিন রাস্তায় নেমেছিল এক তরুণ, নূর হোসেন। তার বুকে ও পিঠে স্বৈরতন্ত্রের পতন আর গণতন্ত্রের দাবিতে লেখা স্লোগান। গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যাওয়ার আগে তোলা নূর  হোসেনের ছবি পরবর্তীকালে হয়ে ওঠে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক আকাক্সক্ষার প্রতীক। এক শ্রমজীবী নিম্নবিত্ত পরিবারের এই তরুণ কী  ভেবে সেদিন নিজের শরীরকে জীবন্ত পোস্টার করে তুলেছিলেন? কে তার শরীরে লিখে দিয়েছিল এই  স্লোগান? সেদিন শাহবাগ পুলিশ কন্ট্রোল রুমে ঝাঁকড়া চুলের শ্যামলা রঙের  ছেলেটিকে আমরা যখন  দেখি, তখন তার দেহ রক্তাক্ত। কিন্তু তার শরীরে সাদা রঙে লেখা স্লোগান তখনো জ্বলজ্বল করছে। আমরা তখনো জানি না,  ছেলেটি কে, কী তার নাম। ততক্ষণে সেখানে পড়ে থাকা দেহগুলো দেখে  বোঝার উপায় নেই তারা জীবিত না মৃত। ছোট্ট  সেলটিতে যেভাবে তাদের ফেলে রাখা হয়েছিল, তাতে বোঝা যাচ্ছিল না শরীরের কোন অংশটি কার। একজনের শরীরের নিচে চাপা পড়েছে আরেকজনের শরীর। সেই বীভৎস দৃশ্যে বেশিক্ষণ  চোখ রাখা মুশকিল। কিন্তু একই সঙ্গে একজনের শরীরের উর্ধাঙ্গে সাদা রঙে  লেখা স্লোগান এক তীব্র ধাক্কা দিয়েছিল আমাদের। আমরা জানতাম না, এই তরুণের নাম নূর হোসেন।

গণতন্ত্রের জন্য জীবন দেয়া আরেকটি নাম ডা. শামসুল আলম খান মিলন। ২৭শে নভেম্বর ১৯৯০ দেশব্যাপী রাজপথ- রেলপথ অবরোধ আন্দোলন চলছিল। ওইদিন বাংলাদেশ  মেডিকেল এসোসিয়েশনের একটি সভায় যোগ দিতে রিকশাযোগে পিজি হাসপাতালে যাচ্ছিলেন ডা. মিলন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি এলাকা অতিক্রমকালে  স্বৈরাচার সরকারের সমর্থক সন্ত্রাসীরা তার ওপর গুলি চালায়। তাৎক্ষণিকভাবে তার মৃত্যু হয়। 
এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে তীব্র থেকে তীব্রতর হয় এই দু’জনের আত্মত্যাগের পর। দু’জনই আত্মত্যাগ করেছিলেন দেশের গণতন্ত্রের জন্য। প্রশ্ন হচ্ছে- সেই গণতন্ত্র কি আমরা আদৌ পেয়েছি। যাদের ডাকে রাজপথের আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল এদেশের আমজনতা সেই রাজনীতিকরাই কি কথা রেখেছেন? যদি রাখতেন তাহলে কি দিনের পর দিন যুগের পর যুগ ভোটের অধিকারের জন্য রাজপথের লড়াই অব্যাহত রাখতে হতো?  
ফের পুরনো বোতলে রাজনীতি। আলোচনায় মাঠের খেলায় জিতবে কারা? অনেকদিন পর সেই পুরনো চিত্র। ৩০শে অক্টোবর খবরের কাগজে প্রথম পাতায় পাশাপাশি দু’টি ছবি। একটি ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের অন্যটি ক্ষমতার বাইরে থাকা প্রধান বিরোধীদল বিএনপি’র। প্রতিদিন যারা খবরের কাগজে চোখ বুলিয়ে দিন শুরু করেন তাদের জন্য এই ছবি অনেকদিনের পুরনো আর্কাইভে ফিরিয়ে নিয়ে গেল পাঠকদের। দুই দলের মহাসচিব কথা বলেছেন চলমান রাজনীতি নিয়ে। মাঠের রাজনীতি যেন আগের চেহারায় গড়াচ্ছে। আলোচনা চলছে খেলা নিয়ে। পরিস্থিতি ধীরে ধীরে অনড় অবস্থার দিকে এগুচ্ছে। হালে রাজনীতির মাঠে খেলা শব্দটি খুব জনপ্রিয়তা পেয়েছে। কলকাতার ফিল্মের ব্যবহৃত একটি সংলাপ নারায়ণগঞ্জে আওয়ামী লীগ সংসদ সদস্য শামীম ওসমানের মাধ্যমে আলোচনায় আসে। শাসকদলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের ও বিএনপি নেতাদের মুখেও প্রায়ই আলোচনায় আসছে, খেলা হবে।

 এরইমধ্যে বিএনপি নেতা আমানউল্লাহ আমানের একটি বক্তব্য রাজনীতির মাঠে ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছে। ১০ই ডিসেম্বরের পর দেশ চলবে খালেদা জিয়ার কথায়। এ বক্তব্যের পর নানা মহলে আলোচনা- কী হবে ১০ই ডিসেম্বরের পর। অনেকেই আওয়ামী লীগের প্রয়াত নেতা আব্দুল জলিলের ৩০শে এপ্রিলের ট্রাম্প কার্ডের সঙ্গেও একে মেলাচ্ছেন। সে সময়ের লগি-বৈঠার আন্দোলনের কথা নিশ্চয়ই অনেকের মনে থাকবে। প্রশ্ন হচ্ছে, রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় আসবে দেশ চালাবে একটি শক্তিশালী নির্বাচনী ব্যবস্থার মধ্যদিয়ে ক্ষমতার রদবদল হবে। এটাই স্বাভাবিকভাবে হওয়ার কথা। কিন্তু এখানে পরিস্থিতি পুরনো পথেই হাঁটছে। কেন নির্বাচনী ব্যবস্থা নিয়ে বিবদমান দলগুলোর মধ্যে দশকের পর দশক লড়াই চালিয়ে যেতে হবে? দুঃখের বিষয় হচ্ছে, বর্তমানে সরকারে ও বিরোধীদলে থাকা সকল রাজনৈতিক দলই গণতন্ত্রের জন্য রাজপথে লড়েছেন, ভোটের অধিকার নিয়ে সোচ্চার ছিলেন কিন্তু যখনই যারা ক্ষমতা পেলেন তখনই তাদের আসল চেহারা বেরিয়ে এলো। মুখে যতই গণতন্ত্রের কথা বলুক তারা তা কি তাহলে মুখোশ। তাদের ভেতরে কি তাহলে স্বৈরতন্ত্রের বাস? গণতন্ত্র কি তাহলে রাজনীতিকদের ক্ষমতা দখলের লেবাস? অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, বিচার মানি কিন্তু তালগাছটি আমার। রংপুরের আঞ্চলিক ভাষায় একটি প্রবাদ আছে- ‘হচহছাও খচখছাও ওপরত ছিটাও পানি, তোমার মনোত কি আছে এইডা আমি জানি।’ দুঃখজনক হলেও সত্য, আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর অবস্থাও রংপুরের সেই প্রবাদের মতোই।

RELATED ARTICLES
- Advertisment -
Google search engine

Most Popular

Recent Comments