Thursday, November 30, 2023
spot_img
Homeধর্মধর্মীয় বিষয়ে বক্তৃতার শর্ত ও সতর্কতা

ধর্মীয় বিষয়ে বক্তৃতার শর্ত ও সতর্কতা

ইসলামের সার্বিক বিষয়াবলি অন্যের কাছে উপস্থাপনের জন্য বক্তব্য একটি অন্যতম মাধ্যম, যা যুগ যুগ ধরে চলে আসছে। মানুষের ব্যক্তিজীবনের পরিশুদ্ধি ও আকিদা-বিশ্বাসের সংশোধন এবং ব্যাবহারিক জীবনে ইসলামের অনুশীলনের ক্ষেত্রে ধর্মীয় বক্তব্যের গুরুত্ব অপরিসীম। তবে বক্তব্য কার্যকর ও ফলপ্রসূ করতে ধর্মীয় বক্তার বেশ কিছু গুণাবলি এবং কিছু বিষয়ে সতর্ক থাকা প্রয়োজন।

একনিষ্ঠ হওয়া : সব দ্বিনি কাজে ইখলাস বা একনিষ্ঠতা একান্ত প্রয়োজন। ইখলাস হলো মহান আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে কাজ করা। ধর্মীয় বক্তার উদ্দেশ্য হতে হবে—মানুষকে ইহকালীন ও পরকালীন কল্যাণের পথনির্দেশ করে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করা। আল্লাহ বলেন, ‘তারা তো আদিষ্ট হয়েছিল আল্লাহর আনুগত্যে বিশুদ্ধচিত্ত হয়ে একনিষ্ঠভাবে তাঁর ইবাদত করতে এবং সালাত কায়েম করতে ও জাকাত দিতে, এটিই সঠিক দ্বিন।’ (সুরা বাইয়্যিনাহ, আয়াত : ৫)

কথা ও কাজে মিল থাকা : ধর্মীয় বক্তার জন্য কথা ও কাজে মিল থাকা খুবই জরুরি। নিজে আমল না করে বক্তব্য দেওয়া শ্রোতার মনে প্রভাব ফেলে না এবং তা ফলপ্রসূও হয় না। তা ছাড়া কথা-কাজে অমিল হওয়া কপটতার লক্ষণ এবং আল্লাহর কাছে খুবই অপছন্দনীয় কাজ। আল্লাহ বলেন, ‘হে মুমিনরা, তোমরা যা করো না তা তোমরা কেন বলো? তোমরা যা করো না তোমাদের তা বলা আল্লাহর দৃষ্টিতে অতিশয় অসন্তোষজনক।’ (সুরা সফ, আয়াত : ২-৩)

কোমল স্বভাবের অধিকারী হওয়া : নম্রতা-ভদ্রতা ও কোমলতা আদর্শ মানুষের গুণ। ধর্মীয় বক্তার মধ্যে এসব গুণ থাকা বাঞ্ছনীয়। এমন স্বভাবের অধিকারীদের বক্তব্য সহজে মানুষের মনে প্রভাব ফেলতে পারে। ফেরাউনের সঙ্গে কোমল আচরণের নির্দেশ দিয়ে মহান আল্লাহ মুসা ও হারুন (আ.)-কে বলেন, ‘তোমরা উভয়ে ফেরাউনের কাছে যাও, সে তো সীমা লঙ্ঘন করেছে। তোমরা তার সঙ্গে নম্র কথা বলবে, হয়তো সে উপদেশ গ্রহণ করবে অথবা ভয় করবে।’ (সুরা ত্বহা, আয়াত : ৪৩-৪৪) রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে সম্বোধন করে আল্লাহ বলেন, ‘আল্লাহর দয়ায় তুমি তাদের প্রতি কোমল হৃদয় হয়েছিলে; যদি তুমি রূঢ় ও কঠোরচিত্ত হতে তাহলে তারা তোমার আশপাশ থেকে সরে পড়ত।’ (সুরা আলে ইমরান, আয়াত : ১৫৯)

শ্রোতাকে আকৃষ্ট করার জন্য বক্তব্য নয় : শ্রোতাকে নিজের দিকে আকৃষ্ট করার জন্য লৌকিকতার আশ্রয় নেওয়া, কৃত্রিম হাসি-কান্না বা ভাষাশৈলীর ব্যবহার করা কোনোভাবেই কাম্য নয়। এগুলো ধর্মীয় বক্তব্যের উদ্দেশ্যকে ব্যাহত করে। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘যে ভাষার প্রাঞ্জলতা শিখে মানুষের অন্তরকে তার প্রতি আকৃষ্ট করার উদ্দেশ্যে, কিয়ামতের দিন আল্লাহ তার কোনো ফরজ ও নফল ইবাদত কবুল করবেন না।’ (মিশকাত, হাদিস : ৪১০)

বিরক্ত করে বক্তব্য নয় : শ্রোতার আগ্রহ-উদ্দীপনা না থাকলে বক্তব্য ফলপ্রসূ হয় না। কাজেই শ্রোতার মনোযোগ না থাকলে বা মনোযোগী হওয়ার মতো অনূকূল পরিবেশ-পরিস্থিতি না হলে জোর করে বক্তব্য দেওয়া উচিত নয়। ঘন ঘন বক্তব্য হলেও শ্রোতা আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। এ জন্য হাদিসে বিরতি দিয়ে বক্তব্যের আয়োজন করার প্রতি উৎসাহিত করা হয়েছে। ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, ‘তুমি প্রতি জুমায় (শুক্রবার) লোকদের হাদিস শোনাবে। যদি এতে তুমি ক্লান্ত না হও, তাহলে সপ্তাহে দুবার। যদি আরো অধিক করতে চাও তবে তিনবার। আরো অধিক নসিহত করে এ কোরআনের প্রতি মানুষের মনে বিরক্তি সৃষ্টি করো না। লোকেরা তাদের কথাবার্তায় ব্যস্ত থাকা অবস্থায় তুমি তাদের কাছে এসে তাদের নির্দেশ দেবে—আমি যেন এমন অবস্থায় তোমাকে না পাই। কারণ এতে তাদের কথায় বিঘ্ন সৃষ্টি হবে এবং তারা বিরক্ত হবে। বরং তুমি এ সময় নীরব থাকবে। যদি তারা আগ্রহ নিয়ে তোমাকে নসিহত দিতে বলে তাহলে তুমি তাদের নসিহত দেবে।’ (বুখারি, হাদিস : ৫৯৭৮)

উপার্জনের জন্য বক্তব্য নয় : ধর্মীয় বক্তব্য প্রদান উপার্জনের মাধ্যম বানানোর বিষয় নয়; বরং এটি ইবাদত। কাজেই ধর্মীয় বক্তার জন্য অপরিহার্য হলো নিজে সৎপথপ্রাপ্ত হওয়া এবং পার্থিব প্রতিদানের আশা না করে একান্তই আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য অন্যকে সৎ পথের সন্ধান দেওয়া। এ দুইয়ের সমন্বয় হলে শ্রোতার সৎপথ পাওয়া সহজ হবে। আল্লাহ বলেন, ‘অনুসরণ করো তাদের, যারা তোমাদের কাছে কোনো প্রতিদান চায় না এবং যারা সৎপথপ্রাপ্ত।’ (সুরা ইয়াসিন, আয়াত : ২১)

শান্তি বিঘ্ন করে বক্তব্য নয় : শান্তি, স্থিতিশীলতা ও স্বাভাবিক পরিবেশ বজায় রেখে প্রজ্ঞা ও সদুপদেশের মাধ্যমে আল্লাহর পথে আহ্বান করতে হবে এবং শান্তিপূর্ণভাবে ইসলামের সৌন্দর্য উপস্থাপন করতে হবে। উত্তেজনাপূর্ণ বক্তব্য দিয়ে কাউকে কারো বিরুদ্ধে খেপিয়ে তোলা ইসলামী আলোচকের কাজ হতে পারে না। আল্লাহ বলেন, ‘তুমি মানুষকে তোমার প্রতিপালকের পথে আহ্বান করো প্রজ্ঞা ও সদুপদেশ দ্বারা।’ (সুরা নাহল, আয়াত : ১২৫)

পরিশেষে বলা যায়, সম্মানিত ধর্মীয় বক্তারা দুনিয়ার সুনাম-সুখ্যাতি বা অর্থ-বিত্ত অর্জনের অভিলাষ ত্যাগ করে মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের মাধ্যমে আখিরাতের পাথেয় অর্জনের জন্য বক্তব্য দেবেন। তাহলে তা নেকি অর্জনের মাধ্যম এবং হিদায়াতের আলোয় উদ্ভাসিত আয়োজনে পরিণত হবে, ইনশাআল্লাহ।

লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, আরবি বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

RELATED ARTICLES
- Advertisment -
Google search engine

Most Popular

Recent Comments