দ্রুত অনেক এগিয়েছে থ্রিডি প্রিন্টিং। দেশেও থ্রিডি প্রিন্টিংয়ের প্রসার হচ্ছে। চালু হয়েছে প্রিন্টিং সেবা প্রতিষ্ঠানও, ব্যাবহারিক প্রয়োগ বাড়ছে, মানুষ কিনছেও প্রচুর। দেশে থ্রিডি প্রিন্টিংয়ের হালহকিকত নিয়ে লিখেছেন এস এম তাহমিদ
ধাতু থেকে কংক্রিট—সব কিছুই থ্রিডি প্রিন্টিংয়ের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করা যায়। তবে সবচেয়ে জনপ্রিয় থ্রিডি প্রিন্টের মাধ্যম নানা থার্মোপ্লাস্টিক ও রেজিন। থার্মোপ্লাস্টিক থ্রিডি প্রিন্টিংই সবচেয়ে জনপ্রিয়। কেননা বহুমুখী কাজে ভিন্ন ভিন্ন ধরনের থার্মোপ্লাস্টিক ব্যবহার করা যায়।
তবে যেসব প্রিন্টে সূক্ষ্ম ডিজাইন সর্বোচ্চ মানে ফুটিয়ে তোলা দরকার, তার জন্য রেজিন প্রিন্টের তুলনা নেই। কেননা থার্মোপ্লাস্টিক প্রিন্টের মতো রেজিন প্রিন্টে আলাদা স্তরগুলো অসমতল পৃষ্ঠ তৈরি করে না। মূলত এই দুই ধরনের প্রিন্টিং প্রক্রিয়াই মূলধারায় ব্যবহার করা হচ্ছে।
থার্মোপ্লাস্টিক প্রিন্ট
থার্মোপ্লাস্টিকের চিকন তন্তু বা ফিলামেন্ট ব্যবহার করে প্রিন্ট করার প্রযুক্তিকে ফিউজড ডেপোজিশন মোল্ডিং বা এফডিএম প্রিন্টিং বলা হয়ে থাকে। সাধারণত থ্রিডি প্রিন্টিং বলতে এটাকেই বোঝানো হয়। এ ধরনের কাজে ব্যবহৃত হতে পারে এবিএস বা পিএফটিই প্লাস্টিকের তন্তু। এফডিএম ঘরানার প্রিন্টারের মূল্য হতে পারে ২০ হাজারেরও কম থেকে শুরু করে কয়েক লাখ টাকা পর্যন্ত। তবে সাধারণত ২০ হাজার থেকে দুই লাখের মধ্যের মডেলগুলোই সবচেয়ে জনপ্রিয়। এ ধরনের প্রিন্টারের তন্তুর দাম এক হাজার ৫০০ থেকে দুই হাজার ৫০০ টাকা কেজি, সেটা এবিএস নাকি পিএফটিই, তার ঘনত্ব ও মান রঙের ওপর নির্ভরশীল। সাধারণ কম দামি প্রিন্টারগুলোর প্রিন্টিং রেজল্যুশন কম থাকে, যার অর্থ স্তরগুলো বেশ মোটা এবং প্রিন্টারের হেড অতি সূক্ষ্মভাবে নড়াচড়া করতে পারে না। সহজেই ছোটখাটো মডেল প্রিন্ট করা সম্ভব। এতে কিন্তু জটিল জ্যামিতিক নকশা করা যায় না। এফডিএম প্রিন্টারের রকমফের অনুযায়ী থ্রিডি মডেলের কম বা বেশি রেজল্যুশনের স্লাইসিং বা প্রিন্টারের জন্য উপযোগী ডাটা তৈরি করা হয়ে থাকে। সঠিকভাবে স্লাইস করা, মডেলের জন্য মানানসই তন্তু নির্বাচন এবং প্রিন্টারের হেড, মোটর ও বেড ক্যালিব্রেশন ঠিক করলে অত্যন্ত উচ্চমানের মডেলও পাওয়া সম্ভব। বিশেষ করে মডেল প্রিন্ট করার পর সেটাকে একটু পলিশ করে নিলে সেটা দিয়ে বেশির ভাগ পরীক্ষামূলক কাজ বা মডেল হিসেবে প্রেজেন্ট করা সম্ভব সহজেই। খরচাও অন্যান্য প্রিন্টিংয়ের চেয়ে কম।
রেজিন প্রিন্ট
এ ধরনের মেশিনের বৈজ্ঞানিক নাম স্টেরিওলিথোগ্রাফি বা এসএলএ প্রিন্টিং। এখানেও প্লাস্টিক ব্যবহার করা হয়ে থাকে। কিন্তু থার্মোপ্লাস্টিকের তন্তু নয়, বরং প্লাস্টিক তৈরির তরল কেমিক্যাল, যেটাকে রেজিন বলা হয়ে থাকে। তরলটির বৈশিষ্ট্য, এর ওপর অতিবেগুনি রশ্মি দেওয়া হলে সেটি শক্ত হয়ে যায়। এ ধরনের মেশিনে থাকে একটি চৌবাচ্চা, যার মধ্যে তরল রেজিন ঢালা হয়, আর থ্রিডি মডেলের স্লাইসিং ডাটা অনুযায়ী অতিবেগুনি রশ্মি তরলটির মধ্যে প্রবাহিত করা হয়, যাতে মডেলের আদলে জমাট বেঁধে যায় প্লাস্টিক রেজিন। যেহেতু একের পর এক স্তরে গলা প্লাস্টিক জমা করে মডেল তৈরির বদলে তরলকে সরাসরি জমাট বাঁধিয়ে তৈরি করা হয় মডেল, তাই এতে কোনো উঁচু-নিচু বা এবড়োখেবড়ো অংশ থাকে না। মডেলটি শুরুতে বেশ নমনীয় থাকে, সে সময় বাড়তি সাপোর্ট প্লাস্টিক সরিয়ে সেটাকে আরো কিছু সময় লেজারের ওপর রাখা হয় পুরোপুরি শক্ত হওয়ার জন্য। এ ধরনের প্রিন্টিংয়ে যেহেতু তন্তু হিট করার হেড নয়, বরং সরাসরি লেজার ব্যবহার করা হয়ে থাকে তাই প্রিন্টের মান ও সূক্ষ্মতা এফডিএম প্রিন্টের চেয়ে বহুগুণ বেশি। সাধারণত রেজিন প্রিন্ট জটিল নকশার বা অত্যন্ত ক্ষুদ্র মডেল তৈরির জন্যই ব্যবহার করা হয়ে থাকে। অনেকে রেজিন প্রিন্টারে মডেল তৈরি করে পরে সেটা থেকে ফ্যাক্টরিতে ব্যবহারের জন্য ছাদ তৈরি করে থাকেন। রেজিন প্রিন্টারের মূল্য শুরু ৪০ হাজারের আশপাশ থেকে, রেজিন তরলের মূল্য প্রায় ছয় হাজার টাকা লিটার। তাই একেবারেই প্রয়োজন না হলে রেজিন প্রিন্টার সাধারণত ব্যবহার করা হয় না।
অন্যান্য প্রিন্টিং সিস্টেম
সিলেক্টিভ লেজার সিন্টারিং বা এসএলএস প্রিন্টিংও থ্রিডি জগতে সমাদৃত সিস্টেম। এখানে প্লাস্টিকের গুঁড়া লেজারের মাধ্যমে গলিয়ে মডেল তৈরি করা হয়। বলা যায়, রেজিন আর থার্মোপ্লাস্টিক প্রিন্টিংয়ের হাইব্রিড সিস্টেম এটি। এতে মডেল তৈরির ম্যাটেরিয়ালের দাম কম থাকে ঠিকই কিন্তু প্রিন্টারের মূল্য অনেক বেশি হওয়ায় এটি এখনো দেখা যায় না। এ ছাড়া কংক্রিট ও ধাতু ব্যবহার করেও প্রিন্ট করা যায় কিন্তু সেটা মূলধারার থ্রিডি প্রিন্টিংয়ের জন্য এখনো প্রস্তুত নয়।
প্রিন্টের খরচ
প্রিন্টপ্রতি খরচ পুরোটাই নির্ভর করে মডেলের আকৃতি, ঘনত্ব, তন্তু ও মডেলের ডিজাইনের জটিলতার ওপর। থ্রিডি প্রিন্টারের স্পিড কাগজে প্রিন্ট করার মতো নয়, একেকটি মডেল প্রিন্টে কয়েক ঘণ্টা থেকে কয়েক দিনও লেগে যেতে পারে, অনেক সময় একটি বস্তু কয়েকটি ভাগ করে প্রিন্ট করতে হয়। সে জন্য প্রিন্টারের বিদ্যুৎ খরচও হিসাবে ধরা লাগে। সাধারণত একটি প্রিন্টে ৩০০-৪০০ টাকার মতো খরচ হয়, তবে সেটা কয়েক হাজার টাকাও দাঁড়াতে পারে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এক থেকে দেড় হাজারের মধ্যেই প্রতিটি মডেলের দাম পড়ে যায়।
প্রিন্টারের খোঁজ
থ্রিডি প্রিন্টার দেশে বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান বিক্রি করছে। এর মধ্যে আছে রোবটন বিডি, রোবটিকস বিডি, প্রটোটাইপ বিডি ও অন্যান্য অনলাইন বিক্রেতা। এ ছাড়া পাটুয়াটুলীতে পাওয়া যাচ্ছে থ্রিডি প্রিন্টারের পার্টস ও প্রিন্টের ফিলামেন্ট। তবে অনেকেই এখনো সরাসরি বাইরের দেশ থেকে চাহিদা অনুযায়ী প্রিন্টার আমদানি করে নিচ্ছেন। থ্রিডি প্রিন্টার চাইলে পার্টস কিনে নিজেও অ্যাসেম্বলিং করে তৈরি করা যায়। এত খরচ কিছু কম হয়। তবে নতুনদের জন্য নিজে তৈরি করা ঝামেলা মনে হতে পারে।
থ্রিডি প্রিন্টিং সেবা
নিজ বাসায় ডকুমেন্ট বা ছবি প্রিন্ট করার চেয়ে সেবাদানকারী দোকান থেকেই বেশির ভাগ ব্যবহারকারী কাজ সেরে থাকেন। থ্রিডি প্রিন্টের প্রয়োজন কম হওয়ায় অনলাইনে থ্রিডি প্রিন্ট অর্ডার করে কয়েক দিন পর সেটা পেলেও বেশির ভাগ গ্রাহকের খুব একটা সমস্যা হচ্ছে না বলেই জানিয়েছেন এ ধরনের সেবাদাতারা। আর্কিটেকচার ফার্ম, ডিজাইনার বা শৌখিন নির্মাতারা তাঁদের ডিজাইনের ফাইলগুলো ই-মেইলের মাধ্যমে পাঠিয়ে থাকেন। প্রিন্টের মাধ্যম এবং মান অনুযায়ী তার মূল্য নির্ধারণ করা হয়ে থাকে।
কয়েকটি থ্রিডি প্রিন্টার, সেগুলো চালানোর দক্ষতার ট্রেনিং এবং সেগুলো ব্যবহার করার জন্য প্রয়োজনীয় সফটওয়্যার চালনাযোগ্য কম্পিউটার ব্যবহার করেই থ্রিডি প্রিন্টিং সেবা শুরু করা সম্ভব। এর জন্য পুঁজি লাগবে কয়েক লাখ টাকা, কিন্তু ক্রমবর্ধমান এ খাতে এখনই বিনিয়োগ করলে ভবিষ্যতে বাজারের বড় অংশ ধরে রাখা সম্ভব হবে। বিশেষায়িত রিপেয়ারের জন্যও অনেক সময়ই আজকাল থ্রিডি প্রিন্ট করা পার্টস ব্যবহার জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। অনেকে শখের বসে বিভিন্ন জিনিসের মডেল অনলাইন থেকে সংগ্রহ করে প্রিন্ট করে নিচ্ছেন। দেশে মূলধারায় থ্রিডি প্রিন্টিং যুগের মাত্র শুরু।
যারা এর মধ্যেই কাজ করছে
থ্রিডি প্রিন্টিং হাব, কীর্তি স্টুডিওজ, রোবটন বিডি, কাস্টমাইজেবলস, প্রটোটাইপ বিডি ও টেক ওয়ার্কশপ বিডির মতো বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান ও ক্ষুদ্র উদ্যোগ এরই মধ্যে থ্রিডি প্রিন্ট সেবা দিচ্ছে। এফডিএম প্রিন্ট তারা মডেলের ওজন অনুযায়ী গ্রামপ্রতি ৫ থেকে ১০ টাকা করে দাম ধরছে, তবে রেজিন প্রিন্টের ক্ষেত্রে সেটা আলোচনা সাপেক্ষে নির্ধারণ করা হয়। এতে ১০০ গ্রামের একটি প্রিন্ট ৫০০ থেকে এক হাজার টাকার মধ্যে পাওয়া সম্ভব, রেজিন হলে দুই হাজারও হতে পারে। সেবাগুলো পেতে তাদের ফেসবুক পেজ, ওয়েবসাইট বা হোয়াটসঅ্যাপ নম্বরে যোগাযোগ করতে হবে। মডেলের ফাইলগুলো তারা এসটিএল ফরম্যাটে দেওয়ার অনুরোধ জানিয়েছে। প্রিন্ট করা মডেল কুরিয়ারের মাধ্যমে গ্রাহকদের ঠিকানায় পৌঁছে দিচ্ছে তারা। তবে অনেক গ্রাহক সরাসরি সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানে গিয়ে কাজ করে আনার ইচ্ছা জানিয়ে পেজে কমেন্ট করেছেন, যদিও সেই সেবা এখনো তেমন কোথাও দেখা যায়নি।
ভবিষ্যৎ
মেরামতের জন্য বিশেষ পার্টস থেকে শিল্পকর্ম বা দৈনন্দিন কাজের জন্য বিশেষায়িত কোনো টুলস থ্রিডি প্রিন্টের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল। আজ থিংগিভার্স বা প্রিন্টেবলের মতো ওয়েবসাইটের কল্যাণে নিজে বসে থ্রিডি মডেল তৈরিরও প্রয়োজন হচ্ছে না, চাহিদা অনুযায়ী ওয়েবসাইট থেকে থ্রিডি প্রিন্টের ফাইল ডাউনলোড করে প্রিন্টার সেবার কাছে পাঠিয়েই চাহিদা অনুযায়ী জিনিস পাচ্ছেন গ্রাহকরা। তাই প্রিন্ট সেবাদান আগামীর বড়সড় ব্যবসার একটি হবে সন্দেহ নেই।