Friday, September 22, 2023
spot_img
Homeধর্মদস্যুতা ছেড়ে বিজ্ঞানচর্চা, খলিফার পৃষ্ঠপোষকতায় সাফল্য

দস্যুতা ছেড়ে বিজ্ঞানচর্চা, খলিফার পৃষ্ঠপোষকতায় সাফল্য

মুসা বিন শাকির

বিখ্যাত মুসলিম বিজ্ঞানীদের একজন মুসা বিন শাকির। যারা জ্যোতির্বিজ্ঞান ও জ্যামিতিতে মৌলিক অবদান রেখেছেন, তিনি তাঁদের একজন। কিন্তু তাঁর প্রথম জীবন কিন্তু একদম সাদাসিধে ছিল না। জীবনের প্রথম ভাগে তিনি কখনো বিজ্ঞানচর্চাও করেননি; বরং প্রথম জীবনে তিনি ছিলেন ভয়ংকর একজন দস্যু।অর্থের জন্য যে কাউকে নির্দ্বিধায় হত্যা করে ফেলতেন। তাঁর নির্দয়তা লোকমুখে উদাহরণ হয়ে ছিল। এই ভয়ংকর ডাকাত একদিন খলিফা আল মামুনের রাজকীয় বাহিনীর হাতে ধরা পড়ে এবং তার মৃত্যুদণ্ডের আদেশ হয়।

তবে দস্যু মুসা এ আদেশ মেনে নেননি।

তিনি বাদশাহর কাছে এর প্রতিবাদ করে বলেন, ‘বাদশাহ নামদার, এ আদেশ ন্যায়বিচারের পরিপন্থী। কারণ আমি দস্যুতা করতে গিয়ে বা মানুষ খুন করার অপরাধে আপনার বাহিনীর হাতে ধরা পড়িনি; বরং প্রতিপক্ষ হিসেবে যুদ্ধে পরাজিত হয়ে বন্দি হয়েছি। অতএব, আমার প্রাপ্য যুদ্ধবন্দির মর্যাদা।’ দস্যু সর্দারের কথায় চমৎকৃত বাদশাহ তাঁর শাস্তিস্বরূপ তাকে রাজকীয় মানমন্দিরের সেবায়েত নিযুক্ত করেন।

ঘটনাক্রমে এ সময় মানমন্দিরে গবেষণারত ছিলেন বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞানী আল খারেজমি। এই মহাবিজ্ঞানীর সাহচর্যে এসে বদলে গেলেন দস্যু সর্দার মুসা বিন শাকির। আত্মনিয়োগ করলেন বিজ্ঞানচর্চায়। যে ধারা তাঁর সন্তানদেরও প্রভাবিত করে। জগদ্বিখ্যাত বিজ্ঞানী বনি মুসার ভ্রাতৃত্রয় ছিল ডাকাত থেকে বিজ্ঞানী হওয়া মুসা বিন শাকিরের সন্তান।

তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর তিন সন্তান—আবু জাফর মুহাম্মদ, আবুল কাসিম আহমদ এবং আল-হাসান ইবন মুসা বিন শাকিরের লালন-পালনের দায়িত্ব পালন করেন স্বয়ং খলিফা আল মামুন। তিনি এদের লেখাপড়ার দায়দায়িত্ব দেন তাঁর বিজ্ঞানসভার প্রভাবশালী সদস্য ইয়াহহিয়া বিন আবি মনসুরের ওপর। ফলে অন্য শাহজাদাদের মতোই রাজকীয় পরিবেশে শিশুকাল থেকে বনি মুসা ভ্রাতৃত্রয় বেড়ে ওঠেন।

এঁদের মধ্যে আবু জাফর মুহাম্মদ ছিলেন সবচেয়ে বেশি প্রতিভাধর। বিজ্ঞানের সব শাখায়ই তিনি ছিলেন সমান দক্ষ। আবুল কাসিম আহমদ ছিলেন বৈজ্ঞানিক যন্ত্র তৈরিতে কুশলী ও যন্ত্র ব্যবহারে বিশেষজ্ঞ ব্যক্তি। আর সর্বকনিষ্ঠজন আল হাসান ছিলেন সর্বশ্রেষ্ঠ গণিতজ্ঞ। তাঁরা তিন ভাই আল-বিরুনীর মতোই বৈজ্ঞানিক ও পর্যটক ছিলেন। জ্ঞান আহরণে তাঁরা নিজেদের সব ধন-সম্পদ নিয়োজিত করেন। নিজেরাও বেরিয়ে পড়েন পূর্বতন জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রাচীন পুঁথি-পুস্তক সংগ্রহ করার জন্য।

তাঁরা গ্রিক, রোম প্রভৃতি সভ্যতার পীঠস্থানগুলো ঘুরে ঘুরে বিপুল গ্রন্থ সংগ্রহ করেন। এর পরও লোক মারফত প্রচুর অর্থব্যয়ে বহু প্রাচীন জ্ঞান-গ্রন্থ সংগ্রহ করেন। বাগদাদে ফেরার পথে হাররানে ভাগ্যান্বেষী বৈজ্ঞানিক সাবিত ইবনে কোরার সঙ্গে তাঁদের দেখা হয়। দ্রাঘিমা ও অক্ষরেখার কেন্দ্রস্থল গ্রিনউইচ তৎকালীন পৃথিবীতে অজ্ঞাত ছিল। বনি মুসা ভ্রাতৃত্রয় অক্ষরেখা ও দ্রাঘিমার কল্পনা করে লোহিত সাগরের তীরে বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়ায় পৃথিবীর আকার ও আয়তন সঠিকভাবে নির্ণয় করেন। (বিশ্ব সভ্যতায় মুসলিম অবদান, পৃ. ৬৯)

জ্যোতির্বিজ্ঞানে পৃথিবীর ঋতু পরিবর্তন, দিন-রাত্রির পরিবর্তন প্রভৃতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের ওপর চূড়ান্ত পর্যবেক্ষণ গ্রহণ করেছিলেন বনি মুসা ভ্রাতৃত্রয়। আজও বলবৎ আছে তাদের ওই পর্যবেক্ষণের ফল। তাঁরা জ্যামিতি, পরিমিতি কণিক, চিকিৎসা প্রভৃতি বিষয়ের ওপর মৌলিক গ্রন্থ রচনা করেন। তাঁদের লেখা গোলক ও সমতল ভূমির পরিমাপ সম্পর্কীয় গ্রন্থটি লাতিন ভাষায় অনূদিত হয়।

গ্রিক বিজ্ঞানী হিরো সর্বপ্রথম বলবিজ্ঞানের ধারণা দেন। তবে তাঁর ধারণা অত্যন্ত অস্পষ্ট ছিল। অতঃপর বহু শতাব্দী ধরে বিষয়টি আর কারো দৃষ্টি আকর্ষণ করেনি। বিজ্ঞানের এ শাখাটিকে বনি মুসা ভাইয়েরা সুদৃঢ় ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত করেন। তাঁরা এর ঔপপত্তিক নিয়ম-কানুন ও সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম যন্ত্রপাতির নির্মাণকৌশলের ওপর বিশদ আলোচনা করেন। স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রপাতির নির্মাণকৌশলও তাঁরা উদ্ভাবন করেন। বলবিজ্ঞান সম্পর্কীয় তাদের যাবতীয় আবিষ্কার সম্পূর্ণ মৌলিক বলেই মনে হয় (সেরা কজন মুসলিম বিজ্ঞানী, পৃ. ৬৯)।

বনি মুসা ভ্রাতৃত্রয় ব্যাবহারিক জ্যোতির্বিজ্ঞানে চরম সাফল্য লাভ করেন। তাঁদের আয়ত্তাধীন রাজকীয় মানমন্দির থাকা সত্ত্বেও নিজেদের কাজের সুবিধার্থে তারা টাইগ্রিস নদীর তীরে ‘বাবেল তাকে’ নামক জায়গায় আলাদা মানমন্দির নির্মাণ করেছিলেন। এই ভ্রাতৃত্রয়ের প্রথমজন আবু জাফর মুহাম্মদ ৮৭২ খ্রিস্টাব্দে ইন্তেকাল করেন। অল্প সময়ের মধ্যে অন্য দুই ভাইও এ দুনিয়া ছেড়ে বিদায় নেন।

তথ্যঋণ : সেরা মুসলিম বিজ্ঞানী, পৃ : ২০

RELATED ARTICLES
- Advertisment -
Google search engine

Most Popular

Recent Comments