বাংলাদেশে আগত পির-দরবেশরা ইসলাম প্রচার-প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রেখে হয়েছেন বাংলা-বাঙালির প্রিয়স্বজন। তাঁদেরই মসজিদ, মারকাজ, মাদরাসা, দরবার হতে তৈরি হয়েছেন অসংখ্য হাফেজ-মাওলানা। সাকিব আল হাসান বিশ্ববরেণ্য ক্রিকেট তারকা, জাতীয় বীর। হিফজ অঙ্গনেও আছেন ময়মনসিংহের হাফেজ নাজমুস সাকিব। দেশের কওমি ঘরানার হাফেজ-মাওলানার কৃতিত্বের সম্মননার অনুষ্ঠান ‘দস্তারবন্দি’।
‘দস্তার’ অর্থ পাগড়ি। ‘বন্দি’ অর্থ বাঁধা। ফারসি ‘দস্তারবন্দি’ অর্থ পাগড়ি বেঁধে দেওয়া। মুসলিম ঐতিহ্যে দস্তারবন্দির প্রচলন দুই কারণে :
ক. মৃত্যুবরণকারী নেতার উত্তরাধিকারীকে পাগড়ি বেঁধে স্থলাভিষিক্ত ঘোষণা।
খ. দ্বিনি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষা সমাপনকারীদের স্বীকৃতি ও মর্যাদাস্বরূপ পাগড়ি বেঁধে দেওয়া। একে ‘দস্তারে ফজিলত’ও বলা হয়।
এটা এক বিশেষ পাগড়ি, যা যোগ্যতার স্বীকৃতি, সম্মাননা ও দ্বিনি গুরুদায়িত্বের প্রতীক হিসেবে প্রদান করা হয়। পাগড়ি প্রদানের জন্য ‘দস্তারবন্দি সম্মেলন’ বহু প্রাচীন ঐতিহ্য। আধ্যাত্মিক সাধনাসিদ্ধির পর শায়খের পক্ষ থেকে পাগড়ি-খিরকার প্রচলনও অনেক পুরনো রীতি।
পাগড়ি পরিধান করা নবীদের সুন্নত। আদম (আ.) জান্নাত থেকে অবতরণের সময় মাথায় পাগড়ি ধারণ করেছিলেন এবং জিবরাইল (আ.) ওই পাগড়ি পরিয়ে দিয়েছিলেন। রাসুল (সা.) ষষ্ঠ হিজরিতে আবদুর রহমান ইবনে আউফ (রা.)-কে দুমাতুল জান্দাল অভিযানের দায়িত্ব প্রদানের সময় তাঁকে ডেকে তাঁর মাথায় নিজ হাতে পাগড়ি বেঁধে দেন। দশম হিজরিতে রাসুল (সা.) আলী (রা.)-কে ইয়েমেন প্রেরণের সময় নিজ হাতে তাঁর মাথায় পাগড়ি বেঁধে দেন। এ ছাড়া রাসুল (সা.) যখন কাউকে শাসক বানিয়ে কোথাও পাঠতেন, তখন নিজ হাতে তার মাথায় পাগড়ি বেঁধে দিতেন। সর্বশেষ বেঁধে দিয়েছিলেন উসামা (রা.)-এর মাথায়।
পাগড়ি পরিধানের ঐতিহ্য জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের লেখায় এসেছে, যেমন :
১. ‘…শির দেগা নেহি দেগা আমামা’।
২. ‘…বাঁধরে আমামা বাজিছে দমামা, শির উঁচু করি মুসলমান, দাওয়াত এসেছে নয়া যামানার, ভাঙা কেল্লায় উড়ে নিশান’।
৩. ‘…মোরা রণ চাই রণ চাই,
তবে বাজহ দামামা, বাঁধহ আমামা,
হাতিয়ার পাঞ্জায়’!
উপমহাদেশে দারুল উলুম দেওবন্দ ১৫ মহররম ১২৮৩ (৩০ মে ১৮৬৬ খ্রি.) সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। এ প্রতিষ্ঠানের দস্তারবন্দির ধারাবাহিক ইতিহাস রয়েছে। প্রতিষ্ঠার সপ্তম বছরে ১৯ জিলকদ ১২৯০ শুক্রবার ‘জলসায়ে তাকসিমে ইনআম’ বা দস্তারবন্দি সম্মেলন হয়। প্রথমবারের মতো পাঁচজন ছাত্র নির্ধারিত সিলেবাসের শিক্ষা সমাপ্ত করেন। তাঁরা হচ্ছেন : ১. মাওলানা মুহাম্মদ মাহমুদ হাসান দেওবন্দি ২. মাওলানা আব্দুল হক পুরকাজুভি, ৩. মাওলানা ফখরুল হাসান গাঙ্গুহি, ৪. মাওলানা ফতেহ মুহাম্মদ থানভি, ও ৫. মাওলানা আবদুল্লাহ জালালাবাদী। তাঁদের সম্মান ও গুরুদায়িত্বের প্রতীক ‘দস্তারে ফজিলত’ বেঁধে দেওয়া হয়েছিল।
এ সম্মেলনে শীর্ষ আলেমরা অংশগ্রহণ করেন, তাঁদের মধ্যে মাওলানা রশিদ আহমদ গাঙ্গুহি, মাওলানা মুহাম্মদ কাসিম নানুতভি, কাজি মুহাম্মদ ইসমাঈল মঙ্গলুরি, মুহাম্মদ হাশিম, হাকিম জিয়াউদ্দিন রামপুরি, খাজা আবুল হাসান দেহলভি, মুন্সি মুহাম্মদ হায়াত সাহেব-মুহতামিম নাজমুল আকবার প্রমুখ (রহ.) অন্যতম। জুমা নামাজের পর মাওলানা মুহাম্মদ কাসিম নানুতভি (রহ.) এক পাণ্ডিত্যপূর্ণ সমাবর্তন ভাষণ দেন। এতে তিনি দারুল উলুম প্রতিষ্ঠার প্রেক্ষাপট, গুরুত্ব-প্রয়োজনীয়তা, উপকারিতা, শিক্ষা সমাপনকারীদের দায়িত্ব ও কর্তব্য বিষয়ে বিস্তারিত বক্তব্য উপস্থাপন করেন।
দ্বিতীয় দস্তারবন্দি ২ জিলহজ ১২৯২ দারুল উলুম দেওবন্দের জামে মসজিদে অনুষ্ঠিত হয়। তৃতীয় দস্তারবন্দি ‘জলসায়ে তাকসিমে ইনআম ও দস্তার’ ১২৯৯ হিজরিতে অনুষ্ঠিত হয়। চতুর্থ সম্মেলন ৬, ৭ ও ৮ রবিউল আওয়াল ১৩২৭ অনুষ্ঠিত হয়। দারুল উলুম দেওবন্দের শতবার্ষিকী উদযাপন ও দস্তারবন্দি মহাসম্মেলন ১৯৮০ সালের মার্চ মাসের শেষের দিকে অনুষ্ঠিত হয়। এটা ছিল ইতিহাসের সর্ববৃহৎ সম্মেলন।
খতমে বুখারির অনুষ্ঠান ও হাফেজদের পাগড়ি প্রদানে ‘দস্তারবন্দি’ বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী কওমি মাদরাসা শিক্ষাব্যবস্থার গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ। দোয়া, দ্বিনি মেহনতের সওগাত ‘দস্তারবন্দি’ জানান দেয় নতুন আলেম, ইমাম তৈরির অমীয়বার্তা।
আমাদের অসংখ্য আলেম, হাফেজে কোরআন, কারি আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় পুরস্কৃত হয়ে দেশের সুনাম ও গৌরব বয়ে আনছেন। এসব পুরস্কারপ্রাপ্তরা কি একেকজন তারকা নন? তাঁদের নিয়েও তো হতে পারে লাল-সবুজের মহড়া। তাঁদেরও ডাক পড়তে পারে বঙ্গভবন, গণভবনের জৌলুসময় ‘দস্তারবন্দি’র আয়োজনে। হয়তো তখন পবিত্র কোরআনের শ্রেষ্ঠত্বের প্রাণোচ্ছ্বাসে মুজাদ্দিদ আলফিসানি (রহ.)-এর ভাষায় উচ্চারিত হবে :
‘এ আবে হায়াত থেকে পিপাসা চাহি না মেটাতে কভু
এর মাঝে যেন হরদম মোর তৃষ্ণা বাড়ান প্রভু।’
লেখক : বিভাগীয় প্রধান, ইসলামিক স্টাডিজ, কাপাসিয়া ডিগ্রি কলেজ, গাজীপুর