শুরুতে ডিপফেককে ব্যক্তিস্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ এবং জালিয়াতির হাতিয়ার হিসেবে প্রায় সবাই আখ্যায়িত করলেও প্রযুক্তিটির প্রতি অনুরাগী হতে শুরু করেছেন অনেকেই। ডিপফেকের সঠিক ব্যবহার শুধু কাজেরই হবে না, নতুন দিগন্তও খুলবে বলে ধারণা করছেন বিশেষজ্ঞরা। জানাচ্ছেন এস এম তাহমিদ
মেশিন লার্নিংয়ের মাধ্যমে কারো চেহারা, কণ্ঠ ও চালচলন বিশ্লেষণ করে তার ভার্চুয়াল মডেল তৈরির প্রযুক্তি আবিষ্কৃত হয়েছে বেশ কয়েক বছর আগেই। সেই মডেল কাজে লাগিয়ে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মাধ্যমে ভিডিও ও অডিও তৈরির প্রযুক্তি বা ‘ডিপফেক’ নিয়ে শোরগোলও চলছে বেশ কিছুদিন ধরেই। ডিপফেক করে নিজেকে হলিউডের নামকরা নায়ক টম ক্রুজ বানিয়ে ক্রিস ইউম গত বছর সংবাদমাধ্যমগুলোতে সাড়া ফেলে দেন। ভিজ্যুয়াল ইফেক্টস আর্টিস্ট ক্রিস ইউমের করা ভিডিওগুলো এতটাই বাস্তব, তিনি চাইলেই সেগুলোকে সত্যিই টম ক্রুজের ভিডিও বলে চালিয়ে দিতে পারতেন।
তার বদলে তিনি উল্টো কিভাবে শটগুলো তৈরি করেছেন সেটাই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তুলে ধরেন। রাতারাতি ভাইরাল হয়ে যাওয়া ভিডিওগুলো থেকেই প্রশ্ন ওঠে—ভবিষ্যতে কি তাহলে অভিনেতারা তাঁদের প্রতিকৃতি ডিপফেকের জন্য বিক্রি করতে পারবেন বা তাঁদের ডিপফেক করার অনুমতি দিয়ে সেটা থেকে করতে পারবেন বাড়তি আয়?
রুশ একটি বিজ্ঞাপনে হলিউডের আরেক জনপ্রিয় অভিনেতা ব্রুস উইলিসের ডিপফেক ব্যবহার করা হয়েছে। গুঞ্জন চলছে, সেটি তাঁর অনুমতি নিয়েই করা হয়েছে, যদি সেটা সত্যিই হয়ে থাকে, তাহলে নিজের চেহারার ডিপফেক স্বত্ব বিক্রি করার এটাই প্রথম নজির। যদিও ডিপফেকটির নির্মাতা প্রতিষ্ঠান ‘ডিপকেক’ এবং ব্রুস উইলিসের মুখপাত্র—দুই পক্ষই বিষয়টি অস্বীকার করেছেন। ব্রুস উইলিস কিছুদিন আগেই তাঁর স্বাস্থ্যগত জটিলতার কারণে অভিনয় থেকে অবসর নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। তিনি যদি ডিপফেকের মাধ্যমে আরো কিছুদিন অভিনয় চালিয়ে যেতে পারেন, বিষয়টি হবে চমকপ্রদ এবং এই প্রযুক্তির অসাধারণ ব্যবহারের একটি উজ্জ্বল উদাহরণ।
টম ক্রুজের নাম আরো একটি ডিপফেকের সঙ্গে জড়িয়ে আছে, সেটা হচ্ছে এ বছর থিয়েটার কাঁপানো ‘টপ গান : ম্যাভেরিক’ সিনেমাটিতে ব্যবহৃত অল্পবিস্তর ডিপফেক প্রযুক্তি। এবারের সিনেমাটি ১৯৮৬ সালে প্রকাশিত টপ গানের সিক্যুয়াল। টম ক্রুজ চেয়েছিলেন প্রতিটি চরিত্র এবং তাঁর অভিনেতারা ফিরে আসুক নতুন ছবিতে। কিন্তু ভ্যাল কিলমার ক্যান্সারে কয়েক বছর আগেই তাঁর কণ্ঠ হারিয়েছেন, তাঁর পক্ষে ডায়ালগ দেওয়া সম্ভবপর ছিল না। এই সিনেমায় ভ্যাল কিলমারের কণ্ঠ ডিপফেকের মাধ্যমেই বসানো হয়েছে। যদিও হাতে গোনা কয়েকটি লাইন, তা-ও মূলধারার ব্লকবাস্টার সিনেমায় ডিপফেকের ব্যবহার এবারই প্রথম।
স্টার ওয়ারস ফ্র্যাঞ্চাইজির আইকন ডার্থ ভেডার চরিত্রের কণ্ঠ। এই চরিত্রে রূপদানকারী জেমস আর্ল জোন্স ৯১তম জন্মদিনে ঘোষণা দিয়েছেন, তিনি আর কাজ করবেন না। তবে তাঁর কণ্ঠের স্বত্ব ডার্থ ভেডার চরিত্রে ডিপফেকের মাধ্যমে ব্যবহারের জন্য অনুমতি দিয়েছেন। অবসরের পরও কাজ চালিয়ে যাওয়ার জন্য ডিপফেক তৈরির অনুমতি দেওয়ার ঘটনা এটাই প্রথম, যদিও শুধু কণ্ঠ এবং মাত্র একটি চরিত্রের জন্য। তবে একবার যখন অভিনয়ের নতুন দুয়ার খুলেছে, দ্রুত আরো অনেকেই সে পথে হাঁটবেন সেটাই ইন্ডাস্ট্রির সবার ধারণা।
ভবিষ্যতের সিনেমায় কি তাহলে ডিপফেকেরই ছড়াছড়ি থাকবে? যেভাবে কম্পিউটার জেনারেটেড ইমেজ বা সিজিআই সিনেমার জন্য সেট তৈরি বা লোকেশনে শুটিং করার প্রয়োজন কমিয়ে দিয়েছে, এখন কি তাহলে সরাসরি অভিনেতাদেরও ক্যামেরার সামনে দাঁড়ানোর প্রয়োজন হবে না? অন্তত সিনেমা অনুরাগীরা সেটা মেনে নেবেন না, সেটা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এবং অনলাইন ফোরামগুলোতে তাদের সমালোচনা দেখেই বোঝা গেছে।
তবে প্রযুক্তিটি সিনেমায় নয়, বিজ্ঞাপনে ব্যাপক ব্যবহৃত হবে তা নিয়ে সন্দেহ নেই। শিল্পীরা তখন তাঁদের মূল কাজ করার সময়ও বিজ্ঞাপন থেকে আয় করতে পারবেন ডিপফেক স্বত্ব বিক্রি বা লাইসেন্স দেওয়ার মাধ্যমে। এর মধ্যেই অবসরে যাওয়ার পরও কাজ করতে ডিপফেক ব্যবহারের নজির দেখা যাচ্ছে, সামনে মৃত্যুর পরও যাতে চলমান প্রজেক্টগুলো শেষ করা যায় সে জন্য হয়তো সিনেমার নির্মাতারাও শিল্পী-কলাকুশলীদের ডিপফেক ব্যবহারের অনুমতিও নিয়ে রাখবেন। অতএব এটা বলা যেতেই পারে, আগামী দিনে ডিপফেকের বৈধ ব্যবহার আরো অনেক বাড়বে।