দেশে মার্কিন মুদ্রা ডলারের দাম বেড়েই চলছে। গত বুধবারও এক দিনে ৫০ পয়সা দর হারিয়েছে টাকা। আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজারে এক ডলারের জন্য ৯৩ টাকা ৯৫ পয়সা খরচ করতে হয়েছে। এই দরে বাংলাদেশ ব্যাংক বুধবার ৯ কোটি ৭০ লাখ ডলার ব্যাংকগুলোর কাছে বিক্রি করেছে। এরপরও ডলারের সংকট সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। অন্যদিকে রপ্তানি আয় বাড়লেও কমেছে প্রবাসী আয়। ফলে দেখা দিয়েছে ডলারের সংকট। ডলারের এই তীব্র সংকটের কারণে অতি প্রয়োজনীয় পণ্য আমদানিতেও চরম সংকটে পড়েছে দেশের সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো। ডলার সংকটের কারণে বাংলাদেশ ব্যাংক বিভিন্ন ধরনের পণ্য আমদানিতে কড়াকড়ি আরোপ করেছে। ব্যাংকগুলোও ঋণপত্র খোলার বিষয়ে কঠোর অবস্থান নিয়েছে।
জ্বালানিসহ বিভিন্ন অতি গুরুত্বপূর্ণ পণ্য আমদানি নিয়েও শঙ্কা দেখা দিয়েছে। প্রতিষ্ঠানগুলো জানিয়েছে, জ্বালানি তেল আমদানি করতে ব্যাংকে ঋণপত্র (এলসি) খোলা যাচ্ছে না। তেল সরবরাহকারী বিদেশি সংস্থার পাওনা পরিশোধ নিয়মিত হচ্ছে না।
বিশেষ করে দেশের জ্বালানি নিরাপত্তা বিঘ্নিত হতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি)। অন্যদিকে ব্যাংক বলছে, ডলারের সংকট। ব্যাংক কর্মকর্তারা বলছেন, বিভিন্ন পণ্য আমদানিতে বাংলাদেশ ব্যাংক ডলার বিক্রি করে। তবে ডলারের যত চাহিদা তার অর্ধেক কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিক্রি করে। বাকি ডলার অন্য ব্যাংক থেকে কিনতে হয়, যাতে দামও বেশি পড়ে। এদিকে বৈদেশিক মুদ্রা আয় কমে যাওয়ায় দেশের বৈদেশিক মুদ্রা মজুতের ওপরও চাপ তৈরি হয়েছে। দেশে বৈদেশিক মুদ্রার মজুত এখন ৪০ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমেছে। গত মঙ্গলবার দিনশেষে রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ৩৯.৮০ বিলিয়ন ডলার। বিশ্লেষকরা জানান, আমদানি ব্যয় বৃদ্ধি ও প্রবাসী আয় বা রেমিট্যান্স কমে যাওয়ায় দেশে আমেরিকান ডলারের তীব্র সংকট তৈরি হয়েছে। রপ্তানি আয় বৃদ্ধি পেলেও তা ডলারের সংকট মেটাতে পারছে না। ফলে প্রতিনিয়ত বাড়ছে ডলারের দাম। এজন্য রিজার্ভ থেকে ডলার ছেড়ে বাজার নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। প্রতিনিয়ত দামও বাড়াচ্ছে। এরপরও কিছুতেই বাগে আসছে না ডলারের তেজিভাব। আবার বাংলাদেশ ব্যাংক যে দামে ডলার বিক্রি করছে, বাজারে তার চেয়ে ৩-?৪ টাকা বেশি দরে কেনাবেচা হচ্ছে। ফলে আমদানিকারকদের বেশি দামে ডলার কিনতে হচ্ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র সিরাজুল ইসলাম বলেন, প্রায় প্রতিদিনই জ্বালানি ও খাদ্যসহ সরকারি বিভিন্ন আমদানির জন্য ডলার বিক্রি করা হচ্ছে। তবে ব্যাংকগুলোর ডলার সংগ্রহে রপ্তানি ও প্রবাসী আয়ে নজর দেয়া প্রয়োজন। সাধ্যমতো তাদের সহায়তার চেষ্টা করা হচ্ছে। বুধবারও ৯ কোটি ৭০ লাখ ডলার দেয়া হয়েছে। ইসলামী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. মনিরুল মওলা বলেন, কোনো কোনো ব্যাংক হয়তো ডলার সংকটের কারণে এলসি খুলতে হিমশিম খাচ্ছে। কিন্তু ইসলামী ব্যাংক সাধ্যমতো নিয়মিত এলসি খুলছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যে দেখা গেছে, গত এক মাসের ব্যবধানে ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমেছে ৫ শতাংশের বেশি। আর এক বছরের ব্যবধানে কমেছে ১০.৮০ শতাংশ। গত বছরের ৬ই জুলাই প্রতি ডলারের জন্য ৮৪ টাকা ৮০ পয়সা খরচ করতে হয়েছে। এক মাস আগে ৩০শে মে লেগেছিল ৮৯ টাকা।
গত বছরের আগস্ট থেকে ডলারের দাম বাড়তে শুরু করে; দুর্বল হচ্ছে টাকা। তার আগে এক বছরেরও বেশি সময় ৮৪ টাকা ৮০ পয়সায় ‘স্থির’ ছিল ডলারের দর। এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংক বুধবার ৯৩ টাকা ৯৫ পয়সা দরে ডলার বিক্রি করলেও ব্যাংকগুলো প্রবাসী আয় এনেছে ৯৬-৯৭ টাকায়, আর আমদানিকারকদের কাছে বিক্রি করেছে ৯৬ থেকে ৯৭ টাকা দামে। এর আগে মে মাসে খোলাবাজারে ডলারের দাম ১০০ টাকা ছাড়িয়েছিল। বুধবার খোলাবাজার বা কার্ব মার্কেটে প্রতি ডলার ৯৭ টাকা ৫০ পয়সায় বিক্রি হয়েছে। রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী, জনতা ও অগ্রণী ব্যাংক বুধবার ৯৬ টাকায় নগদ ডলার বিক্রি করেছে। বেসরকারি ইস্টার্ন ব্যাংক ৯৭ টাকা দরে ডলার বিক্রি করেছে। জানা গেছে, মহামারি করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে শুরু করায় আমদানি অস্বাভাবিক বেড়ে যায়। চাহিদা বাড়ায় বাজারে ডলারের সংকট দেখা দেয়। আমদানির লাগাম টেনে ধরতে সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংক নানা পদক্ষেপ নেয়ার পরও ডলারের বাজার স্বাভাবিক হচ্ছে না। বাজারে ডলারের চাহিদার জোগান দিতে ঈদের ছুটির পর প্রথম কর্মদিবস মঙ্গলবার আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজার দর ৯৩ টাকা ৪৫ পয়সা দরে ১৩ কোটি ৪০ লাখ ডলার বিক্রি করা হয়।
বুধবার বিক্রি করা হয়েছে ৯ কোটি ৭০ লাখ ডলার। ঈদের ছুটির আগে কয়েক দিনে বিক্রি করা হয়েছিল ৩৪ কোটি ৩০ লাখ ডলার। সব মিলিয়ে ১লা জুলাই থেকে শুরু হওয়া ২০২২-২৩ অর্থবছরের ১৩ দিনে (১ থেকে ১৩ই জুলাই) ৫৭ কোটি ৪০ লাখ ডলার বিক্রি করা হয়েছে। এর ফলে রিজার্ভ দুই বছর পর ৪০ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে এসেছে। মঙ্গলবার দিন শেষে রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ৩৯.৮০ বিলিয়ন ডলার। জ্বালানি তেল আমদানি নিয়ে চিন্তায় বিপিসি: প্রয়োজনীয় পরিমাণ ডলারের সংস্থানসহ চাহিদা অনুযায়ী এলসি (ঋণপত্র) খোলা সম্ভব না হলে দেশের জ্বালানি নিরাপত্তা বিঘ্নিত হতে পারে মর্মে বিপিসি আশঙ্কা প্রকাশ করেছে। গত ৫ই জুলাই পরিস্থিতি জানিয়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, অর্থ বিভাগ ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগে (ইআরডি) একটি চিঠি দিয়েছে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ। চিঠিতে বলা হয়, দেশের চাহিদার প্রায় শতভাগ জ্বালানি তেল বিদেশ থেকে আমদানি করা হয়। পর্যাপ্ত পরিমাণ ডলারের সংস্থান ও ঋণপত্র খোলার বিষয়ে সহযোগিতা চেয়ে ইতিমধ্যে একাধিকবার বাংলাদেশ ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগকে চিঠি দেয়া হয়েছে। এতে বলা হয়, জ্বালানি তেল আমদানিতে প্রতি মাসে ১৬ থেকে ১৭টি আমদানি ঋণপত্র খুলতে হয়। অভ্যন্তরীণ বাজারে ডলারের ঘাটতি রয়েছে জানিয়ে ব্যাংকগুলো চাহিদা অনুযায়ী ঋণপত্র খুলতে প্রায়ই অপারগতা প্রকাশ করছে। এ ছাড়া ঋণপত্র খুললেও তেল সরবরাহকারীর মূল্য পরিশোধে দেরি হচ্ছে। একাধিক কিস্তিতে পরিশোধ করতে হচ্ছে।
দেশে ৩৫ থেকে ৪০ দিনের জ্বালানি তেল মজুত করতে পারে বিপিসি। ঋণপত্র খোলা না গেলে নতুন করে জ্বালানি তেলের ক্রয়াদেশ দেয়া যাবে না। এতে করে তেল আমদানি কমে যাবে। সামনে সরবরাহ সংকট তৈরি হতে পারে। দেশের বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতার ৩৪ শতাংশ জ্বালানি তেলের ওপর নির্ভর করে। আর পরিবহন খাতের ৯০ শতাংশের বেশি নির্ভর করে জ্বালানি তেলের ওপর। এতে জ্বালানি তেল আমদানি ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়ছে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন। জ্বালানি বিশেষজ্ঞদের মতে, আমাদের প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে পর্যাপ্ত পরিমাণ টাকা থাকলেও সুফল পাবো না। কারণ জ্বালানির উচ্চমূল্যের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ডলার সংকট। বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো তেল নির্ভর। তেলের আমদানি কমলে ভয়াবহ পরিস্থিতি তৈরি হবে বিদ্যুৎখাতে। অন্যদিকে পরিবহন খাতও চাপে পড়বে।