বর্তমানে আন্তর্জাতিক আর্থিক লেনদেনের বাজারটি মূলত মার্কিন ডলারনির্ভর। বিশ্বের অধিকাংশ দেশেই ডলার হচ্ছে রিজার্ভ কারেন্সি। অর্থাৎ দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক নিজেদের সঞ্চয়ের ভান্ডারটি মার্কিন ডলারে সংরক্ষণ করে। আন্তর্জাতিক বাণিজ্য, আর্থিক লেনদেন ও বিনিয়োগ-সবকিছুই হয় ডলারের মাধ্যমে। ডলারের মাধ্যমে হওয়া আর্থিক লেনদেন করতে হয় যুক্তরাষ্ট্রের অর্থব্যবস্থার মধ্যস্থতায়। ফলে আন্তর্জাতিক আর্থিক লেনদেন ব্যবস্থার মধ্যমণি হলো যুক্তরাষ্ট্র। সেই লেনদেন যুক্তরাষ্ট্রের আইন অনুসারেই চলে। আপনি হয়তো সিঙ্গাপুরে বেড়াতে যাচ্ছেন, অনলাইনে হোটেল বুকিং দিতে চাইলে আপনাকে ডলারে পেমেন্ট করতে হবে। চাইলে ডলারের বাইরে অন্য মুদ্রায়ও পেমেন্ট করা যাবে। কিন্তু ডলারে মূল্য পরিশোধ সহজ এবং সবার কাছেই গ্রহণযোগ্য। নিউইয়র্কে অবস্থিত ‘দ্য ক্লিয়ারিং হাউজ ইন্টারব্যাংক পেমেন্টস সিস্টেম’ বা চিপসের মাধ্যমে প্রতিদিন আন্তঃদেশীয় ও আন্তর্জাতিক লেনদেনের পরিমাণ প্রায় ১ দশমিক ৮ লাখ কোটি ডলার। চিপসের সদস্য সংখ্যা মাত্র ৪৩। কোনো ব্যাংক চিপসের সদস্য নয়, এমন আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে এ ব্যবস্থার মাধ্যমে লেনদেন করতে হলে এ সদস্য ব্যাংক বা সংস্থাগুলোর মাধ্যমে করতে হয়। চিপসের সংশ্লিষ্ট অংশগ্রহণকারী সংস্থা বা সংস্থাগুলো তখন কাজ করে ওই প্রক্রিয়ার প্রতিনিধি বা এজেন্ট হিসাবে। এ কার্যক্রমকে বলা হয় ‘করেসপন্ডেন্ট ব্যাংকিং সিস্টেম’।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে পরাশক্তির মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রই একমাত্র দেশ, যাদের তেমন কোনো ক্ষতি হয়নি। তারা বরং সব দিক দিয়ে সুবিধাজনক অবস্থানে ছিল। বিশ্বের সবচেয়ে বেশি স্বর্ণের মজুত তখন তাদের কাছেই ছিল। স্বর্ণের ওপর ভিত্তি করে ডলারের মূল্যমান নির্ধারণ হতো। সে সময় ৪৪টি দেশ ডলারকে বৈদেশিক বাণিজ্যের মুদ্রা হিসাবে ব্যবহারে সম্মত হয়। সেটাই ছিল মুদ্রাবাজারে ডলারের আধিপত্যের শুরু। এভাবেই ডলার বিশ্বে একক আধিপত্য তৈরি করে। সেই কর্তৃত্ব আজও অব্যাহত আছে।
আন্তর্জাতিক লেনদেন কার্যপ্রক্রিয়ার আরেকটি গুরুত্বপূর্র্ণ অঙ্গ হলো ‘দ্য সোসাইটি ফর ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ইন্টারব্যাংক ফিন্যান্সিয়াল টেলিকমিউনিকেশন্স’ বা সুইফট। এটি এক ধরনের নিরাপদ বার্তা প্রেরণ পরিষেবা, যার সঙ্গে যুক্ত রয়েছে ২০০ দেশের ১১ হাজারেরও বেশি আর্থিক প্রতিষ্ঠান। এর সদর দপ্তর বেলজিয়ামে। গত বছর দৈনিক গড়ে ৪ কোটি ২০ লাখ মেসেজ আদান-প্রদান হয়েছে সুইফটের মাধ্যমে। আমরা পত্রিকায় দেখি, বাংলাদেশে ৪২ বিলিয়ন ডলার রিজার্ভ আছে। এ অর্থ আসলে দেশে নেই, আছে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক শহরে। এটি সব দেশের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। সরাসরি যুদ্ধ ঘোষণা না করে আর্থিক নিষেধাজ্ঞা আরোপের মাধ্যমে বেয়াড়া দেশকে শায়েস্তা করার বা তার অবাঞ্ছিত আচরণ বন্ধ করতে চাপ দেওয়ার পদ্ধতিটি বহু পুরোনো। এর মানে হচ্ছে, ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে রাশিয়ার যে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল, তা যুক্তরাষ্ট্র সুইফট সিস্টেম থেকে মস্কোকে বিচ্ছিন্ন করার মাধ্যমে আটকে দিয়েছে। তাই রাশিয়া এখন তার রিজার্ভ ডলার ব্যবহার করে কিছু কিনতে বা বিক্রি করতে পারছে না।
সুইফট বিশ্ব অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখলেও কোনো দেশের ওপর অবরোধ আরোপের আইনি ক্ষমতা তাদের নেই। সুইফট কর্তৃপক্ষের বক্তব্য-কারও ওপর নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার ব্যাপারটি নির্ভর করে কোনো দেশের সরকারের ওপর। সুইফটের রাজনৈতিক ব্যবহারের কারণেই এর গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সে কারণে রাশিয়া পালটা ব্যবস্থা হিসাবে বলছে, এখন থেকে যারা তাদের কাছ থেকে তেল-গ্যাস কিনবে, অবশ্যই তাদের রুশ মুদ্রা রুবলে অর্থ পরিশোধ করতে হবে। তা না হলে তারা কোনো পণ্য বিক্রি করবে না। এর মানে, এখন থেকে ক্রেতা দেশগুলোকে ডলার-ইউরো দিয়ে রুবল কিনতে হবে। এর অর্থ হচ্ছে, ডলারের একচেটিয়া আধিপত্যে রুবল ভাগ বসাল। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে প্রবেশ করল রুবল। ডলারের কর্তৃত্ব বা শক্তি কিছুটা হলেও খর্ব হলো বা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ল।
প্রশ্ন হচ্ছে, রুবল কি আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে ডলারের বিকল্প হয়ে উঠতে পারবে? রাশিয়ার বিরদ্ধে অবরোধ আরোপ এবং ইউক্রেনকে সহযোগিতা করার কারণে রুশ প্রশাসন একটি অবন্ধু দেশের তালিকা প্রকাশ করেছে। সে সময় তারা ঘোষণা করেছে, রাশিয়ার কাছ থেকে যেসব দেশ তেল-গ্যাস কিনবে, তাদের অবশ্যই রুবলে অর্থ পরিশোধ করতে হবে। তাদের এ ঘোষণা পশ্চিমা দেশগুলোর জন্য ছিল অকল্পনীয়। রাশিয়া প্রতি মাসে পশ্চিমা দেশগুলোতে ৩০ বিলিয়ন ইউরোর জ্বালানি বিক্রি করে। তাদের শর্ত অনুযায়ী এখন থেকে ইউরোপকে এ অর্থ রুবলে পরিশোধ করতে হবে। ইতোমধ্যে জার্মানিসহ ইউরোপের চারটি দেশ রুবলেই তাদের দাম পরিশোধের ঘোষণা দিয়েছে। রুবলে অর্থ পরিশোধ করতে না পারায় বুলগেরিয়া ও পোল্যান্ডে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ করে দিয়েছে রাশিয়া। বুলগেরিয়ার ৯০ শতাংশ এবং পোল্যান্ডের ৫৩ শতাংশ গ্যাস আসে রাশিয়া থেকে। এসডিটিডির তথ্য মোতাবেক, রাশিয়ার গ্যাসের মূল্য রুবলে পরিশোধ করতে ইউরোপের আরও দশটি কোম্পানি রাশিয়ার রাষ্ট্র মালিকানাধীন জ্বালানি কোম্পানি গাজপ্রমে হিসাব খুলেছে। এ নিয়ে এখন পর্যন্ত ইউরোপের অন্তত ২০টি কোম্পানি গাজপ্রমে হিসাব খুলল। অর্থাৎ পুতিনের শর্ত মেনেই রাশিয়ার গ্যাসের ওপর নির্ভরশীল ইউরোপের কোম্পানিগুলো গাজপ্রমে হিসাব খুলছে।
পশ্চিমাদের এ নজিরবিহীন অর্থনৈতিক আক্রমণে শুরুতে টলে ওঠে মস্কোর অর্থনীতি। ডলারের বিপরীতে ধস নামে রাশিয়ার মুদ্রা রুবলে। ৪০ শতাংশ মান হারিয়ে মার্চের ৭ তারিখে ডলারের বিপরীতে রুবলের মান দাঁড়ায় ১৩৯। এ সময় মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ঠাট্টা করে রুবলকে ‘রাব্ল’ বলে অভিহিত করেন। কিন্তু পুতিন শুধু যুদ্ধের ময়দানেই নয়, অর্থনীতির লড়াইয়েও পশ্চিমাদের সমান টেক্কা দিতে পারেন। রুশ মুদ্রা দ্রুত ফিরে আসে যুদ্ধপূর্বের অবস্থানে। বর্তমানে ডলারের বিপরীতে চার বছরের মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী অবস্থানে রয়েছে রুবল। এ ছাড়া ইউরোর বিপরীতে সাত বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ শক্তিশালী অবস্থানে রুবল। রাশিয়ার মুদ্রা তহবিল নিয়ন্ত্রণ, রুবলে বিদেশি কোম্পানিগুলোর গ্যাসের মূল্য পরিশোধ এবং বকেয়া করপোরেট ট্যাক্স পরিশোধের চাপ বৃদ্ধির কারণে রুশ মুদ্রা বেশি শক্তিশালী হয়ে উঠছে। মস্কো এক্সচেঞ্জের তথ্য অনুসারে, গত ২১ মে সকালে প্রতি ডলারের বিপরীতে ৫৭ দশমিক ৬৭ রুবল বিক্রি হয়েছে। ২০১৮ সালের মার্চ মাসের পর এই প্রথম ডলার ও ইউরোর বিপরীতে রাশিয়ার মুদ্রা এত বেশি শক্তিশালী হলো। এছাড়া ইউরোর বিপরীতে ৫ শতাংশ শক্তি অর্জন করেছে রুবল। মার্কিন গণমাধ্যম ব্লুমবার্গের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রাশিয়ার বিরুদ্ধে নজিরবিহীন নিষেধাজ্ঞা দেওয়া সত্ত্বেও ডলার ও ইউরোর বিপরীতে রুবল শক্তিশালী হয়েছে, যা সত্যিই উদ্বেগজনক। দি ইকোনমিস্ট প্রাথমিক তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে জানিয়েছে, রুশ অর্থনীতি ধসের পূর্বাভাসকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখাচ্ছে মস্কো। সামষ্টিক অর্থনীতি ব্যবস্থাপনায় কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছে দেশটি। রাশিয়ার কেন্দ্রীয় ব্যাংক পুঁজি প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ ও উচ্চ সুদহার কার্যকর করে সমর্থন দেওয়ায় রুবলের পতন ঠেকানো গেছে।
ইউক্রেনে সামরিক হামলার কারণে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে বেশ কয়েকটি দেশ রাশিয়ার ওপর একগুচ্ছ আর্থিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। কিন্তু এ বিশ্বায়িত অর্থব্যবস্থায় রাশিয়া বিচ্ছিন্ন কোনো অস্তিত্ব নয়-জ্বালানি ও পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে সে দেশ বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ সরবরাহকারী। তাই এ আর্থিক নিষেধাজ্ঞার আঁচ লাগছে তার সঙ্গে বাণিজ্য সূত্রে যুক্ত দেশগুলোর গায়েও। সেসব দেশ ক্ষতির মাত্রা বিচার করে বিকল্প ব্যবস্থা খোঁজার চেষ্টা করছে।
রাশিয়ার ওপর যে এত নিষেধাজ্ঞা হতে পারে, তা কি পুতিন আঁচ করতে পারেননি আগে? আমরা একটু পেছনে তাকিয়ে দেখি। এর আগে ২০১৪ সালে রাশিয়া ইউক্রেনের একটি অংশ ক্রিমিয়া দখল করার জন্য সেখানে সৈন্য পাঠানোর পর তাদের ওপর প্রথম দফায় আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছিল এবং ওই ঘটনা থেকে রাশিয়া গুরুত্বপূর্ণ কিছু শিক্ষা গ্রহণ করেছে। এর পর থেকেই রাশিয়া আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা মোকাবিলার জন্য কিছু প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গড়ে তুলেছে। দেশটি ডলারের ওপর নির্ভরতা কমিয়ে এমন এক অর্থনীতি গড়ে তোলার চেষ্টা করেছে, যার ওপর নিষেধাজ্ঞার তেমন একটা প্রভাব পড়বে না। এ বছরের জানুয়ারিতে রুশ সরকারের আন্তর্জাতিক রিজার্ভের পরিমাণ রেকর্ড পর্যায়ে পৌঁছেছে। বৈদেশিক মুদ্রা ও স্বর্ণে এ রিজার্ভের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ৬০ হাজার কোটি ডলার। বিশ্বের সব দেশের তুলনায় রাশিয়ার এ রিজার্ভ চতুর্থ বৃহত্তম, যা রুবলের পতন ঠেকিয়ে একে চাঙা রাখতে একটা উল্লেখ্যযোগ্য সময় পর্যন্ত ব্যবহার করা যেতে পারে। বিবিসির তথ্য মোতাবেক, বর্তমানে রাশিয়ার বৈদেশিক মুদ্রার মাত্র ১৬ শতাংশ ডলারে রাখা। পাঁচ বছর আগেও এর পরিমাণ ছিল ৪০ শতাংশ। অন্যদিকে রাশিয়ার বর্তমান বৈদেশিক মুদ্রার প্রায় ১৩ শতাংশ রাখা চীনা মুদ্রা রেনবিনমিতে। এসবই পরিকল্পিতভাবে করা হয়েছে এবং এটি করা হয়েছে আমেরিকার নেতৃত্বে রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হলে তা থেকে নিজেদের রক্ষা করার জন্য। এ ছাড়া রাশিয়ার অর্থনৈতিক কাঠামোতেও বড় ধরনের কিছু পরিবর্তন আনা হয়েছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে দেশটি বৈদেশিক ঋণ ও বিনিয়োগের ওপর তাদের নির্ভরতা কমিয়েছে। একইসঙ্গে তারা পশ্চিমা বাজারের বাইরে নতুন নতুন দেশের সঙ্গে বাণিজ্যের সুযোগ-সম্ভাবনা যাচাই করে দেখছে। তাদের এ নতুন কৌশলের একটি বড় অংশ চীন। আন্তর্জাতিকভাবে অর্থ লেনদেনের ব্যাপারেও রাশিয়া তাদের নিজস্ব একটি ব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য ইতোমধ্যে প্রাথমিক কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। এ ছাড়া রাশিয়া তার বাজেটও কাটছাঁট করে এনেছে। প্রবৃদ্ধির বদলে এখন তারা অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতাকেই বেশি অগ্রাধিকার দিচ্ছে। এর ফলে রাশিয়ার অর্থনীতি গত এক দশকে প্রতিবছর গড়ে ১ শতাংশেরও কম হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে এ প্রক্রিয়ায় দেশটির অর্থনীতি আগের চেয়ে আরও বেশি সংহত হয়েছে। রাশিয়া যা করছে, এর মধ্য দিয়ে কার্যত তারা বিকল্প এক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে তুলছে, যাতে তারা পশ্চিমা বিশ্বের সম্ভাব্য নিষেধাজ্ঞার আঘাত সামাল দিতে পারে।
চীনের উত্থানে যুক্তরাষ্ট্র শঙ্কিত। রাশিয়াও নিজেদের অবস্থান সংহত করেছে। চীন ও রাশিয়া নিজেদের বৈরিতা ভুলে একযোগে কাজ করলে সেটি হবে বিশ্বরাজনীতি ও পরাশক্তি ক্ষমতাতন্ত্রের এক নতুন সমীকরণ। যুক্তরাষ্ট্রকে পেছনে ফেলে সামনে এগিয়ে যাওয়ার সক্ষমতা চীন ও রাশিয়ার আছে। দেশ দুটি কয়েক বছর ধরেই আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে একটি বৈশ্বিক মুদ্রা ও সুইফটের বিকল্প ব্যবস্থা চালুর কথা বলছে। চীন ও সৌদি আরব চীনা মুদ্রা ইউয়ানের ব্যবহার নিয়ে অনেকদিন ধরে আলোচনা চালিয়ে আসছে। সেটি না হলেও বিশ্ব অর্থনীতিতে রুবল-ইউয়ান প্রবেশ করছে। কারণ আইএমএফ ইতোমধ্যে ইউয়ানকে আন্তর্জাতিক মুদ্রা হিসাবে স্বীকৃতি দিয়েছে। এগুলো অবশ্যই ডলারের জন্য সুখবর নয়। সুইফটের বিকল্প সমতাভিত্তিক বৈশ্বিক মুদ্রাব্যবস্থা যেদিন চালু হবে, সেদিন থেকে বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্রের একক আধিপত্যের যবনিকাপাত ঘটবে।
করোনা মহামারির সময়ে অনেক উন্নয়নশীল দেশের ঋণের পরিমাণ বেড়ে গেছে, অনেক কিস্তি জমে গেছে। এখন খাদ্য ও জ্বালানি পণ্যের দামের ঊর্ধ্বগতির মধ্যে বিদেশি মুদ্রার সংকটে পড়ে কিস্তি পরিশোধে সমস্যায় পড়ছে অনেক দেশ। ইউক্রেনে রাশিয়ার সামরিক অভিযানের জেরে বেড়ে চলা খাদ্য সংকট বিশ্বকে একটি মানবিক বিপর্যয়ের মুখে ফেলে দেবে। যদি এ যুদ্ধ চলতে থাকে, তাহলে খাদ্যপণ্যের রেকর্ড দামবৃদ্ধি লাখ লাখ মানুষকে অপুষ্টি ও দারিদ্র্যের দিকে ঠেলে দিতে পারে, যা একটি মানবিক বিপর্যয় ডেকে আনবে। রাশিয়া ও ইউক্রেন বিশ্বের অন্যতম প্রধান খাদ্য গমের রপ্তানিকারক। কিন্তু যুদ্ধ ও নিষেধাজ্ঞার কারণে বাংলাদেশসহ বিশ্বের বেশিরভাগ দেশে এ সরবরাহ বন্ধ হয়ে গেছে। শুধু গম নয়, বাংলাদেশ এ দুটি দেশ থেকে ডাল, ইস্পাত, সার ও বীজও আমদানি করে থাকে। শুধু বাংলাদেশে নয়, বিশ্বব্যাপী এ গমের রপ্তানি বন্ধ হয়ে গেছে। যুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হলে এর প্রভাব পোশাক রপ্তানি খাতে, কাঁচামাল সরবরাহে, রপ্তানি ও আমদানি বাণিজ্যে পড়বে। আমরা এমন পরিস্থিতি চাই না।
ডলারের আধিপত্য না থাকার আরেকটি পরোক্ষ মানে হলো, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) কর্তৃত্বও কিছুটা খর্ব হওয়া। আইএমএফকে ব্যবহার করে যুক্তরাষ্ট্র তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোকে যেভাবে তার পছন্দের অর্থনৈতিক মডেল গ্রহণে বাধ্য করছে, সেটি আগামী দিনে আর সহজ নাও হতে পারে। এ যুদ্ধ সহজেই শেষ হচ্ছে না বলেই ইতোমধ্যে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ও ন্যাটো মহাসচিবসহ অনেকে ইঙ্গিত দিয়েছেন। তাদের বক্তব্য-এ যুদ্ধ আরও কয়েক বছর দীর্ঘ হতে পারে। সেটি হলে বিশ্বরাজনীতি ও অর্থনীতিতে বেশকিছু পরিবর্তন অনিবার্য হয়ে উঠবে। তার মধ্যে একটি হলো ডলারের বিকল্প মুদ্রার প্রচলন। কারণ রাশিয়া তার বিরুদ্ধে আরোপিত অবরোধের পালটা ব্যবস্থা হিসাবে তার নিজস্ব মুদ্রা নিয়ে অগ্রসর হবে এবং রুবল সহসাই ডলারের বিকল্প না হয়ে উঠতে পারলেও বিশ্ববাণিজ্যে স্থান করে নিতে পারবে।
পান্না কুমার রায় রজত : অর্থনীতি বিশ্লেষক