দুর্নীতি দমনে জরুরি রাজনৈতিক সদিচ্ছা
বরাবরের মতো এবারও জার্মানিভিত্তিক দুর্নীতিবিরোধী সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল (টিআই) দুর্নীতির ধারণা সূচক প্রকাশ করেছে।
এতে দেখা যাচ্ছে, ১৮০টি দেশের মধ্যে ২০২১ সালে অধঃক্রম অনুযায়ী (খারাপ থেকে ভালো) বাংলাদেশের অবস্থান ১৩তম, যা আগের বছর ছিল ১২তম।
অর্থাৎ দুর্নীতির ধারণা সূচকে বাংলাদেশ এক ধাপ এগিয়েছে। অন্যদিকে দুর্নীতির পরিস্থিতিসংক্রান্ত স্কোরে ১০০ নম্বরের মধ্যে এবারসহ টানা চার বছর বাংলাদেশ পেয়েছে ২৬। অর্থাৎ বাংলাদেশে দুর্নীতি কমেনি। টিআই’র প্রতিবেদনে এবার সবচেয়ে কম দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ হিসাবে ডেনমার্ক এবং সবচেয়ে বেশি দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ হিসাবে সুদানকে চিহ্নিত করা হয়েছে।
বাংলাদেশে দুর্নীতি যে আশানুরূপ কমছে না, তার কারণ অনেক। টিআইবি’র নির্বাহী পরিচালক বলেছেন, দেশে এক ধরনের বিচারহীনতার সংস্কৃতি তৈরি করে দুর্নীতিবাজদের পৃষ্ঠপোষকতা দেওয়া হচ্ছে। এমনকি দুর্নীতিসংক্রান্ত কোনো প্রতিবেদন প্রকাশ করা হলে নাগরিক সমাজ ও গণমাধ্যম কর্মীদের নাজেহাল হওয়ার ঘটনাও ঘটে থাকে। এতে দুর্নীতিবাজরা উৎসাহিত হচ্ছে। টিআইবি’র মহাপরিচালক আরও বলেছেন, বিভিন্ন নীতি ও তার প্রয়োগ ক্রমাগত জনবিচ্ছিন্ন হয়ে ক্ষমতাবানদের প্রতি পক্ষপাতিত্ব তৈরি হওয়া, রাজনৈতিক শুদ্ধাচারের অবক্ষয়, ক্ষমতার অপব্যবহার, সরকারি কাজে দলীয় রাজনৈতিক প্রভাব, দুর্নীতি ও অপরাধের সঙ্গে রাজনৈতিক যোগসূত্রতা এবং রাঘববোয়ালদের জবাবদিহিতার আওতায় আনতে ব্যর্থতা ইত্যাদি কারণে দুর্নীতি সংঘটিত হচ্ছে। ওদিকে টিআই’র প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে, দেশে সরকারি সেবা পেতে ৮৯ শতাংশ মানুষ ঘুস দিতে বাধ্য হচ্ছেন। এক্ষেত্রে বিচারহীনতা নিয়মে পরিণত হয়েছে। ক্ষমতার সঙ্গে সম্পর্ক দেখাতে পারলেই অপরাধ করে পার পাওয়া যাচ্ছে। দুর্নীতির কারণে প্রতিবছর দেশের জাতীয় আয়ের কমপক্ষে ৩ শতাংশ ক্ষতি হচ্ছে আর বিভিন্ন মাধ্যমে প্রতিবছর ১২ বিলিয়ন ডলার পাচার হয়ে যাচ্ছে।
দেশে দুর্নীতির যে চালচিত্র, তা থেকে উত্তরণের উপায় নিয়ে অনেক কথাবার্তাই হয়েছে। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। আমরা মনে করি, দুর্নীতি নির্মূল কিংবা কমিয়ে আনার ক্ষেত্রে অনেক কিছুই করার আছে। প্রথম দায়িত্বটা নিতে হবে দুর্নীতি দমন কমিশনকে (দুদক)। আমরা লক্ষ করছি, দুদক দুর্নীতি দমনে তৎপর থাকলেও আশানুরূপ সাফল্য দেখাতে পারছে না। এর কারণ অনেক। প্রথমত, দুদক সম্পূর্ণরূপে স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারছে কিনা, তা এক প্রশ্ন। দ্বিতীয়ত, দুদকের বর্তমান যে ক্ষমতা, তা যথেষ্ট নয়। সম্প্রতি দুদকের পক্ষ থেকে এ সংস্থার ক্ষমতা বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। আমরা বলব, দুদকের এই প্রস্তাব আমলে নিতে হবে। তৃতীয়ত, দুদকের অভ্যন্তরীণ দুর্নীতিও দুর্নীতি প্রতিরোধে এক বড় অন্তরায় হিসাবে কাজ করছে। অবশ্য দুদক কর্তৃপক্ষ সংস্থার অভ্যন্তরীণ দুর্নীতির ব্যাপারে গা ঝাড়া দিয়ে উঠেছে। বেশ কিছু কর্মকর্তার ব্যাপারে অনুসন্ধান ও তদন্ত চলছে। দুর্নীতি দমনে দ্বিতীয় শর্ত হচ্ছে, এর বিরুদ্ধে সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তোলা। সমাজের বর্তমান যে অবস্থা, তাতে দেখা যায়, দুর্নীতি যেন মানুষের গা সওয়া হয়ে গেছে। দুর্নীতিবাজদের প্রতি এখন আর ঘৃণা প্রকাশ করতে দেখা যায় না। মানুষের এই দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন ঘটাতে হবে। প্রয়োজনে দুর্নীতিবাজদের সামাজিকভাবে বয়কট করতে হবে। তবে দুর্নীতি দমনে সবচেয়ে জরুরি হলো সরকারের রাজনৈতিক সদিচ্ছা। সরকার যদি দুর্নীতিবাজদের প্রতি হার্ডলাইন নীতি গ্রহণ করে এবং সরকারদলীয় দুর্নীতিবাজদের প্রশ্রয় না দেয়, তাহলে দুর্নীতি অনেকাংশে কমে আসবে, সন্দেহ নেই। আমাদের অনুরোধ থাকবে, টিআই’র দুর্নীতিসংক্রান্ত ধারণা সূচক আমলে নিয়ে সরকার যেন দেশ থেকে দুর্নীতি দূর করতে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা গ্রহণ করে।