Sunday, March 26, 2023
spot_img
Homeবিজ্ঞান ও প্রযুক্তিজ্যাক মা বিস্ময় চীনের দুই সমস্যা

জ্যাক মা বিস্ময় চীনের দুই সমস্যা

ইন্টারনেট প্রযুুক্তিকে ব্যবহার করে সারাবিশ্বে পরিচিতি পেয়েছেন জ্যাক মা। শুধু পরিচিতি পেয়েছেন এমন না। তিনি হয়েছেন বিলিয়নিয়ার। দেখিয়ে দিয়েছেন ইচ্ছা আর বুদ্ধি থাকলে বিলিয়নিয়ার হওয়া খুব কঠিন বিষয় নয়। দিন দিন তিনি আলিবাবা নামের অনলাইন প্রতিষ্ঠানের এক বিশ্বজোড়া সাম্রাজ্য গড়ে তোলেন।

সেখানে নিয়ন্ত্রক তিনি। তার নির্দেশনায় কোটি কোটি টাকার বাণিজ্য করে আলিবাবা। চীনাদের শপিং অভ্যাস বদলে ফেলেন তিনি। ঘরে বসেই কেনাকাটায় অভ্যস্ত হয়ে পড়েন তারা। রাতারাতি পুরো এশিয়া তথা বিশ্বের কাছে এক বিস্ময়ের নাম হয়ে ওঠেন জ্যাক মা। তার ব্যবসার কারণে চীনা কর্তৃপক্ষ বিপুল পরিমাণ রাজস্ব হারাচ্ছিল। তাদের ব্যবসা সংকুচিত হচ্ছিল। এক পর্যায়ে তিনি চীনের কিছু ব্যাংকের বিরুদ্ধে সমালোচনা করেন। আর্থিক প্রতিষ্ঠানে নজরদারিকারী সংস্থার বিরুদ্ধে কঠোর সমালোচনা করেন। ব্যাস, কর্তৃপক্ষের বাঁকা নজরে পড়ে যান জ্যাক মা। অমনি তার সাম্রাজ্য সমস্যার আবর্তে ঘূর্ণিপাক খেতে থাকে। আস্তে আস্তে তিনি নিয়ন্ত্রণ হারানোর পথে, নিজের সৃষ্ট প্রতিষ্ঠানে।  জ্যাক মা অনলাইন প্রতিষ্ঠান আলিবাবা প্রতিষ্ঠা করে হয়েছেন বিলিয়নিয়ার। 

চীনের প্রযুক্তি জগতের স্বপ্নকে আকাশচুম্বী করেছেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত নিয়ন্ত্রক সংস্থার কারণে তার নিজের সেই স্বপ্ন ধূলিসাৎ হয়ে যাচ্ছে। তার বিরুদ্ধে চীনের কমিউনিস্ট পার্টি দমনপীড়ন শুরুর পর থেকে জ্যাক মার এই সাম্রাজ্যের পতন শুরু হয়েছে। তিনি এশিয়ার ব্যবসায় সবচেয়ে স্বীকৃত এক মুখ। তার সম্পদের পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় ২৫০০ কোটি ডলার। কিন্তু কর্তৃপক্ষ তার বিরুদ্ধে দমনপীড়নের ফলে সেই পরিমাণ অর্ধেকে নেমে এসেছে। বিশ্বের এ যাবৎকালের সবচেয়ে বড় আইপিও বন্ধ করে দেয়া হয় ২০২০ সালে। চীনের নিয়ন্ত্রক সংস্থা এই পরিকল্পনা করে জ্যাক মার হংকং এবং সাংহাইয়ে অ্যান্ট গ্রুপকে তালিকাভুক্তির মাধ্যমে। এর পরের বছরেই আলিবাবাকে অনিয়মের অভিযোগে জরিমানা করা হয় রেকর্ড ২৭৫ কোটি ডলার। অ্যান্ট গ্রুপের শেয়ারহোল্ডিং কাঠামো নতুন করে সাজানো হচ্ছে। এতে ২০১৪ সালে নিজের প্রতিষ্ঠিত এই জায়ান্ট প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণ হারাতে পারেন জ্যাক মা। এতে তিনি কোম্পানির ভোটিং রাইটসের শতকরা মাত্রা ৬.২ ভাগের মালিক হবেন। কারণ, কোম্পানি এটা নিশ্চিত করতে চাইছে যে, এককভাবে হোক বা তৃতীয় পক্ষের সঙ্গে যৌথভাবে হোক- কোনো শেয়ারহোল্ডারের অ্যান্ট গ্রুপের ওপর কোনো নিয়ন্ত্রণ থাকবে না। শনিবার এক বিবৃতিতে এই তথ্য জানানো হয়েছে।  অথচ এক সময় উদ্যোক্তা জগতে চীনে পোস্টারবয় হিসেবে পরিচিত হয়েছিলেন জ্যাক মা। কিন্তু কোম্পানির এই উদ্যোগের ফলে এক সময়ের পোস্টারবয় হয়ে উঠবেন নামমাত্র শেয়ারহোল্ডার। জ্যাক মা চীনের কমিউনিস্ট পার্টির একজন সদস্য। চীনে উদ্যোক্তা জগতে আত্মবিশ্বাসী এক প্রজন্মের প্রতিচ্ছবি হয়ে উঠেছিলেন তিনি।

 অল্প থেকে ধনীতে পরিণত হয়ে উঠেছিলেন। আর তাতেই তিনি বিশ্বকে কাঁপিয়ে দিয়েছিলেন। তাকে নিয়ে পশ্চিমা দুনিয়ার খবরের কাগজগুলোতে কভার স্টোরি প্রকাশিত হয়েছে। তিনি ক্যারিশম্যাটিক। তিনি অল্প কথা বলেন। কিন্তু দ্রুত কথা বলেন। তিনি ছিলেন নগদ অর্থহীন। একজন ইংরেজির শিক্ষক হিসেবে কাজ করতেন। এমন সময়ে ১৯৯০-এর দশকে যুক্তরাষ্ট্র সফরকালে কেউ একজন তাকে ইন্টারনেটের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়। সেই থেকে তিনি ইন্টারনেটের সঙ্গে যুক্ত। ইন্টারনেট সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন প্রকল্প নিয়ে তিনি পরীক্ষা করতে থাকেন। এক পর্যায়ে একদল বন্ধুর কাছ থেকে ৬০ হাজার ডলার সংগ্রহ করে ১৯৯৯ সালে চীনে নতুন ব্যবসা শুরু করেন। তারপর থেকেই তিনি অর্থনীতির একজন জায়ান্ট হিসেবে আবির্ভূত হন।  চীনের পূর্বাঞ্চলীয় শহর হ্যাংঝৌতে নিজের বেডরুম থেকে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন একটি ই-কমার্সের ব্যবসা। যার ফল হিসেবে বেরিয়ে আসে আলিবাবা। অনলাইনে  কেনাবেচা শুরু করেন। রাতারাতি বিপ্লব ঘটিয়ে দেন তিনি। আর হয়ে ওঠেন একজন টাইটান। চীনের লাখ লাখ মানুষের শপিং অভ্যাস পাল্টে দেয় এই কোম্পানি। তারা মার্কেটে গিয়ে দরদাম করার চেয়ে ঘরে বসে কেনাকাটায় অভ্যস্ত হয়ে পড়েন। এতে আন্তর্জাতিক তারকাখ্যাতি এনে দেয় জ্যাক মা’কে।  সিএনএনকে একবার জ্যাক মা বলেছিলেন, প্রথমে যখন আমি ইন্টারনেট ব্যবহার করি তখন কিবোর্ড স্পর্শ করি এবং আমার মাথায় বুদ্ধি এসে যায়- এটা ব্যবহার করে আমার মনে হয় এমন কিছু করতে পারি, যা বিশ্ব এবং চীনকে বদলে দিতে পারে।

  ২০১৪ সালে নিউ ইয়র্কের শেয়ারবাজারে ২৫০০ কোটি ডলারের অফার দেয়া  কোম্পানি হিসেবে তালিকাভুক্ত হয়। এটা তখন বিশ্বরেকর্ড। এখনো অ্যান্ট গ্রুপ বিশ্বের সবচেয়ে বড় ডিজিটাল পেমেন্টের প্ল্যাটফরম। প্রতি মাসে লাখ লাখ মানুষ আলিবাবা অ্যাপ ব্যবহার করেন।  দীর্ঘদিন ধরে বিশ্বের উদার এবং প্রথাগত বিলিয়নিয়ার নন এমন একজন ব্যক্তির ইমেজ ধারণ করছিলেন। চীনে কেউ তাকে ‘ফাদার মা’ হিসেবে অভিহিত করতে থাকেন। তিনি নিজে যে অর্জন করেছেন তার স্বীকৃতি হিসেবে এই প্রশংসা। লেডি গাগা, স্নো হোয়াইট এবং মাইকেল জ্যাকসনের মতো শিল্পীদের সঙ্গে কোম্পানির ইভেন্টকে আলোকিত করার জন্যও তিনি সুপরিচিত। কোম্পানির সম্পদ বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে তিনি জনহিতৈষী হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে থাকেন। এ জন্য ব্যবসা থেকে অবসরে যান ২০১৯ সালে। পরোক্ষভাবে অ্যান্ট গ্রুপের শতকরা ৫৩.৪৬ ভাগ শেয়ার ছিল তার নিয়ন্ত্রণে। এর ফলে কোম্পানিটির ‘কন্ট্রোল পারসন’ হয়ে উঠেছিলেন তিনি। কিন্তু এখন ভোটিং রাইটসের শতকরা মাত্র ৬.২ ভাগ তার নিয়ন্ত্রণে থাকবে। অ্যান্ট গ্রুপ এক বিবৃতিতে বলেছে, প্রতিষ্ঠাতা, ব্যবস্থাপনা এবং স্টাফ সহ দশ জন ব্যক্তিবিশেষ এখন নিরপেক্ষভাবে তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারবেন।  কিন্তু পুঁজি নিয়ে গবেষণা করেন অ্যানড্রু কোলিয়ার। তিনি বলেছেন, জ্যাক মা’কে নিয়ে চীনের দুটি সমস্যা আছে। প্রথমত, তিনি সুশৃঙ্খলভাবে অর্থায়ন করেছেন। অত্যন্ত জনপ্রিয় একজন বিলিয়নিয়ার। তিনি দুটি বৃহৎ কোম্পানি নিয়ন্ত্রণ করেন। দ্বিতীয় হলো, তিনি চীনের রাষ্ট্র মালিকানাধীন কিছু ব্যাংকের সঙ্গে প্রতিযোগিতা শুরু করেছিলেন। এই ব্যাংকগুলোকে বলা হয়, চীনের অর্থনীতির মেরুদণ্ড। এ দুটি কারণে চীনারা মনে করেছে, তিনি রাষ্ট্রের জন্য একটি হুমকি। ফলে তারা তাকে সাইজ করে দেয়ার টার্গেট নিয়েছে।

  অ্যান্ট গ্রুপ তার দুই বছরের নিয়ন্ত্রক বিষয়ক কাঠামো পুনর্বিন্যাসের খুব কাছাকাছি। এ সময়ে জ্যাক মা সম্ভবত তার নিয়ন্ত্রণ হারাচ্ছেন। তার প্রতিষ্ঠানকে রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষ কমপক্ষে ১০০ কোটি ডলার জরিমানা করেছে। বিশেষ করে জ্যাক মা’র দিকে চীনা কর্তৃপক্ষ শ্যেনদৃষ্টিতে তাকাতে থাকে সাংহাইয়ে এক সামিটে বক্তব্য দেয়ার পর। ওই সামিটে এই টাইকুন বলেন, চীনের ব্যাংকগুলো ‘নগণ্য দোকানের’ মানসিকতা নিয়ে কার্যক্রম চালাচ্ছে। একই সঙ্গে আর্থিক নজরদারিদের বিরুদ্ধে তিনি প্রবৃদ্ধিকে গলাটিপে ধরার অভিযোগে অভিযুক্ত করেন। গত দুই বছরের বেশি সময় দেশটির প্রযুক্তি বিষয়ক এই টাইটানের বিরুদ্ধে দমনপীড়নের অংশ হিসেবে শাস্তি বা পেনাল্টি আরোপ করবে বলেই মনে করা হয়েছে। কারণ, জ্যাক মা’র এই ব্যবসার কারণে কর্তৃপক্ষ শত শত কোটি ডলার হারিয়েছে। তাদের রাজস্ব ও লভ্যাংশ সংকুচিত হয়েছে। তবে সম্প্রতি প্রযুক্তি বিষয়ক দমনপীড়নের বিষয়ে কণ্ঠ নমনীয় করেছে চীনা কর্তৃপক্ষ। তারা কোভিড-১৯ মহামারির কারণে অর্থনীতিতে যে ভয়াবহ ক্ষতি হয়েছে, সেই ১৭ ট্রিলিয়ন ডলারের অর্থনীতিকে উন্নত করার উদ্যোগ নিয়েছে।  ওদিকে অ্যান্ট গ্রুপের আইপিও ব্যর্থতার পর থেকে জ্যাক মা জনসমাবেশে উপস্থিতি কমিয়ে দিয়েছেন। মাঝেমধ্যে তিনি কিছু দাতব্য সংস্থার অনুষ্ঠানে উপস্থিত হন। মাঝে মাঝে বিদেশ সফরে যান।

RELATED ARTICLES
- Advertisment -
Google search engine

Most Popular

Recent Comments