ইন্টারনেট, লাইব্রেরি, গবেষণাপত্রের সমাহার, সংবাদমাধ্যম এবং অন্যান্য লেখনীভিত্তিক তথ্যের সংকলন ব্যবহার করে একটি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে প্রায় সব বিষয়ে পারদর্শী করে তোলা হয়েছে। এরপর যাতে প্রাপ্ত জ্ঞান ব্যবহার করে নতুন সব সমস্যার সমাধান করতে পারে এবং প্রশ্নের উত্তর দিতে পারে সেভাবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআইটিকে প্রশিক্ষণ দিয়েছেন গবেষকরা। এরপর তার সঙ্গে জুড়ে দিয়েছেন ওপেনএআইর তৈরি জিপিটি-৩ ন্যাচারাল ল্যাঙ্গুয়েজ প্রসেসিং সিস্টেম, যাতে চলিত ভাষায় কথোপকথন চালাতে পারে সেটি। ফলাফল, লিখিত চ্যাটের মাধ্যমে কথাবার্তা বলে প্রশ্ন ও সমস্যা বুঝিয়ে দেওয়া যায় এমন একটি এআই, যাকে বলা হয় ‘চ্যাট জেনারেটিভ প্রি-ট্রেইনড ট্রান্সফরমার’ বা সংক্ষেপে ‘চ্যাটজিপিটি’।
যেভাবে চ্যাটজিপিটি কাজ করে
প্রথমেই chat.openai.com ওয়েবসাইটে গিয়ে অ্যাকাউন্ট করতে হবে। অ্যাকাউন্ট ভেরিফিকেশন শেষ করার পর লগ ইন করলেই চ্যাটজিপিটির সঙ্গে কথাবার্তা শুরু। কিভাবে চ্যাটজিপিটিকে নিজের প্রয়োজন বুঝিয়ে দেওয়া যায়, সেটার কিছু উদাহরণ শুরুতেই দেওয়া হবে। যেমন—‘মার্বেল কেক তৈরিতে কী লাগে এবং কিভাবে তৈরি করা যায়?’ প্রশ্নটি করলে তার উত্তরে প্রয়োজনীয় উপকরণের লিস্ট এবং ধাপে ধাপে কেক তৈরির নির্দেশাবলি পাওয়া যাবে উত্তরে। বা যদি জিজ্ঞাসা করা হয় ‘ব্ল্যাকহোল কিভাবে তৈরি হয়?’ সেটারও চমৎকার উত্তর চ্যাটজিপিটি দিতে সক্ষম। একবার চ্যাট শুরু করলে সে সেশনের সব কথোপকথন মনে রেখে সেটার ওপর ভিত্তি করে পরবর্তী প্রশ্নের উত্তর দিতে পারে। যেমন—যদি মার্বেল কেক তৈরির প্রশ্নের পর জিজ্ঞেস করা হয় ‘কেকটি ডায়াবেটিক রোগীর উপযোগী করো’, তাহলে রেসিপিটিতে প্রয়োজনীয় পরিবর্তন তখনই করে দেবে চ্যাটজিপিটি—পুরো প্রশ্ন নতুন করে করতে হবে না। এআইর জন্য এটি বিশাল অগ্রগতি। তবে সেশন বন্ধ করে দিলে সেটার সব তথ্য মুছে যাবে, আগের কথোপকথন মনে রাখবে না চ্যাটজিপিটি।
তবে চ্যাটজিপিটির মূল ক্ষমতা টের পাওয়া যাবে আরো জটিল প্রশ্ন করলে। যেমন—‘ওয়েদার ডটকম থেকে ঢাকা, বাংলাদেশের সাত দিনের পূবার্ভাসের তথ্য জেনে সেটাকে লিস্ট আকারে দেখানোর জন্য জাভাস্ক্রিপ্ট কোড’—এতটুকু লিখলেই পাওয়া যাবে পূর্ণাঙ্গ একটি কোড, যা সরাসরি চালানোও যাবে। কোডের সঙ্গে তার প্রতিটি ধাপে কিভাবে কাজ করে সেটাও তুলে ধরা থাকবে। অথবা কোনো কোড যদি বারবার এরর দেখায়, কোডটি চ্যাটজিপিটিকে কপি পেস্ট করে ভুল কোথায় জিজ্ঞাসা করলে সঠিক কোড দেখানোর পাশাপাশি ভুলও দেখিয়ে দেবে। এভাবে শুধু জাভাস্ক্রিপ্ট নয়, পাইথন, রুবি, টাইপস্ক্রিপ্ট, সিএসএস এবং কিছু ক্ষেত্রে সি প্লাসপ্লাসের মতো সফটওয়্যারের গভীরের কোডও চ্যাটজিপিটিকে দিয়ে লেখানো সম্ভব। শুধু একেবারে পরিষ্কারভাবে বুঝিয়ে দিতে হবে কোন ভাষায় কী কাজের কোড প্রয়োজন। কোড একবার লেখা হয়ে গেলে পরে সেটার কিছু পরিবর্তন করতে হলে সেটাও একে একে চ্যাটজিপিটিকে বলে দিলে মনের মতো কোড তৈরি হয়ে যাবে। তবে পূর্ণাঙ্গ প্রগ্রাম লেখার চেষ্টা করা বৃথা, দীর্ঘ কোড একে একে প্রশ্ন পাঠিয়ে লেখার চেয়ে কম সময়ে নিজেই লিখে ফেলা সম্ভব। চ্যাটজিপিটির প্রয়োজন তখনই, যখন কোনো জায়গায় ডেভেলপার আটকে গেছেন। তবে ধারণা করা হচ্ছে, ভবিষ্যতে পুরো প্রগ্রামই এমন এআই লিখে ফেলতে পারবে। এ নিয়েই সফটওয়্যার নির্মাতারা রয়েছেন দুশ্চিন্তায়। আগামী পাঁচ থেকে সাত বছর পর কম্পানিতে লো ও মিড লেভেল ডেভেলপারের প্রয়োজন না-ও থাকতে পারে।
কনটেন্ট তৈরি আর কপিরাইটিংও সম্ভব
সফটওয়্যারের পাশাপাশি কনটেন্ট ও কপিরাইটারের কাজও করতে পারে চ্যাটজিপিটি। যেমন—তাকে যদি বলা হয় ‘আরমান হোসেনের জন্য একটি কাভার লেটার লিখে দাও, তিনি পেশায় ফুল স্ট্যাক ডেভেলপমেন্ট স্পেশালিস্ট এবং আবেদন করছেন সিনিয়র সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার পদে’, তাহলে চ্যাটজিপিটি চমৎকার কাভার লেটার মুহূর্তেই লিখে দিতে সক্ষম। একইভাবে পণ্য ও সেবার বিস্তারিত বিবরণ, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের পোস্টের জন্য ক্যাপশন, কপিরাইট নোটিশ, এমনকি যেকোনো বিষয়বস্তুর ওপর পূর্ণাঙ্গ ব্লগ পোস্ট বা পোস্টের কিছু অংশ লিখতে সক্ষম চ্যাটজিপিটি। মূলত পুরো পোস্টের চেয়ে লেখা শুরু করার জন্য বিষয় নির্বাচন, ভূমিকা লেখা বা পোস্টের প্রথম ড্রাফট তৈরির জন্যই চ্যাটজিপিটিকে কাজে লাগাচ্ছেন লেখকরা।
গবেষণাই বা বাদ যাবে কেন
গবেষণায়ও চ্যাটজিপিটি কাজে লাগানো সম্ভব। যেকোনো বিষয়বস্তু সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণা নেওয়ার জন্য চ্যাটজিপিটি অত্যন্ত কাজের, তার চেয়েও বড় সুবিধা সে বিষয়ে কী কী গবেষণা করা যেতে পারে, সেটাও চ্যাটজিপিটিকে জিজ্ঞাসা করলে পাওয়া যাবে তালিকা। এরপর সম্ভাব্য গবেষণার বিষয়বস্তু নির্বাচন করে, সেটার হাইপোথেসিস কী হতে পারে সেটাও চ্যাটজিপিটি লিখে দিতে পারে। হাইপোথেসিসটি কী উপায়ে পরীক্ষা করা যায়, সেটাও চ্যাটজিপিটি বলে দিতে সক্ষম। যেমন—যদি বলা হয় অতিরিক্ত পড়াশোনার চাপের সঙ্গে অবসাদের সম্পর্ক নিয়ে কী গবেষণা করা যেতে পারে, চ্যাটজিপিটি হয়তো বলবে হাইপোথেসিস হবে ‘পরীক্ষার সময়ের বাড়তি স্ট্রেসের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মানসিক অবসাদ বৃদ্ধি পায়।’ এরপর বলবে গবেষণার তথ্য সংগ্রহের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি বিভাগ থেকে সেরা কিছু ছাত্র-ছাত্রী এবং কিছু সাধারণ ফলাফলের ছাত্র-ছাত্রীর স্যাম্পল নিয়ে, সেমিস্টার ফাইনাল পরীক্ষা চলাকালে তাদের রক্তে কর্টিসোলের মাত্রা এবং মানসিক অবস্থার তথ্য সংগ্রহ করা যেতে পারে। এরপর তাকে তথ্যগুলো কিভাবে বিশ্লেষণ করা যায়, সেটার একটি ‘আর’ সফটওয়্যারের কোড লিখে দেওয়ার জন্য জিজ্ঞাসা করলে সেটাও চ্যাটজিপিটি দিতে সক্ষম। এ ছাড়া গবেষণাপত্রের ভূমিকা এবং ভেতরের কিছু লিটারেচার রিভিউও চাইলে চ্যাটজিপিটি লিখতে পারে।
আছে বিতর্কও
এসব ছাড়াও অনেক ছাত্র আবিষ্কার করেছে তাদের অ্যাসাইনমেন্ট, বইয়ের ওপর রিপোর্ট বা বড়সড় রচনা লেখার মতো এমন অনেক ক্ষেত্রেই চ্যাটজিপিটি কাজে লাগিয়ে চিট করা সম্ভব। সেগুলো রুখে দিতে ওপেনএআই নিজেরাই তৈরি করেছে এক সেবা, যাতে শিক্ষকরা চ্যাটজিপিটি কাজে লাগিয়ে অ্যাসাইনমেন্ট করা হয়েছে কি না সেটা পরীক্ষা করতে পারেন। গবেষণাপত্রে চ্যাটজিপিটির ব্যবহার নিয়েও চলছে জোরালো বিতর্ক, তবে এখনো পর্যন্ত যেসব কাজ চ্যাটজিপিটি করতে পারে সেটা ল্যাব পার্টনারের পক্ষেও সম্ভব। তাই চ্যাটজিপিটির ব্যবহার যুক্তিযুক্ত বলেই মতামত দিচ্ছেন বেশির ভাগ বিশেষজ্ঞ।
চ্যাটজিপিটির সীমাবদ্ধতা
চ্যাটজিপিটির মূল সীমাবদ্ধতা, ২০২১ সালের পর কোনো নতুন তথ্য এতে দেওয়া হয়নি। তাই সর্বশেষ ঘটনাবলি আবিষ্কার এবং সংবাদের ওপর ভিত্তি করে কিছু করা সম্ভব নয়। সঙ্গে এর নির্মাতারা বারবার জানিয়েও দিয়েছেন, চ্যাটজিপিটি অঙ্কের জন্য একেবারেই কার্যকর নয়। কেননা এটি চট করে গাণিতিক ভুল ধরতে পারে না। তাই ব্যবহারে সতর্কতা অবলম্বন করতে বলা হয়েছে বারবার।
চ্যাটজিপিটি এখনই মানুষের পরিবর্তে ব্যবহার করা যাবে, এমন নয়। তবে প্রফেশনালরা এর সাহায্যে আরো সহজে কাজ করতে পারবেন, সেটা এর মধ্যেই পরিষ্কার।
তবে ভবিষ্যতে সব সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে আরো কার্যকর চ্যাটজিপিটি সেবা যখন চালু হলে তখন অনেক ধরনের কাজে এর সুফল পাওয়া যাবে।