গ্লুকোমাজনিত অন্ধত্বের কোনো প্রতিকার নেই, প্রতিরোধই একমাত্র উপায়। সারা বিশ্বে অন্ধত্বের একটি প্রধান কারণ হলো গ্লুকোমা। এই রোগটি উন্নত ও উন্নয়নশীল সব দেশেই প্রায় সমানভাবে বিস্তৃত। এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে এটি অন্ধত্বের অন্যতম প্রধান কারণ। বিস্তারিত জানাচ্ছেন ডা. শরমীন সোহেলী
সাধারণত চল্লিশোর্ধ্ব বয়সের নারী-পুরুষের ২ শতাংশ এ রোগে ভুগে থাকে। তবে যাঁদের মা-বাবা কিংবা আত্মীয় এই রোগে আক্রান্ত, তাঁদের ক্ষেত্রে চল্লিশের আগেও গ্লুকোমা হতে পারে।
গ্লুকোমা সম্পর্কে জানা জরুরি কেন?
আমাদের দেশে বহু লোক গ্লুকোমা রোগে ভুগে নিজের অজান্তেই সারা জীবনের জন্য অন্ধ হয়ে যায়। অথচ এটি কোনো দুরারোগ্য ব্যাধি নয়।
এ রোগেরও আছে চিকিৎসা। শতকরা ৭০ থেকে ৮০ ভাগ গ্লুকোমার ক্ষেত্রেই রোগীর পক্ষে প্রাথমিক পর্যায়ে রোগটির কোনো উপসর্গ বা লক্ষণ বোঝা সম্ভব হয় না। এ ক্ষেত্রে রোগী যখন অনুভব করেন যে তিনি চোখে কম দেখছেন বা একেবারেই দেখছেন না, তখন সাধারণত চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে যান। এ অবস্থায় চোখের যা ক্ষতি হয় তা স্থায়ীরূপে হয়ে যায়। তবে দৃষ্টি যেটুকু আছে, ততটুকুই ধরে রাখার জন্য চিকিৎসার প্রয়োজন।
রোগটির উপসর্গ বা লক্ষণ প্রাথমিক পর্যায়ে ধরা গেলে খুব সামান্য ওষুধেই রোগটিকে নিয়ন্ত্রণ করা যায় এবং প্রয়োজনবোধে কোনো কোনো ক্ষেত্রে অপারেশন করাতে হয়।
তবে অপারেশনের ফলে আগে যেটুকু ক্ষতি হয়ে হয়েছে, সেটি ভালো করা যাবে না। ভবিষ্যতে যাতে আর চোখের ক্ষতি না হয় তাতে সাহায্য করবে এই অপারেশন। অন্যদিকে চিকিৎসা শুরু করতে দেরি হলে পরিণতি হলো অন্ধত্ব।
কেন এই রোগ হয়?
এই রোগের সুনির্দিষ্ট কোনো কারণ খুঁজে পাওয়া না গেলেও অদ্যাবধি চোখের উচ্চ চাপই এ রোগের প্রধান কারণ বলে ধরে নেওয়া হয়। তবে চোখের প্রেশার স্বাভাবিক হলেও এ রোগ হতে পারে।
গ্লুকোমা দুই ধরনের হয়
ওপেন-অ্যাঙ্গেল গ্লুকোমা : এটি সবচেয়ে সাধারণ ধরনের গ্লুকোমা এবং এটিকে ওয়াইড-অ্যাঙ্গেল গ্লুকোমাও বলা হয়।
অ্যাঙ্গেল-ক্লোজার গ্লুকোমা : এটি কম সাধারণ এবং এটি অ্যাকিউট অথবা ক্রনিক অ্যাঙ্গেল ক্লোজার অথবা ন্যারো-অ্যাঙ্গেল গ্লুকোমা নামেও পরিচিত। এটি সাধারণত ছানি এবং দূরদর্শিতার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত।
লক্ষণ
এই রোগের লক্ষণ ও উপসর্গগুলো এত হালকা যে এগুলোকে দীর্ঘ সময়ের জন্য লক্ষ করা যায় না। প্রথম লক্ষণটি হলো সীমান্তবর্তী দৃষ্টি হারিয়ে ফেলা।
উপসর্গ
♦ কম নির্গত আলোর চারপাশে বর্ণবলয় দেখা।
♦ দৃষ্টিহীনতা।
♦ চোখে লালচে ভাব।
♦ একটি চোখের অস্পষ্ট দৃষ্টি (বাচ্চাদের মধ্যে)।
♦ চুলকানি ও চোখে ব্যথা।
♦ সংকীর্ণ বা ঝাপসা দৃষ্টি।
♦ মাথা ব্যথা বা বমি বমি ভাব।
প্রধান কারণগুলো
অতিরিক্ত চাপ বা প্রেসারের কারণে চোখে চাপ বৃদ্ধি হওয়াই হলো গ্লুকোমার অন্যতম কারণ। তবে আরো অনেক কারণ আছে, যেগুলো গ্লুকোমা বাড়ার ঝুঁকি বৃদ্ধি করে।
বয়স : বয়স বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে গ্লুকোমা বাড়ার আশঙ্কা থাকে।
♦ জাতিগত : আফ্রিকান, ক্যারিবিয়ান এবং এশিয়ার জনগণের মধ্যে এটি হওয়ার প্রবল ঝুঁকি আছে।
♦ পারিবারিক ইতিহাস : যদি কোনো মা-বাবা বা ভাই-বোনের এটি থাকে, তবে সেখানে গ্লুকোমা নির্ণয়ের অধিক আশঙ্কা থাকে।
♦ অন্যান্য চিকিৎসা শর্ত বা রোগ, যেমন—স্বল্পদর্শিতা, দূরদর্শিতা এবং ইউভিআইটিস রোগ
যেহেতু গ্লুকোমা ও চোখের ছানি দুটি রোগই সাধারণত চল্লিশোর্ধ্ব বয়সে হয় এবং এসব রোগী ক্রমেই চোখে কম দেখেন। তাই অনেকে গ্লুকোমা হওয়া সত্ত্বেও চোখের ছানি মনে করে চিকিৎসকের কাছে যান না। এসব রোগীর দৃষ্টিশক্তি যখন একেবারে কমে যায়, তখন ছানি পেকে গেছে ধারণা করেন। অপারেশন করালে ভালো হবেন—এ আশা নিয়ে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হন। তখন রোগীকে বরণ করে নিতে হয় নীরব অন্ধত্বকে। সুতরাং এ রোগ সম্পর্কে সচেতনতা রোগীসহ অন্য সবারই থাকা একান্ত প্রয়োজন। রোগী যতক্ষণ পর্যন্ত এ রোগের চিকিৎসার গুরুত্ব অনুধাবন করতে না পারবেন, ততক্ষণ পর্যন্ত গ্লুকোমার সাফল্যজনক নিয়ন্ত্রণ বা সুচিকিৎসা সম্ভব হবে না।
নির্ণয়
♦ নিয়মিত চোখের চেকআপ।
♦ চোখের চাপ পরিমাপ করার জন্য টনোমেট্রি নামক একটি পরীক্ষা করা হয়।
এ ছাড়া সীমান্তবর্তী দৃষ্টির হানি পরীক্ষা করতে একটি ভিজ্যুয়াল ফিল্ড টেস্ট করা হয়।
গ্লুকোমা নির্ণয় হওয়ার আগেই হারিয়ে যাওয়া দৃষ্টিশক্তিকে পুনরায় ফিরিয়ে আনা অসম্ভব, কিন্তু চিকিৎসা অবস্থাটির খারাপ হওয়া থামাতে পারে। চিকিৎসা গ্লুকোমার ধরনের ওপর নির্ভর করে।
কোনো চিকিৎসা আছে কি?
এখন পর্যন্ত গ্লুকোমা সম্পূর্ণ নিরাময়ে কোনো ট্রিটমেন্ট নেই, তবে যাতে এটির মাত্রা না বেড়ে যায় সেদিকে বিবেচনা করেই বিভিন্ন থেরাপির দ্বারা ব্যাধিকে রোধ করা যেতে পারে। প্রাথমিকভাবে চোখের ড্রপ ব্যবহার করা সব থেকে ভালো এবং এটি সারা জীবনের জন্য করে যেতে হয়। চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী অনেকেই অপারেশন করাতে পারেন, তাতে অল্প হলেও সুরাহা হয়। অনেকেই লেজার সার্জারির সাহায্য নেন, তাতে কিছুটা হলেও রেহাই পাওয়া যায়।
গ্লুকোমার প্রচলিত চিকিৎসা
♦ চোখের ড্রপ : চোখের চাপ হ্রাস করতে।
♦ লেজার চিকিৎসা : বন্ধ হয়ে যাওয়া অপটিক ড্রেনেজ টিউবগুলো খুলতে বা চোখের পানি উৎপাদন কমিয়ে আনতে।
সার্জারি : চোখের কোণে আইরিসে একটি ছোটো অংশ লেজার পেরিফেরাল আইরিডিটোমি প্রসিডিউরের মাধমে খানিকটা বড় করে চোখের ভেতরের পানি সামনের অংশ এবং পিছনের অংশে চলাচল বাড়ানো যায়।
এজাতীয় চিকিৎসার পরও চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত। যেমন—নিয়মিত স্ক্রিনিং, ছয় মাস অন্তর চোখের পরীক্ষা, অ্যান্টি অক্সিডেন্টসমৃদ্ধ খাবার খাওয়া, ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখা ইত্যাদির প্রতি মনোযোগ দেওয়া আবশ্যক।
লেখক : সিনিয়র কনসালট্যান্ট
বসুন্ধরা আই হসপিটাল অ্যান্ড রিসার্চ ইনস্টিটিউট, ঢাকা