চা শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধিজনিত সমস্যার সমাধান না হওয়ার সংবাদ উদ্বেগজনক। উল্লেখ্য, চায়ের পাতা বড় হয়ে গেলে তা দিয়ে চা উৎপাদন করা সম্ভব নয় বিধায় কুড়ি থাকতেই তুলতে হয়। অথচ শ্রমিক আন্দোলনের জেরে চা উত্তোলন সম্ভব না হওয়ায় কেবল বাগান মালিকরাই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন না; একইসঙ্গে চা রফতানিতেও নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে, যা মোটেই কাম্য নয়।
জানা গেছে, গত বুধবার রাজধানীতে এক বৈঠকে মালিকপক্ষ বর্তমান মজুরির সঙ্গে ১৪ টাকা যোগ করে মোট ১৩৪ টাকা করার প্রস্তাব দিলে সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে চা শ্রমিকরা দৈনিক ৩০০ টাকা মজুরির দাবিতে অনড় রয়েছেন। এক্ষেত্রে শ্রমিক নেতৃবৃন্দের ভাষ্য হচ্ছে, ১২০ টাকা মজুরিতে জীবনযাপন করা কষ্টসাধ্য; উপরন্তু প্রতিদিন অন্যূন ২৩ কেজি চা পাতা তুলতে না পারলে প্রাপ্য ১২০ টাকাও শ্রমিকদের দেওয়া হয় না।
শ্রমিক নেতৃবৃন্দ মনে করেন, দীর্ঘদিন ধরে চা শ্রমিকরা তাদের ন্যায্য অধিকার যেমন মজুরি, চিকিৎসা, শিক্ষা, বাসস্থানসহ বিভিন্ন দিক থেকে বঞ্চিত রয়েছেন। এ প্রেক্ষিতে তারা তাদের ন্যায়সংগত দাবিতে আন্দোলন করছেন, যা অত্যন্ত যৌক্তিক। অবশ্য এক্ষেত্রে মালিকপক্ষের দাবি হচ্ছে-চা বাগানের শ্রমিকরা বর্তমানে অনেক সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছেন। বাগান কর্তৃপক্ষই শ্রমিকদের ঘর করে দিচ্ছে। প্রতিটি বাগানে চিকিৎসক, নার্স ও মিডওয়াইফের ব্যবস্থা রয়েছে। মোটকথা, রেশন, চিকিৎসাসহ বিভিন্ন সেবা বাগান থেকে দেওয়ায় শ্রমিকদের অবস্থা এখন আগের মতো ততটা নাজুক নয়।
এতদঞ্চলে প্রথম বাণিজ্যিকভাবে চা উৎপাদন শুরু হয়েছিল ১৮৫৪ সালে, সিলেটের মালনীছড়ায়। সে সময় চা শিল্পকে বিকশিত করতে ব্রিটিশ সরকার ভারতের ওড়িশা, ঝাড়খন্ড, উত্তরপ্রদেশসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে দরিদ্র আদিবাসীদের ট্রেনযোগে সিলেট অঞ্চলে নিয়ে আসে। ভূমিসহ নানা সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে তাদের নিয়ে আসা হলেও বাস্তবে তার প্রায় কিছুই জোটেনি। দেশের ১৬২টি চা বাগানের মধ্যে ১৩৭টিই রয়েছে সিলেট বিভাগে এবং এখানে কর্মরত চা-জনগোষ্ঠীর সংখ্যা প্রায় ৭ লাখ। স্বল্পমজুরি ও সব ধরনের নাগরিক সুবিধাবঞ্চিত থাকায় জীবনমানের সব সূচকেই পিছিয়ে রয়েছেন চা শ্রমিকরা।
অভিযোগ রয়েছে, প্রতি বছর নতুন মজুরি বাস্তবায়নের কথা থাকলেও বিগত ১৯ মাসেও নতুন মজুরি নির্ধারণ হয়নি চা শ্রমিকদের। সরকার ও বাগান কর্তৃপক্ষ শুধু আশ্বাস দিয়ে এতদিন পার করেছে। বস্তুত এ অঞ্চলে চা শিল্পের শুরু থেকেই বঞ্চনার শিকার হয়ে আসছেন শ্রমিকরা। দূরদূরান্ত থেকে নিয়ে আসা শ্রমিকদের কঠোর পরিশ্রমে বুনো টিলায় চা বাগানগুলো গড়ে উঠলেও শোষণ-বঞ্চনা থেকে মুক্তি মেলেনি তাদের।
দুঃখজনক হলো, একুশ শতকের এই সময়ে এসেও চা শ্রমিকদের ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন হয়নি। তাদের ঘরবাড়ি খুবই নিম্নমানের। কারোরই ভূমির অধিকার নেই। তাদের খাটানো হয় অত্যধিক; কিন্তু মজুরি দেওয়া হয় খুবই সামান্য। অশিক্ষা, অপুষ্টি, দারিদ্র্য এসবের সঙ্গে তাদের নিত্য বসবাস। চা বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ অর্থকরী ফসল। বিগত তিন দশক ধরে চায়ের অভ্যন্তরীণ চাহিদা বেড়েছে ব্যাপকভাবে। সঠিকভাবে তদারকি করতে পারলে চা শিল্প দেশের অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে, তা বলাই বাহুল্য।
এক্ষেত্রে সরকারকেই ভাবতে হবে বেশি। অপার সম্ভাবনাময় চা শিল্পের বিকাশে যেসব প্রতিবন্ধকতা রয়েছে, তা দূর করে শিল্পটিকে যুগোপযোগী ও প্রত্যাশিত মানে উন্নীত করার পাশাপাশি শ্রমিকদের ন্যায্য অধিকার ও জীবনমানের উন্নয়ন ঘটাতে পারলে চা শিল্প উন্নতির শিখরে স্থান করে নেবে, এতে কোনো সন্দেহ নেই।