Saturday, July 27, 2024
spot_img
Homeজাতীয়চাঁদাবাজি-ডাকাতি-খুন

চাঁদাবাজি-ডাকাতি-খুন

দেশেই অরক্ষিত প্রবাসীরা

সঙ্কট নিরসনে ট্রাইব্যুনাল গঠনের দাবি
রাজ্যের ব্যাকুলতা নিয়ে শেকড়ের টানে নিজ দেশে ফেরেন প্রবাসীরা। দেশে ফিরেও তারা স্বস্তির সময় কাটাতে পারেন না। বহুবিধ পেরেশানিতে তাদের নির্ঘুম রাত যাপন করতে হয়। তদুপরি চাঁদাবাজ, চোর-ডাকাতদের টার্গেটে পরিণত হন প্রবাসীরা। অনেক সময় খুনও হন। খুন হন কখনও চাঁদাবাজ-সন্ত্রাসী দ্বারা। স্বার্থের সংঘাতে কখনওবা খুন হন পরিবারের সদস্য, স্বজনদের দ্বারা। দেশে আসা প্রবাসীদের নিরাপত্তায় ভুগলেও এ বিষয়ে প্রশাসনের যেন কোনো দায়-দায়িত্বই নেই।

তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, প্রায়শই প্রবাসীরা স্থানীয় সন্ত্রাসীদের চাঁদাবাজির শিকার হন। ২০ বছর কুয়েতে প্রবাসী জীবন শেষে দেশে ফেরেন চাঁদপুর হাজিগঞ্জ উপজেলার জয়শরা গ্রামের শাহ আলম। এসেই পড়েন লকডাউনের মুখে। গতবছর ১ সেপ্টেম্বও ১৫/২০ জনের সন্ত্রাসী বাহিনী তার বাড়িতে হানা দেয়। এ সময় শাহ আলমের স্ত্রীর কাছ থেকে তার ফোন নম্বর নিয়ে নেয়। পরে ফোনে তার কাছ থেকে ১০ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করেন বড়কূল গ্রামের দেলোয়ার হোসেন। টাকা না দিলে স্ত্রী-সন্তানকে অপহরণ করা হবে Ñমর্মে হুমকি দেন দেলোয়ার।

এর আগে বরিশাল গৌরনদী মডেল থানা এলাকার দক্ষিণ গোবর্ধ্বন গ্রামের সউদী প্রবাসী সৈয়দ চুন্নুর কাছ থেকে ২ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করেন পুলিশের সোর্স হিসেবে পরিচিত একই গ্রামের আব্দুল লতিফ বেপারি। চাঁদা দিতে অস্বীকার করায় গৌরনদী মডেল থানার তৎকালীন এসআই মো. মাজহারুল ইসলামসহ সাদা পোশাকধারী ৩ পুলিশ সদস্যকে সঙ্গে নিয়ে লতিফ বেপারি চুন্নুর বাড়িতে যান। এ ঘটনায় এসআই মাজহারুলকে ক্লোজ করা হলেও সৈয়দ চুন্নু চাঁদাবাজির কোনো প্রতিকার পাননি। বরং চুন্নুকে পথে পেয়ে তার ওপর হামলা চালানো হয়। তার কাছ থেকে নগদ ৩৫ হাজার টাকা ছিনিয়ে নেয়া হয়। এ ঘটনার সুষ্ঠু কোনো বিচার পাননি এই প্রবাসী। চাঁদাবাজির পাশাপাশি চোর-ডাকাতদের নিশানায় পরিণত হয় প্রবাসীর বাড়ি। গতবছর ২৪ জুলাই নোয়াখালি কোম্পানিগঞ্জ উপজেলার চরকাঁকড়া ইউনিয়নের ৭ নম্বর ওয়ার্ডের প্রবাসী সিরাজ ডাক্তারের বাড়িতে ডাকাতি হয়। ডাকাতরা টিনের বেড়া কেটে ঘরে ঢোকে। অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে নগদ ৮১ হাজার টাকা, স্বর্ণালঙ্কারসহ ৮ লাখ টাকার মালামাল লুটে নেয় ।

এর আগে ঝালকাঠির রাজাপুর সদরের গোরস্তান সড়কে সউদী প্রবাসী মোসলেম আলী মৃধার বাড়িতে ডাকাতি হয়। ডাকাতরা অস্ত্র ঠেকিয়ে ৭০ ভরি স্বর্ণ, ২ লাখ ৪০ হাজার টাকা এবং ২ হাজার সউদী রিয়াল লুটে নেয়। রাতে পিস্তল ও দেশীয় অস্ত্র নিয়ে ডাকাতদল মোসলেম আলী মৃধার বাসভবনের দ্বিতীয় তলার দরজা ভেঙে ভেতরে ঢোকে। পরিবারের সবাইকে অস্ত্র ঠেকিয়ে জিম্মি করে রশি দিয়ে বেঁধে ফেলে। ভবনের পাঁচটি কক্ষে ডাকাতরা চালায় লুটতরাজ। মোসলেম আলীর দুই ছেলে রাজ্জাক মৃধা ও লোকমান মৃধা ইতালি প্রবাসী।

গাজীপুর কাপাসিয়ায় চাঁদপুর গ্রামে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী সবুজ মাহমুদের বাড়ি ডাকাতি হয় গত ১৫ জুলাই। ওইদিন রাত ৮ টার দিকে ৭/৮ জনের সশস্ত্র ডাকাত দল বাড়িতে ঢোকে। অস্ত্রের মুখে পরিবারের সদস্যদের জিম্মি করে ২৫ ভরি স্বর্ণালঙ্কার, ৫০০ মার্কিন ডলার এবং নগদ ৩ লাখ টাকা নিয়ে যায়। ডাকাতদের মুখ কালো কাপড়ে বাঁধা ছিলো। প্রত্যেকের হাতে ছিলো আগ্নেয়াস্ত্র। তারা বাসায় ঢুকেই গৃহবধূ সুমি আক্তার, শাশুড়ি সাজেদা ও ভাসুর দিদার হোসেনের মাথায় পিস্তল ঠেকায়। ৯৯৯ এ ফোন দেয়ার পর কাপাসিয়া থানা পুলিশ তাদের উদ্ধার করে।

চাঁদা না দেয়ায় সন্ত্রীদের গুলিতে খুন হয়েছেন বগুড়া সদরের মহিষ বাথান গ্রামের যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী আব্দুর রাজ্জাক। পুলিশ এই ঘটনায় ওমর খৈয়াম রোপনকে গ্রেফতার করলেও হত্যা মামলার বিচার এখনও শুরু হয়নি। রোপন পেশাদার খুনি এবং শীর্ষ সন্ত্রাসী বলে জানা যায়।

প্রবাসীর চুরি-ডাকাতি কিংবা খুন-কোনোটারই ত্বরিৎ বিচার হয় না। ৯ বছর আগে খুন হন চট্টগ্রামের মধ্যপ্রাচ্য প্রবাসী কামাল উদ্দিন সিকদার। নগরীর বায়েজিদ বোস্তামি থানার আরেফিন নগরের অদূরে তারা গেইট এলাকা থেকে তার লাশ উদ্ধার করা হয়। তিনি ফটিকছড়ি উপজেলার সমিতির হাট এলাকার আরাফুর সিকদারের ছেলে। বায়েজিদ বোস্তামির কুঞ্জছায়া এলাকায় সপরিবারে থাকতেন কামাল। মায়ের চেহলামের অনুষ্ঠানে তিনি আত্মীয়-স্বজনের বাড়ি বাড়ি দাওয়াত দিচ্ছিলেন। পুলিশ জানিয়েছিলো, তাকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হয়ে থাকতে পারে। এক দশক হতে চললেও কামাল হত্যার বিচার হয়নি।

পূর্বশত্রæতার জেরে খুন করা হয় নোয়াখালি সোনাইমুড়ি মেরীপাড়া গ্রামের ওমান ফেরত মাহবুব হোসেনকে। সিআইডি’র তদন্তে বেরিয়ে আসে, করোনার সময় ওমান থেকে ফেরেন মাহবুব। তার সঙ্গে স্থানীয় বখাটে যুবক সাদ্দামের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে বিরোধ বাঁধে। সর্বশেষ একটি মোবাইল নিয়ে বাগবিতন্ডার জেরে পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী গত বছর ২৮ নভেম্বর ধন্যপুর এলাকায় মাহবুবকে কুপিয়ে হত্যা করে সন্ত্রাসী সাদ্দাম।

টাকা হিসাব চাওয়ায় মা-বাবা ও ভাই পিটিয়ে হত্যা করা হয় প্রবাসী শারফুল ঢালীকে। গতবছর ২৬ আগস্ট ময়মনসিংহের গফরগাঁও উপজেলার পাগলা থানার চাকুয়া গ্রামে ঘটে এ ঘটনা। শারফুল ৮ বছর লেবাননে ছিলেন। খুন হওয়ার ৬ মাস আগে দেশে ফেরেন। লেবাননে আয়-রোজগারের সব টাকা তার বাবা ইসহাক ঢালীর অ্যাকাউন্টে পাঠাতেন। দেশে ফিরে টাকার হিসাব চাইলে বাবা ইসহাক ঢালী অস্বীকৃতি জানান এবং টাকা ফেরত দেবেন না বলে জানান। এ নিয়ে বাবা-ছেলের মধ্যে প্রায়ই ঝগড়া হতো। ঘটনার দিন সকালে টাকা-পয়সা নিয়ে ঝগড়ার এক পর্যায়ে বাবা ইসহাক ঢালী, মা হোসেনা আরা, ছোট ভাই আশরাফুল ঢালী লোহার রড ও শাবল দিয়ে শারফুল ঢালীকে পিটিয়ে হাত-পা ভেঙে একটি রুমে তালাবদ্ধ করে রাখেন। পুলিশ উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে ইন্তেকাল করেন শারফুল।

প্রবাসীদের সঙ্গে এ রকম ঘটনা ঘটছে অহরহ। ভাগ্যান্বেষণে বিদেশ-বিভুই পাড়ি জমান বাংলাদেশিরা। কঠোর পরিশ্রমের বিনিময়ে তারা বৈদেশিক মূদ্রা পাঠান দেশে। বিনিময়ে তারা পান না ন্যূনতা নিরাপত্তা। প্রশ্ন জাগে, প্রবাসীরা তাহলে দেশ থেকে কি পাচ্ছেন ?
বেরসকারি সংস্থা ‘ব্র্যাক’র মাইগ্রেশন প্রোগ্রাম’র প্রধান শরিফুল হাসানের মতে, নিরাপত্তাতো দূরে থাক, পাশের দেশ ভারত-শ্রীলঙ্কা প্রবাসীদের যে মর্যাদা দেয়-আমরা তার কিছুই দেই না। তারা বরং নানা রকম হয়রানির শিকার হন। প্রবাসীরা বছরে ১৫ বিলিয়ন ডলার পাঠাচ্ছেন। তার বিপরীতে কোনো প্রবাসী কর্মী মারা গেলে লাশ পরিবহণ ও দাফনের জন্য সহকর্মীদের চাঁদা তুলতে হয়। আমাদের দূতাবাসগুলো খবরও রাখে না।

এ বাস্তবতায় দেশ-বিদেশে প্রবাসীদের সঙ্কট নিরসনে উচ্চকিত ‘হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পীস ফর বাংলাদেশ (এইচআরপিবি)’। সংস্থাটি দীর্ঘদিন ধরে এ বিষয়ে দেশ-বিদেশে জনমত সৃষ্টি করছে। সভা-সেমিনারের আয়োজন করছে। এরই ধারাবাহিকতায় গত ৩ জুলাই সুইডেনের স্টকহোমে এক মতবিনিময় সভার আয়োজন করে সংস্থাটির সুইডেন শাখা। কাজী মেহেরুল হুদার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত মতবিনিময় সভায় প্রধান অতিথি ছিলেন সংস্থার প্রেসিডেন্ট সুপ্রিম কোর্টের অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ। সভায় সুইডেন প্রবাসীরা বাংলাদেশ ভ্রমণকালীন নিজেদের দুর্বিষহ অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন। বাংলাদেশে অবস্থানকালে প্রবাসীরা সে সঙ্কটের নিপতিত হন তা থেকে দ্রæত পরিত্রাণে বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠনের দাবি জানান।

প্রধান অতিথির বক্তৃতায় সংস্থার প্রেসিডেন্ট অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ বলেন, লাখ লাখ প্রবাসী বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে বসবাস করছেন। তারা যখন দেশে ফেরেন তখন নানা ধরণের তিক্ত অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হন। দেশে তাদের জমি, সম্পদ অনেক সময় জবরদখল করে বা প্রতারণার মাধ্যমে দখল করে নেয়া হয়। তা উদ্ধার করতে দীর্ঘ আইনি জটিলতায় প্রবাসীদের পড়তে হয়। যেহেতু তারা স্বল্প সময়ের জন্য বাংলাদেশে আসেন সে কারণে আইনি প্রক্রিয়ায় প্রবাসীরা তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। এ কারণে তাদের মাঝে দিন দিন হতাশা বাড়ছে। এক্ষেত্রে প্রবাসীদের এ সমস্যা সমাধানে দ্রæত সময় প্রতিকার দেয়ার জন্য ট্রাইব্যুনাল গঠনের কোনো বিকল্প নেই। তিনি সরকারের কাছে প্রবাসীদের সমস্যা সমাধান ও তাদের অধিকার নিশ্চিত করার জন্য অবিলম্বে ট্রাইব্যুনাল গঠন সংক্রান্ত আইন প্রণয়নেরও আহŸান জানান।

RELATED ARTICLES
- Advertisment -
Google search engine

Most Popular

Recent Comments