Tuesday, March 28, 2023
spot_img
Homeসাহিত্যচট্টগ্রামের সমকালীন সাহিত্য পরিস্থিতি

চট্টগ্রামের সমকালীন সাহিত্য পরিস্থিতি

প্রান্তছোঁয়া আকাশ

সমকালীন সাহিত্যিক পরিস্থিতিকে শনাক্ত করা খুবই দুরূহ কাজ। প্রথমত এ অনলাইন, ফেসবুক, নানা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, ভার্চুয়াল তৎপরতার মধ্যে মানুষের চিন্তাচর্চা এমন এক রূপ পরিগ্রহ করেছে, যে কোনো একটি সূত্র বা তত্ত্ব দিয়ে তা ব্যাখ্যা করা যায় না। দ্বিতীয়ত কোনো একটি অঞ্চল বা জেলা তার প্রকৃতিগত বৈশিষ্ট্য নিয়ে এখন আর স্বতন্ত্র অবস্থানে নেই।

আকাশ সংস্কৃতির দুর্বার আগ্রাসনে আঞ্চলিক অহমিকায় চিড় ধরেছে। সমুদ্রবন্দরের কারণে চট্টগ্রামকে বলা হয় বহির্বিশ্বের একমাত্র প্রবেশদ্বার। প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে আরব বণিক, পর্তুগিজ নাবিক, ফরাসি, ইংরেজ, ডাচ প্রভৃতি জাতি গোষ্ঠীর এখানে আগমন ঘটে। অন্যদিকে আরাকান রাজ্যকে ঘিরে মধ্যযুগে বিচিত্র সাহিত্য ও সাংস্কৃতির বিকাশ লক্ষ করা যায়। পার্বত্য অঞ্চলে মগ, চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, তনচইঙ্গা, বোম ইত্যাদি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর আবাস-অধিবাস চট্টগ্রাম অঞ্চলের লোকসংস্কৃতিকে বৈচিত্র্য দান করেছে। এখানকার ভূমিপুত্রদের ভিন্ন ভিন্ন ভাষা ও ধর্ম বিশ্বাসকে কেন্দ্র করেই চট্টগ্রামের মৌখিক ও লৈখিক সাহিত্যের রত্নভান্ডার গড়ে উঠেছে।

আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদ এ অঞ্চল থেকেই সবচেয়ে বেশি পুঁথি সংগ্রহ করে লুপ্তপ্রায় মধ্যযুগের সাহিত্যের ইতিহাসকে পূর্ণতা দান করেছেন। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর মতে চর্যাগীতির কবি মীননাথ ছিলেন চট্টগ্রামের অধিবাসী। পদ্মাবতী কাব্যের ভণিতায় আলাওল তার জন্মবৃত্তান্ত বর্ণনা করলেও আরকান থেকে নির্বাসিত হয়ে তিনি দীর্ঘদিন চট্টগ্রামের হাটহাজারী অঞ্চলে বসবাস করেছিলেন। এ ছাড়া দৌলত কাজী, মুহাম্মদ কবীর, ছৈয়দ সুলতান, আসকর আলী পণ্ডিত, আলী রজা, শেখ ফজুল্লাহ, আবদুল হাকিম-যিনি লিখেছিলেন সেই অমর পঙ্ক্তি-‘যে জন বঙ্গতে জন্মে হিংসে বঙ্গবাণী/সে সব কাহার জন্মে নির্ণয় ন জানি।’

আধুনিক যুগের কবি-সাহিত্যিকদের পরিচয় পাওয়া যায় আহমদ মমতাজ রচিত আবহমান চট্টগ্রাম কবি-সাহিত্যিক ও তাদের সাহিত্যকর্ম (২০১৬) এবং চট্টল মনীষা (২০১০) গ্রন্থে। বিশেষত ১৯৪৭ ভারত ভাগের পর মাহবুব-উল আলম, ওয়াহিদুল আলম, আবুল ফজল, মূলত কথাসাহিত্যে বাঙালি মুসলমানদের জীবন ও সমাজকে নতুনভাবে রূপায়িত করেন। দিদারুল আলম, একুশের প্রথম কবিতার কবি মাহবুব-উল আলম চৌধুরী, সুচরিত চৌধুরী, বুলবুল চৌধুরী, শহীদ সাবের, ড. মুহাম্মদ এনামুল হক, ড. আহমদ শরীফ, আহমদ ছফা, আবদুল হক চৌধুরী, রশীদ আল ফারুকী উল্লেখযোগ্য। এ ছাড়া চট্টগ্রামের অধিবাসী নন, কর্মসূত্রে চট্টগ্রামে বসে উল্লেখযোগ্য সাহিত্য রচনা করেছেন শওকত ওসমান, আলউদ্দিন আল আজাদ, শাহেদ আলী, মনিরুজ্জামান, আনিসুজ্জামান, মাহবুবুল হক, ভূঁইয়া ইকবাল, কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীর প্রমুখ। সমকালীন চট্টগ্রামে কবিতা চর্চায় যারা উল্লেখযোগ্য অবদান রেখে চলছেন তাদের মধ্যে ময়ুখ চৌধুরী, বিমল গুহ, আসাদ মান্নান, স্বপন দত্ত, খুরশিদ আনোয়ার, বিশ্বজিৎ চৌধুরী, ওমর কায়সার, শেলিনা শেলী, এজাজ ইসুফী, জিল্লুর রহমান, হাফিজ রশীদ খান, আহসানুল হক, মহীবুল আজীজ, ডক্টর মোহাম্মদ আলমগীর আলম, রেজোয়ান মাহমুদ, ফাউজুল কবির, আনন্দমোহন রক্ষিত, জিন্নাহ চৌধুরী, মনিরুল মনির, আলী প্রয়াস, মোস্তাফা হায়দার, কমরুদ্দিন আহমদ, চৌধুরী শাহজাহান, সিরাজুল হক সিরাজ, মনজুর কাদের, মানজুর মুহাম্মদ, রুহুল কাদের, রুহ রুহেল, কানিজ ফাতেমা চৌধুরী। কথাসাহিত্যে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখার জন্য ইতোমধ্যে বাংলা একাডেমিক পুরস্কার লাভ করেছেন সুব্রত বড়ুয়া, বিপ্রদাস বড়ুয়া হরিশংকর জলদাস, বিশ্বজিৎ চৌধুরী, প্রবন্ধ সাহিত্যে আবুল মোমেন, শিশু সাহিত্যে সুকুমার রড়ুয়া, রাশেদ রউফ, সুজন বড়ুয়া, রহিম শাহ প্রমুখ। চট্টগ্রাম সাহিত্য একাডেমি, শৈলী প্রকাশন, অক্ষরবৃত্ত, খাড়িমাটি, বাতিঘর, চন্দ্রবিন্দু, শব্দশিল্প, আদিগন্ত ইত্যাদি প্রকাশনাকে ঘিরে ছড়া, কিশোর কবিতা, উপন্যাস, ছোটগল্প, রূপকথা, কল্পবিজ্ঞান, থ্রিলার প্রকাশনা বেশ জমজমাট হয়ে উঠছে। এক সময় চট্টগ্রামের বইঘর, বুক সোসাইটি, কারেন্ট বুক সেন্টার ঘিরে ষাট-সত্তর দশকে যে সাহিত্য আড্ডা প্রকাশনা গড়ে উঠেছিল, সেই ঐতিহ্যর উত্তরাধিকার এখন খুঁজে পাওয়া যায় না। এখলাস উদ্দিনের সম্পাদনায় ছোটদের সচিত্র পত্রিকা, বইঘরে কবি আল মাহমুদ প্রুফ রিডিংয়ের কাজ করতেন। শ্যামসুন্দর বৈষ্ণব ছিলেন কবি আল মাহমুদের ঘনিষ্ঠ বন্ধু, সুচরিত চৌধুরী ছিলেন গল্পের জাদুকর। তাদের পরে বোস ব্রাদার্স, চৌরঙ্গি, সবুজ হোটেল ঘিরে কাব্যমাতাল তরুণদের যে স্ফূরণ লক্ষ করা গিয়ে ছিল, এখন সেগুলো এখন হারিয়ে গেছে। অনেকগুলো নিয়মিত, অনিয়মিত লিটল ম্যাগাজিন প্রকাশিত হতো, তোলপাড়, রাইমস্টার, স্পার্ক জেনারেশনের ‘অসভ্য শব্দ’ লিরিক, মধ্যাহ্ন, খড়িমাটি, তৃতীয় চোখ, সম্মুজ্জ্বল সুবাতাস, কঙ্কাল, কথা-এর মধ্যে হারিয়ে গেছে অনেকগুলো, অল্প কয়েকটা মাত্র টিকে আছে। ড. সামশুল আলম সাঈদ চট্টগ্রামের মানস-সম্পদ নামে একটি গ্রন্থ প্রকাশ করেছিলেন। তাতে বৃহত্তর চট্টগ্রাম থেকে প্রকাশিত প্রায় শতাধিক পত্রিকার পরিচিতি ও লেখকদের নাম, লেখার শিরোনাম ইত্যাদি নিয়ে বিশ্লেষণ করেছেন। কথাসাহিত্যে এক সময় কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীর বেশ সরব ছিলেন। আশির দশকের দিকে নিজের উদ্যোগে কথা নামে একটা চমৎকার পত্রিকা বের করতেন। গল্প লিখেছেন, উপন্যাস লিখেছেন।

কমলকুমার মজুমদারকে নিয়ে একটা অসাধারণ কমলনামা প্রবন্ধ গ্রন্থ লিখেছেন। হরিশংকর জলদাস একটু বেশি বয়সে লেখালেখিতে এলেও খুব অল্প সময়ের মধ্যে দেশের প্রায় সব পুরস্কার পাওয়ার গৌরব অর্জন করেছেন। বিশ্বজিৎ চৌধুরী কবিতা দিয়ে লেখালেখি শুরু করলে ক্রমশ কথাসাহিত্যে নিজে বিকাশকে স্বচ্ছন্দ করে নিয়েছেন। দেবাশীষ ভট্টাচার্য, প্রলয়দেব, আহমেদ মাওলা, মঈনুল হোসেন, জাহেদ মোতালেব, আহমেদ মুনীর, খোকন কায়সার, ফলুল কাবেরী, মাহমুদ নোমান প্রমুখ উত্তর উপনিবেশিক চিন্তাচেতনা নিয়ে ভিন্ন ধারার গল্প লিখছেন। ওমর কায়সার কবিতা গল্পে সমান পারদর্শী। মহীবুল আজিজ প্রথমদিকে কবিতায় বেশি সময় দিলেও উত্তরকালে কথাসাহিত্যে প্রত্যাবর্তন করেন। ইলিয়াছ বাবর, মোস্তফা হায়দার কবিতা ও প্রবন্ধ লেখায় তৎপর থাকতে দেখা যাচ্ছে। প্রবন্ধ-গবেষণা সাহিত্যে ড. মাহবুবুল হক, আহমেদ মাওলা, ড. ইলু ইলিয়াছ, ড. শ্যমলকান্তি দত্ত, চৌধুরী শাহজাহান, তৌফিকুল ইসলাম চৌধুরী ড. আনোয়ারা আলম, শামসুল আরেফীন, জামাল উদ্দিন তৎপর রয়েছেন। ড. মাহবুবুল হক প্রবন্ধ-গবেষণায় বাংলা একাডেমি পুরস্কার লাভ করেছেন।

অভিক ওসমান নাটক এবং প্রবন্ধ রচনা করে চলছেন। শিশু সাহিত্যে বাংলা একাডেমি পুরস্কারপ্রাপ্ত রাশেদ রউফকে ঘিরে চট্টগ্রাম একাডেমি একঝাঁক ছাড়াকার, কিশোর কবিতা, ছোটদের উপযোগী গল্প-উপন্যাস, রূপকথা, কল্পবিজ্ঞান লেখায় তৎপর রয়েছেন। এ ক্ষেত্রে রাশেদ রউফ, সুজন বড়ুয়া, সনজীব বড়ুয়া, জসিম মেহবুব, অরুণ শীল, উৎপলকান্তি বড়ুয়া, বিপুল বড়ুয়া, এমরান চৌধুরী, সৈয়দ খালেদুল আনোয়ার, এয়াকুব সৈয়দ, আজিজ রাহমান, আলী আসগর, আনোয়ারুল হক নূরী, বিচিত্র সেন, আবুল কালাম বেলাল, শিবুকান্তি দাস, শামীম ফাতেমা মুন্নি, কাজী রুনু বিলকিস, ইফতেখার মারুফ, কাঞ্চনা চক্রবর্তী, কেশব জিপসী, গোফরান উদ্দিন টিটু, দীপালি ভট্টাচার্য, পিংকু দাশ, বাসুদেব খাস্তগীর, বিভা ইন্দু, সৌরভ শাখাওয়াত প্রমুখ শিশুসাহিত্য রচনায় বেশ তৎপর রয়েছেন। চট্টগ্রামের এ মুহূর্তে সাহিত্য-তৎপরতায় সবচেয়ে সক্রিয় রয়েছেন এ গোষ্ঠী। চট্টগ্রাম শহর থেকে সত্তর-আশির দশকে অনেকগুলো আড্ডা ছিল, অনেকগুলো সাহিত্য পত্রিকা ছিল, নব্বই দশকে এ ধারা ক্ষীণ হতে হতে একবিংশ শতকের প্রথম দুই প্রায় নাই হয়ে গেছে। এখনকার তরুণরা আর নিজের অন্তরাত্মা দিয়ে লিটল ম্যাগাজিন প্রকাশ বা সাহিত্য আড্ডায় বসে তর্কে তর্কে লাফিয়ে ওঠা চমৎকার সময়কে যাপন করে না। ফেসবুকের বোকা বাক্সে নতমুখী জীবন বেছে নিয়েছে। কারেন্ট বুক সেন্টার, জলসা ভবনের নিচে। সেই সেরা সৃজনশীল বই বিপণি। ১৯৬৭ সালে প্রকিষ্ঠিত সেই দোকান হাইরাইজ বিল্ডিংয়ে চাপা পড়েছে। কারেন্টের পাশেই ছিল শুকতারা রেস্তোরাঁ। শুকতারার মতোই আলো ছড়াত। নিউমার্কেটের নিউজ ফ্রন্ট, উজালা বুক স্টল, দোতলায় ঐতিহ্যবাহী বইঘর, গুলিস্তান, বুক অরবিট, বুকম্যান, মনীষা হারিয়ে গেছে। এখন সেখানে বাহারি কাপড় আর জুয়েলারি দোকান। আন্দরকিল্লার তাজ লাইব্রেরি, মসজিদ মার্কেটে প্রায় অন্ধকারে সারি সারি বইয়ের দোকান, ডিরোজিও, অপরাজিতা ডিসিহিলের বৃক্ষছায়ায় ঘেরা এ অনিন্দ্য সুন্দর জায়গাটিও এখন কেমন হয়ে গেছে। পুরোনো রেলস্টেশনে রেলওয়ে বুক হাউজ, যেখান থেকে প্রতি সাপ্তাহে আমরা ইন্ডিয়ান দেশ পত্রিকা, শারদীয় সংখ্যাগুলো কিনতাম। নতুন স্টেশনে নামমাত্র দুটি দোকান আছে, সেখানে আগের সেই বইপত্র পাওয়া যায় না। জিইসি মোড়ে এক সময় কে ওয়াল্ড নামের বই দোকান ছিল, এখন নেই। নূপুর সিনেমার দোতলায় অমর বইঘর থেকে অনেক দুর্লভ বই সংগ্রহ করেছি।

সম্প্রতি ফেসবুকে ড. মেহেদী হাসান এবং হাটহাজারী সরকারি কলেজের অধ্যাপক আ ম. ম. মামুন নিজের স্মৃতিচারণায় সেই উজ্জ্বল দিনগুলোর কথা উল্লেখ করেছেন। মামুন ভাইয়ের উল্লিখিত, আধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক, আহমদ ছফার এক প্রশ্নের জবাবে বলেছেন, ‘পৃথিবীর যে দেশে যাইবেন, প্রথমে যাইবেন কাঁচা বাজারে। তাইলে জানতে পারবেন সে জাতি কী খায়। দেশের অর্থনীতি কেমন। তারপর যাইবেন লাইব্রেরিতে। তাইলে জানতে পারবেন সেই জাতি কোন ধরনের বই পড়ে। সে জাতির মননের চিন্তার জগৎ কেমন।’এখন চট্টগ্রামে বইঘর বলতে জামালখান প্রেস ক্লাবের বাতিঘর। আর সব মরে গেছে। অথচ রাস্তার মোড়ে মোড়ে গড়ে উঠেছে শপিংমল, জৌলুশময় খাবারের দোকান। আন্দরকিল্লা সব নোট-গাইড বইয়ের দোকান ছেয়ে গেছে। তাহলে দেখা যাচ্ছে, সমকালীন চট্টগ্রামে সৃজনশীল সাহিত্যচিন্তা, বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার দারিদ্র্য আর দুর্দশাই প্রলম্বিত হচ্ছে। শিক্ষার সঙ্গে সংস্কৃতির বিচ্ছেদ ঘটে গেছে। দেশে উন্নয়ন হয়েছে কিন্তু সমাজের উন্নয়ন কী হয়েছে? বলার অপেক্ষা রাখে না যে, একটি মাত্র প্রবন্ধে পুরো জেলার সাহিত্যের সামগ্রিক চিত্র-চারিত্র্য-প্রবণতা শনাক্ত করা সম্ভব নয়। এখানে অনেক লেখকের নাম হয়তো বাদ পড়ে গেছে, নিজের সীমাবদ্ধতার জন্য সবার কাছে ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টি কামনা করছি।

RELATED ARTICLES
- Advertisment -
Google search engine

Most Popular

Recent Comments