আবু আফজাল সালেহ
বাংলা নববর্ষে বাঙালির অসাম্প্রদায়িক দিকটা ফুটে ওঠে। বাংলাদেশ, ভারত ও প্রবাসী বাঙালির মধ্যে প্রাণ-সঞ্চারিত হয়। বেশ কিছু নতুন বিষয় সংযুক্ত হয় পয়লা বৈশাখকে ঘিরে। বাঙালির এই উৎসব অসাধারণ বৈশিষ্ট্যময়। বাংলা নববর্ষের এ ঐতিহ্য মাটি ও মানুষের সঙ্গে সরাসরি জড়িত; এখানে কোনো জাতিভেদ ও ধর্মভেদ নেই। ঢাকা ও কলকাতার পাশাপাশি প্রবাস ও শহর-গ্রামে তরুণ-তরুণী, যুবক-যুবতীসহ আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা উৎসবে মেতে ওঠেন। রবীন্দ্রনাথের গানটি গেয়ে ওঠেন, ‘এসো হে বৈশাখ এসো এসো/তাপস নিঃশ্বাস বায়ে, মুমূর্ষুরে দাও উড়ায়ে/বৎসরের আবর্জনা/দূর হয়ে যাক যাক যাক’।
সাহিত্যেও প্রভাব আছে বৈশাখের রুদ্ররূপ ও বিভিন্ন উৎসব নিয়ে। রবীন্দ্রনাথ-নজরুল থেকে হালের কবি-সাহিত্যিকগণ বৈশাখ নিয়ে গান-কবিতা-সাহিত্য রচনা করেছেন। অনেকে কবিতা লিখেছেন; সাহিত্য রচনা করেছেন। কিছু কবিতাংশ/গানের কথা তুলে ধরার চেষ্টা করছি—
১. ‘এসো হে বৈশাখ এসো এসো/তাপস নিঃশ্বাস বায়ে, মুমূর্ষুরে দাও উড়ায়ে,/বৎসরের আবর্জনা/দূর হয়ে যাক যাক যাক’।—রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
২. ‘প্রলয়োল্লাস’ কবিতায় নজরুল বলেছেন, ধ্বংস আর যুদ্ধ থেকেই নতুনের সৃষ্টি হয়! তেমনই বাংলা নববর্ষের কালবৈশাখী ঝড় বা রুদ্র রূপ থেকেই অনুপ্রেরণা পায় বাঙালি। ‘ধ্বংস দেখে ভয় কেন তোর? প্রলয় নূতন সৃজন-বেদন!/আসছে নবীন জীবন-হারা অসুন্দরে করতে ছেদন।/তাই সে এমন কেশে বেশে/প্রলয় বয়েও আসছে হেসে/মধুর হেসে।/ভেঙ্গেও আবার গড়তে জানে সে চির-সুন্দর।/তোরা সব জয়ধ্বনি কর!/তোরা সব জয়ধ্বনি কর!/এ ভাঙ্গা-গড়া খেলা যে তার কিসের তবে ডর?/তোরা সব জয়ধ্বনি কর।’
৩. আমাদের অস্তিত্ব ‘স্বাধীনতা অর্জন’। আর নয় মাসের যুদ্ধের মাধ্যমে আমরা বিজয় ছিনিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছি। এতে রক্ত ও ত্যাগ-তিতীক্ষা বিসর্জন দিতে হয়েছে। স্বাধীনতার প্রথম মাসেই এসেছিল পয়লা বৈশাখ-বাংলা নববর্ষ। কবি সমুদ্র গুপ্তের ‘বৈশাখ: একাত্তরে’ কবিতায় স্মৃতিচরণ পাই; মুক্তিযুদ্ধের আবেগ ও ব্যঞ্জনা, যুদ্ধাবস্থার কথা পাই—‘যুদ্ধের প্রথম মাসে এসেছিল পয়লা বৈশাখ/মেঘের ডম্বরু ফেলে হাতে হাতে উঠেছিল/স্বাধীনতাযুদ্ধের বজ্রনিনাদ/যুদ্ধমুখী পা আর স্বাধীনতা দেখে-ফেলা চোখ/আমাদের জেগে ওঠার প্রথম সাক্ষী ছিল বৈশাখী মেঘ…/মেঘ ছিল কি না যুদ্ধে পড়া বাঙালি সঠিক জানে না/কেননা, সেই একাত্তরে বৈশাখ ছিল কেমন অচেনা/কোথাও কোনো গ্রাম জনপদে আগুনের ধোঁয়া দেখে/মেঘ বলে ভ্রম হতো/মেঘ দেখলে বাড়ি পোড়ার গন্ধ লাগতো নাকে।’
৪. বর্তমানের কবি সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলাল ও অশোক কর। দু’জনেরই ‘বৈশাখ’ নামীয় কবিতার কিছু অংশ তুলে ধরি। এখানে বৈশাখ ও নববর্ষের চাহিদা, আশা ও রূপতত্ত্ব খুঁজে পেতে সাহায্য করবে—
ক. ‘বায়োস্কোপে আজ—বৈশাখী সুখ, রঙিন ঘুড়ি নাই,/বাহারী সাজ, নৌকা বাইচের কোনো জুড়ি নাই!/শৈশব, আমার পাই না খুঁজে। হারিয়ে গেলো—/কই সব? মধুর দিনগুলো মন নাড়িয়ে দিলো/বাজনা গানে বাজতে থাকে টাক ডুমা ডুম ঢোল!/সাজনা ফুলের বড়া এবং মায়ের হাতের ঝোল—/দই, শাক থেকে শুরু করে আম কুড়ানো দিন/বৈশাখ আমার প্রাণের ভেতর ভালোবাসার ঋণ!’ (বৈশাখ: সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলাল)
খ. ‘কালবৈশাখী কালো রঙে আকাশ ঢাকলে/অবসম্ভাবী পরিবর্তনের ডাক শুনতে পাই/মঙ্গল শোভাযাত্রা চলুক হালখাতা জুড়ে/ঈশান কোনে উড়িয়ে দিই সৌহার্দের রঙ/লাঙ্গলের ফলায় নাচে তাই ফসলের সাধ/অনায়াসে চাঁদেরে নামাই নাম ধরে ডেকে/এই পারে ধানক্ষেত, ওই পারে স্বপ্ন ছড়াই!’ (বৈশাখ: অশোক কর)
৫. ‘বছর ঘুরে এলো আরেক প্রভাতী/ফিরে এলো সুরের মঞ্জুরী/পলাশ শিমুল গাছে লেগেছে আগুন/এ বুঝি বৈশাখ এলেই শুনি/মেলায় যাইরে… মেলায় যাইরে… মেলায় যাইরে… মেলায় যাইরে…’ মাকসুদুল হকের লেখা ও সুরে তারই গাওয়া গানটি কিন্তু অনেক জনপ্রিয়।
৬. আবদুল মান্নান সৈয়দের ‘পয়লা বৈশাখ ১৩৭৯’ কবিতা থেকে কয়েক ছত্র—‘আমার মনের মধ্যেও/নীল-কালো-সাদা-সোনালি-পাটল চলছে অনেক রঙের খেলা/আমাকেও রূপে চলেছে তার কাপড় মিশিয়ে।’
৭. অনিল মুখার্জির ‘পহেলা বৈশাখ’ কবিতা থেকে কয়েকটি লাইন তুলে ধরছি—‘ঝড় তাকে দিবে উন্মাদনা, দিবে নব জীবনের আস্বাদ পহেলা বৈশাখ/বিপ্লবের বিঘোষক/তাই তো উৎসব/আর্তের উল্লাস…’।
৮. কৃষিক্ষেত্রে বৈশাখ মাসের গুরুত্ব অনেক। বৃক্ষের ক্ষেত্রেও নব উদ্যমে নতুন জীবন শুরু হয়—নতুন পাতা গজিয়ে। একটি খনার বচন বলতেই পারি, ‘মাঘে মুখী, ফালগুনে চুখি, চৈতে লতা, বৈশাখে পাতা’। আরও কয়েকটি খনার কথা উল্লেখ করা যায়—
১. বৈশাখের প্রথম জলে, আশুধান দ্বিগুণ ফলে
২. পৌষের কুয়া বৈশাখের ফল। য’দ্দিন কুয়া ত’দ্দিন জল।
শনিতে সাত মঙ্গলে/(বুধ) তিন। আর সব দিন দিন।
বৈশাখী মেলায় সম্প্রদায় নির্বিশেষে মানুষের আনাগোনা। মৈত্রী-সম্প্রীতির এক উদার মিলনক্ষেত্র। নারী-পুরুষ, শিশু-কিশোর সবাই আসে মেলায়। এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে বিকিকিনির আশা আর বিনোদনের টান। বৈশাখের সংস্কৃতি আমাদের জীবন-সাহিত্য ও বাঙালি জীবনে জড়িয়ে পড়ে ওতপ্রোতভাবে। নৃ-তাত্ত্বিক, সামাজিক অনন্য বৈশিষ্ট্য মিলে নববর্ষ উৎসব এখন বাঙালির এক প্রাণের উৎসব—প্রাণবন্ত এক মিলনমেলা। নববর্ষ আদিম মানবগোষ্ঠীর কাছে ছিল সিজন্যাল ফেস্টিভ্যাল। নববর্ষ হিসেবে ‘পয়লা বৈশাখ’ সভ্য মানুষের ‘এগ্রিকালচারাল ফেস্টিভ্যাল’। বাংলা নববর্ষ এ দেশের একটা প্রাচীনতম ঐতিহ্য। পয়লা বৈশাখের উৎসবের মধ্য দিয়ে এ দেশের মানুষ এই ঐতিহ্যকে বাঁচিয়ে রেখেছে। পয়লা বৈশাখের উৎসব শুরুর দিকে ছিল মূলত গ্রামাঞ্চলকেন্দ্রিক। গ্রামীণ-মেলা, লোকজ খেলাধুলা ও নৃত্য-সংগীত ছিল প্রধান আকর্ষণ। দিনে-দিনে তা শহরাঞ্চলেও ছড়িয়ে পড়ে। বাঙালিরা ‘হালখাতা’ নামে ব্যবসা-বাণিজ্যে নতুন করে হিসাব শুরু করে থাকেন। বাংলা নববর্ষে কলকাতা বা বাংলাদেশে ছাড় বা বাট্টা দেওয়ার সংস্কৃতি রয়েছে। কলকাতাতে ‘চৈত্র সেল’ নামে পরিচিত।
মুঘল সম্রাট আকবর (১৫৫৬-১৬০৫) বাংলা সনের প্রবর্তন করেন। সম্রাট আকবর সিংহাসন আরোহনের সময় (৯৬৩ হিজরি) ‘ফসলি সন’ নামে যে সন প্রবর্তন করেন, যা কালক্রমে ‘বাংলা সন’ নামে পরিচিতি লাভ করে। তখন হিজরি সনের ভিত্তিতে এ দেশে বছর গণনা হতো। হিজরি বছর সৌর বছর থেকে ১১ দিন ছোট হওয়ায় কৃষির হিসাব-নিকাশ এলোমেলো হয়ে যেত। এতে কৃষকদের ‘ফসলি সন’ গণনায় সমস্যা তৈরি হয়। ফলে কৃষকের কাছ থেকে জমিদারের খাজনা আদায় করতেও সমস্যা দেখা দেয়। জমিদার ও কৃষকদের সুবিধার্থেও এই সমস্যা দূর করতে মূলত বাংলা সনের প্রবর্তন করা হয়। বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গ কৃষিপ্রধান দেশ। তাই বাংলা নববর্ষের উৎসবের আমেজটা কৃষকের একটু বেশিই থাকে।
১৯৮৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলার শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের উদ্যোগে পয়লা বৈশাখে মঙ্গল শোভাযাত্রার আয়োজন শুরু হয়। ১৯৮৯ সালে প্রথম আনন্দ শোভাযাত্রায় ছিল পাপেট, ঘোড়া, হাতি। ১৯৯০ সালের আনন্দ শোভাযাত্রায়ও নানা ধরনের শিল্পকর্মের প্রতিকৃতি স্থান পায়। ১৯৯১ সালে চারুকলার শোভাযাত্রা জনপ্রিয়তায় নতুন মাত্রা লাভ করে। ২০১৬ সালের ৩০ নভেম্বর ইউনেস্কো কর্তৃক ‘বিশ্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য’ হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে এ সার্বজনীন শোভাযাত্রা। ধর্ম, বর্ণ, জাতি, লিঙ্গ পরিচয় নির্বিশেষে সব পেশার, সব শ্রেণির মানুষ শামিল হন মঙ্গল শোভাযাত্রায়। পয়লা বৈশাখ উদযাপনে অংশ নিতে আসা নারীদের মাথায় শোভা পায় ফুল, মুখে মুখে আলপনা, তরুণদের হাতে পতাকাসহ বিভিন্ন আয়োজন আমাদের কষ্ট-দুঃখ ভুলিয়ে দেয়।
লেখক: কবি ও প্রাবন্ধিক।