Friday, July 26, 2024
spot_img
Homeবিজ্ঞান ও প্রযুক্তিগণহত্যার ডিজিটাল মানচিত্র

গণহত্যার ডিজিটাল মানচিত্র

গণহত্যার ডিজিটাল ম্যাপ

খুলনায় অবস্থিত গণহত্যা-নির্যাতন আর্কাইভ ও জাদুঘরের ওয়েবসাইটটির ঠিকানা www.genocidemuseum.org.bd। গণহত্যার ইন্টার‌্যাক্টিভ মানচিত্রটি এই ওয়েবসাইটেরই অংশ। বাংলাদেশের ম্যাপের মধ্যে প্রতিটি আবিষ্কৃত গণকবর, গণহত্যার কেন্দ্র, স্মৃতিস্তম্ভ ও টর্চার সেল পিন দিয়ে চিহ্নিত করা আছে। সাধারণত কাগজে ছাপা সংখ্যা দেখে বোঝা সম্ভব হয় না পাকিস্তানি বাহিনীর চালানো বর্বরোচিত অত্যাচারের পরিব্যাপ্তি আসলে কত, ম্যাপের মধ্যে থাকা অগণিত পিন দেখে সেটির ভয়াবহতা আন্দাজ করা যায়।

জেলা ও কেন্দ্র নির্বাচন করে সার্চ করারও অপশন রাখা হয়েছে। ম্যাপের পাশেই আছে প্রতিটি কেন্দ্রের ছবি ও তথ্যের লিংক, যাতে সহজেই বিস্তারিত জানা যায়। দ্রুত মুক্তিযুদ্ধের সময় ঘটে যাওয়া গণহত্যার কেন্দ্রগুলোর অবস্থান ও তার কিছু তথ্য জানার জন্য ম্যাপটি ডিজাইন করা হয়েছে। সর্বমোট ২০ হাজার ৬৯১টি কেন্দ্রের অবস্থান ও তথ্য এর মধ্যেই যুক্ত করা হয়েছে, নতুন সব কেন্দ্র আবিষ্কার হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সেটি দ্রুত আপডেট করার কাজও চলমান থাকবে।
এর মধ্যে আছে ১৭ হাজার ৪৫৪টি গণহত্যা, ৮৫৫টি বধ্যভূমি, এক হাজার ২৬৪টি গণকবর এবং এক হাজার ১১৮টি নির্যাতনকেন্দ্র। ম্যাপের ভেতর যেকোনো পিনের ওপর ক্লিক করার সঙ্গে সঙ্গে একটি বক্স ওপেন হয় এবং স্পটের ছবি ফুটে ওঠে। ছবিটিতে ক্লিক করলে নতুন ট্যাব ওপেন হয় এবং সেই স্থানে ঘটে যাওয়া গণহত্যা বা নির্যাতনের ঘটনার বিস্তারিত তথ্য ডিসপ্লে করে। 

যেভাবে শুরু হয়েছিল

ইতিহাসবিদ অধ্যাপক মুনতাসীর মামুনের উদ্যোগে, ২০১৪ সালের ১৭ মে খুলনায় ‘বাংলাদেশ ইতিহাস সম্মিলনী’ প্রতিষ্ঠা করে ১৯৭১ গণহত্যা-নির্যাতন আর্কাইভ ও জাদুঘর।

পুরো দক্ষিণ এশিয়ার একমাত্র গণহত্যা জাদুঘর এটি। ওয়েবসাইটটিতে গণহত্যার ম্যাপের পাশাপাশি জাদুঘরে থাকা নানা প্রদর্শনী ও আর্কাইভের তথ্যও তুলে ধরা হয়েছে। গণহত্যার সঙ্গে পরিচিত করিয়ে দেওয়া, মুক্তিযুদ্ধের সময় ঠিক কী ঘটেছিল তার সংক্ষিপ্ত ইতিহাস নিয়েও বেশ কিছু পেজ সাইটটিতে সাজানো রয়েছে। ফলে যারা একেবারে গোড়া থেকে বিষয়টি বুঝতে চাইছে, তারা সহজেই সেটা বুঝতে পারে। প্রদর্শনী পৃষ্ঠায় আছে জাদুঘরের নানা নিদর্শনের ছবি ও বর্ণনা।
আগামী দিনে ভার্চুয়াল ট্যুরও যুক্ত করা হবে, সে বিষয়ে কাজ চলছে। 

গণহত্যার তথ্যের ভাণ্ডার

তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ বলা যেতে পারে এটির আর্কাইভ অংশটি। এখানে একে একে যোগ করা হচ্ছে ১৯৭১ সালের গণহত্যার সাক্ষীদের সাক্ষাৎকার, সে সময়ের খবরের কাগজে প্রকাশিত সংবাদের কাটিং, ১৯৭১ সালের যুদ্ধের নানা ছবির গ্যালারি। এ ছাড়া জাদুঘরের কার্যক্রম সম্পর্কেও বিস্তারিত তথ্য দেওয়া আছে এখানে এবং গণহত্যার বিষয়ে যারা গবেষণা করতে আগ্রহী তাদের জন্য আছে ফেলোশিপসংক্রান্ত তথ্যের ভাণ্ডার। ই-লাইব্রেরি অংশে গণহত্যার ওপর করা গবেষণাগুলোর ওপর লেখা বই পড়া যাবে সরাসরি ওয়েবসাইটে বসেই। গণহত্যার ওপর প্রকাশিত নানা জার্নাল পেপারও ওয়েবসাইটের আর্কাইভে রাখা আছে।

যারা এ বিষয় আরো জানতে ইচ্ছুক বা গবেষণা চালিয়ে যাওয়ার জন্য রেফারেন্স খুঁজছে, তাদের জন্য সাইটটিতে রাখা হয়েছে বেশ কিছু বই এবং আর্কাইভে থাকা ছবির প্রিন্ট। সেগুলো চাইলে সরাসরি ওয়েবসাইট থেকেই অর্ডার করা যাবে। এ ছাড়া প্রতিনিয়ত নতুন সব গবেষণালব্ধ তথ্য জানতে চাইলে জাদুঘরটির নিউজলেটার সেবা রয়েছে, সেটায় সাবস্ক্রাইব করা যাবে।

 

প্রয়োজন গবেষণা ও অধ্যয়ন

বাংলাদেশের গণহত্যা নিয়ে দেশি-বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর আগ্রহ বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিভিন্ন পর্যায়ে গবেষণা শুরু হলেও পর্যাপ্ত তথ্যের অভাবে এই আগ্রহ ধরে রাখা সম্ভব হচ্ছে না। বর্তমানে বিশ্বের ৯টি বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যসূচিতে ১৯৭১ সালের গণহত্যা অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে এবং একাধিক বিদেশি গবেষক এই বিষয়ে গবেষণা করছেন।

দেশে ২০১০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মুক্তিযুদ্ধ ও গণহত্যা নিয়ে গবেষণার জন্য ‘সেন্টার ফর জেনোসাইড স্টাডিজ’ নামের একটি অনুষদ স্থাপন করা হয়। নোয়াখালীর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়া দেশের আর কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গণহত্যা বিষয়টি পড়ানো হয় না। তবে ২০১৪ সালে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে ‘সেন্টার ফর স্টাডি অন জেনোসাইড অ্যান্ড জাস্টিস কোর্স’ এবং ২০১৭ সালে গণহত্যা জাদুঘরের উদ্যোগে ‘গণহত্যা-নির্যাতন ও মুক্তিযুদ্ধ ১৯৭১’ পোস্ট-গ্র্যাজুয়েট ট্রেনিং (পিজিটি) কোর্স চালু করা হয়েছে। গণহত্যা জাদুঘরের উদ্যোগে ১২টি ব্যাচে প্রায় এক হাজার জনকে প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়েছে। এ ছাড়া গণহত্যা জাদুঘরের উদ্যোগে মুক্তিযুদ্ধ ফেলোশিপ চালু করা হয়েছে। বাংলাদেশের গণহত্যা নিয়ে গবেষণার ক্ষেত্রে অনেক সম্ভাবনা থাকলেও পর্যাপ্ত তথ্য ও সরকারি উদ্যোগের অভাব এই গবেষণাকাজকে ব্যাহত করছে।

জাদুঘর, জরিপ, গবেষণা ও ম্যাপ তৈরির পুরো কাজটিই চলছে অলাভজনক প্রতিষ্ঠান হিসেবে। তাদের কার্যক্রম সম্পর্কে জানার জন্য এবং তাদের বিস্তারিত কাজের বিবরণ দেখার জন্য ওয়েবসাইটটিতে প্রচুর তথ্য দেওয়া আছে। যারা সব কিছু দেখার ও জানার পর তাদের কার্যক্রমে অর্থ সাহায্য দিতে আগ্রহী, ওয়েবসাইটটিতে তাদের জন্য আছে ডোনেশন করার ব্যবস্থাও। মাত্র ১০০ টাকা থেকে শুরু করে ১০ হাজার টাকা বা ইচ্ছামতো পরিমাণ ডোনেশন করা যাবে মোবাইল ওয়ালেট বা অনলাইন পেমেন্ট ব্যবস্থা ব্যবহার করে। বেসরকারি মাধ্যম ছাড়াও সরকারের শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয় এগিয়ে আসতে পারে এই ধরনের কাজকে সাহায্য করার জন্য।

মুক্তিযুদ্ধের সময়ের গণহত্যার ইতিহাস ডিজিটাল করার প্রয়াসের বড় একটি ধাপ এই ম্যাপ। আগামী দিনে বিষয়টির ওপর প্রাপ্ত নতুন সব তথ্য কাজে লাগিয়ে তথ্যভাণ্ডারের পরিধি আরো বাড়ানো হবে, যাতে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম সহজেই বাংলাদেশের ইতিহাসের এই রক্তাক্ত অধ্যায় সম্পর্কে জানতে পারে।

 

https://cdn.kalerkantho.com/public/news_images/share/photo/shares/1.Print/2024/03.March/31-03-2024/2/kalerkantho-tw-1a.jpg‘আমাদের জরিপটি সম্পূর্ণ এক কাজ’

দক্ষিণ এশিয়ার একমাত্র গণহত্যা জাদুঘর  ‘১৯৭১ : গণহত্যা-নির্যাতন আর্কাইভ ও জাদুঘর’-এর জাদুঘর ট্রাস্টের সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন ইতিহাসবিদ অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন। তিনি বলেন, আমাদের জরিপটি সম্পূর্ণ এক কাজ। এর আগে দেশজুড়ে কখনো এ রকম জরিপ হয়নি। তৃণমূল স্তরে গিয়ে এই কাজ করা হয়েছে। ফলে প্রকৃত চিত্র বের হয়ে এসেছে। এই জরিপ প্রমাণ করবে যে আমরা মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে কত কম জানি। এটি আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে একটি নতুন সংযোজন বলে আমি মনে করি। আর এই জরিপ করে আমাদের মনে হয়েছে, জরিপ অনুযায়ী জিপিএসসহ গণহত্যার জায়গাগুলো চিহ্নিত করা উচিত। আর আমরা সেই কাজটিই করার চেষ্টা করছি।

আমরা গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির কথা বলি, এই জরিপের ফলে সেই পথ সুগম হলো। আরো ২২ জেলা বাকি আছে। ওই জেলাগুলোর ফল বের হলে এই সংখ্যা তো আরো বাড়বে।

RELATED ARTICLES
- Advertisment -
Google search engine

Most Popular

Recent Comments