Saturday, April 1, 2023
spot_img
Homeবিনোদনকেন মৃত্যুর আগ পর্যন্ত পরিচয় লুকিয়ে রেখেছিলেন এই অভিনেত্রী?

কেন মৃত্যুর আগ পর্যন্ত পরিচয় লুকিয়ে রেখেছিলেন এই অভিনেত্রী?

সাদাকালো যুগের এক হলিউড তারকা মার্লে ওবেরন। ভারতে তার জন্ম। অথচ নিজ জন্মভূমিতেই বিস্মৃত এক আইকন তিনি।

ক্লাসিক চলচ্চিত্র ওয়াদারিং হাইটসের প্রধান চরিত্রে কাজ করে খ্যাতি পেয়েছিলেন তিনি। ওবেরন একজন অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান। জন্ম ১৯১১ সালে বম্বেতে, শহরটি এখন মুম্বাই নামে পরিচিত।

কিন্তু হলিউডের সোনালী দিনের এই তারকা নিজের আসল জন্ম-পরিচয় সবসময় গোপন রেখেছেন।

বরং জীবনভর নিজেকে একজন শ্বেতাঙ্গ হিসেবেই পরিচয় দিয়ে গেছেন তিনি।

আমেরিকাভিত্তিক লেখক-গবেষক মায়ুখ সেন ২০০৯ সালে প্রথমবারের মতো তার আসল পরিচয় বের করেন।

তিনি সেসময় এও জানতে পারেন, মার্লে ওবেরন অস্কারের মনোনয়ন পাওয়া দক্ষিণ এশিয়ায় জন্ম নেয়া প্রথম চিত্রতারকা।

মায়ুখ সেন যতই ওবেরনের সিনেমা দেখেছেন, যতই তার অতীত ঘেঁটেছেন, ততই তার আগ্রহ বেড়েছে।

‘একজন কুইয়ার ব্যক্তি হিসেবে, আমি ভালভাবেই বুঝতে পারি এই প্রতিকূল সমাজে টিকে থাকার জন্য নিজের একটি অংশ গোপন রাখার অনুভূতি কেমন,’ বলছেন তিনি।

মায়ুখ সেন এখন দক্ষিণ এশীয় দৃষ্টিকোণ থেকে ওবেরনের গল্প তুলে ধরতে তার জীবনী নিয়ে কাজ করছেন।

জন্ম নাম এস্টেলে মার্লে ও’ব্রায়েন থম্পসন।

বম্বেতে (বর্তমান মুম্বাই) ১৯১১ সালে জন্ম নেন তিনি। তার মা ছিলেন অর্ধেক সিংহলী ও অর্ধেক মাওরি আর বাবা ব্রিটিশ।

১৯১৪ সালে ওবেরনের বাবা মারা যাওয়ার পর ১৯১৭ সালে পুরো পরিবার কলকাতায় চলে আসে।

১৯২০ সালে ক্যালকাটা অ্যামেচার থিয়েট্রিকাল সোসাইটি দিয়ে তার অভিনয় জীবনের শুরু।

মায়ুখ সেনের ভাষ্য, ১৯২৫ সালে প্রথমবারের মতো নির্বাক চলচ্চিত্র দ্য ডার্ক অ্যাঞ্জেলে ভিলমা ব্যাঙ্কিকে দেখার পরই অভিনয়কে পেশা হিসেবে নেয়ার জন্য অনুপ্রাণিত হন ওবেরন।

সেনাবাহিনীর এক কর্নেলের মাধ্যমে পরিচালক রেক্স ইংগ্রামের সঙ্গে পরিচয় হয় তার।

ইংগ্রামের একটি সিনেমায় কাজের প্রস্তাব পেয়ে ১৯২৮ সালে তিনি ফ্রান্স চলে যান।

ওবেরনের মা শার্লট শেলবি তার সঙ্গে যান পরিচারক পরিচয়ে। শার্লট শেলবি ছিলেন বাদামী চামড়ার অশ্বেতাঙ্গ।

২০১৪ সালে তৈরি প্রামাণ্যচিত্র ‘দ্য ট্রাবল উইদ মার্লে’তে বলা হয়, শার্লট শেলবি আসলে ছিলেন ওবেরনের দাদি। মিজ শেলবির কন্যা কন্সট্যান্স অল্প বয়সে সন্তান জন্ম দেয়। কিন্তু কিছু বছর তাদের দু’জনকে বোন হিসেবে বড় করেন মিজ শেলবি।

স্যার আলেকজান্ডার কর্ডার ছায়াছবি দ্য প্রাইভেট লাইফ অব হেনরি এইটে (১৯৩৩) অ্যানে বোলেইনের চরিত্রের মাধ্যমে প্রথম বড় সুযোগটি পান ওবেরন। পরে স্যার আলেকজান্ডারকেই বিয়ে করেন ওবেরন।

কর্ডার পাবলিসিস্টদের ওবেরনের জন্য একটা নতুন পরিচয় তৈরির প্রয়োজন হয়ে পড়ে। তারা তখন ওবেরনের জাতিসত্বার প্রমাণ দেয়ার জন্য একটি নতুন গল্প তৈরি করেন।

দ্য ট্রাবল উইদ মার্লের পরিচালক মারে ডেলোফস্কি তার প্রামাণ্যচিত্রের একটি নোটে লেখেন, “তাসমানিয়াকে তার নতুন জন্মস্থান হিসেবে তুলে ধরা হয়। কারণ এটি ছিল আমেরিকা এবং ইউরোপ থেকে বহু দূরে। আবার এটিকে মূলত ‘ব্রিটিশ’ বলে বিবেচনা করা হত।’’

হোবার্টের একজন উচ্চবংশীয় কন্যা, যার বাবা শিকার করতে গিয়ে নিহত হয়েছেন এবং তারপর তিনি ভারতে চলে এসেছেন- এই পরিচয় তৈরি করা হয় ওবেরনের জন্য, প্রামাণ্যচিত্রের নোটে লিখেছেন মারে ডেলোফস্কি।

এর কিছুদিনের মধ্যেই ওবেরন তাসমানিয়ার স্থানীয় সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে ওঠেন ।

তার ক্যারিয়ারের বাকি সময়জুড়ে অস্ট্রেলিয়ার গণমাধ্যম তাকে গর্ব এবং কৌতূহলের সঙ্গে অনুসরণ করে।

এমনকি ওবেরন নিজেও তাসমানিয়াকেই নিজের বাড়ি বলে পরিচয় দিতেন। কলকাতার নাম তিনি নিয়েছেন কদাচিৎ। কিন্তু কলকাতা তাকে মনে রেখেছে।

‘১৯২০ এবং ১৯৩০-এর দিকে অনেক ইংরেজের স্মৃতিকথায় তার উল্লেখ আছে’, বলছেন সাংবাদিক সুনন্দা কে দত্ত।

“তারা দাবি করেন, কলকাতায় ওবেরনের জন্ম, টেলিফোন এক্সচেঞ্জের একজন সুইচবোর্ড অপারেটর ছিলেন তিনি। ফিরপো’র রেস্তোরাঁয় একবার একটি প্রতিযোগিতাও জেতেন তিনি।’’

যখন হলিউডে বেশি বেশি কাজ করতে শুরু করেন, তখন পাকাপাকিভাবে আমেরিকা চলে যান ওবেরন। দ্য ডার্ক অ্যাঞ্জেলের জন্য ১৯৩৫ সালে অস্কারের মনোনয়ন পান।

তবে ১৯৩৯ সালে ওয়াদারিং হাইটস-এ অভিনয় করেই সুপরিচিত হন তিনি।

ছায়াছবিটিতে তিনি কিংবদন্তী অভিনেতা লরেন্স অলিভিয়ারের বিপরীতে অভিনয় করে হলিউডে নিজের জায়গা পোক্ত করেন।

কথিত আছে, আরেকজন ভারতীয় বংশোদ্ভূত অভিনয়শিল্পী ভিভিয়ান লেই’য়ের জায়গায় তাকে বেছে নেয় ওয়াদারিং হাইটস টিম, কারণ ওবেরন তখন বেশ নামকরা, বলছেন মায়ুখ সেন।

ছায়াছবিটি নিয়ে নিউ ইয়র্ক টাইমসের এক পর্যালোচনায় বলা হয়, “নায়িকা হিসেবে ওবেরন ঠিকঠাকভাবে অস্থিরমতি, সদা পরিবর্তনশীল মানসিকতার ব্রন্টের চরিত্রটিতে উৎরে যান।’’

১৯৩০ এর দশকে বড়দের কাতারে ঢুকে পড়েন ওবেরন, বলছেন মায়ুখ সেন।

এসময় তার ঘনিষ্ঠদের মধ্যে সুরকার কোল পোর্টার এবং চিত্রনাট্যকার নোয়েল কাওয়ার্ডের মতো বিখ্যাত লোকেরা ছিলেন।

কর্ডা এবং প্রবীণ প্রযোজক স্যামুয়েল গোল্ডউইন ওবেরনকে আরো পরিপক্ব করে তোলেন।

তারা তার কিছু কিছু বৈশিষ্ট্য বদলাতে সাহায্য করেন, যার মধ্যে ছিল দক্ষিণ এশিয়ার বাচনভঙ্গি ত্যাগ করে পরিশীলিত বাচনে কথা বলা।

যদিও সাদা চামড়ার কারণে বড় পর্দায় শ্বেতাঙ্গ হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে ওবেরনকে বিশেষ বেগ পেতে হয়নি, কিন্তু এই গোপন করার ব্যাপারটা বেশ ঝক্কিরই ছিল তার জন্য।

‘ওবেরনের মিশ্র বর্ণ নিয়ে প্রায়ই ফিসফাস চলতো, এটা থামানোর দরকার পড়তো তার। ওই সময়ের চলচ্চিত্র সাংবাদিকরা নিশ্চয়ই তার কম সাদা চামড়ার ব্যাপারটি খেয়াল করে থাকবেন’, বলেছেন মায়ুখ সেন।

কেউ কেউ দাবি করেন, ত্বক-সাদা করা বা ব্লিচিং চিকিৎসার কারণে ওবেরনের ত্বকের ক্ষতি হয়েছিল।

১৯৩৭ সালে গাড়ি দুর্ঘটনায় ওবেরন আহত হওয়ার পরে তার মুখে দাগ হয়ে যায়।

চিত্রগ্রাহক লুসিয়েন ব্যালার্ড এসময় ওবেরনের ওপর এমনভাবে আলো ফেলতেন যাতে পর্দায় মুখের দাগগুলো আর বোঝা যেত না। লুসিয়েন ব্যালার্ডের এই কৌশল পরে বেশ বিখ্যাত হয়।

কর্ডাকে ১৯৪৫ সালে তালাক দিয়ে লুসিয়েন ব্যালার্ডকে বিয়ে করেন ওবেরন।

“কিছু সূত্র নির্দেশ করছে, এই কৌশলে দাগ ঢাকার পাশাপাশি ক্যামেরার সামনে ওবেরনের ত্বকের রঙ আরও ‘সাদা’ দেখাতো’’, বলেছেন মায়ুখ সেন।

১৯৭৯ সালে চার্মড লাইভস নামে পারিবারিক স্মৃতিকথা প্রকাশ করেন ওবেরনের ভাতিজা মাইকেল কর্ডা। তিনি সেখানে ওবেরনের পিতৃপ্রদত্ত নাম ও জন্মস্থান উল্লেখ করায় ওবেরন তাকে মামলার হুমকি দেন। এরপরই মাইকেল কর্ডা স্মৃতিকথা থেকে এইসব তথ্য বাদ দিয়ে দেন।

এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘আমি ভেবেছিলাম অনেক সময় পার হয়ে গেছে। কিন্তু তখনও তিনি তার অতীত নিয়ে আলাপে শঙ্কিত ছিলেন।’

তবে ক্রমেই এই লুকিয়ে রাখার খেলা তার জন্য কঠিন হয়ে উঠছিল।

১৯৬৫ সালে ওবেরন তার জন্ম ও বেড়ে ওঠার বিষয়ে স্থানীয় সাংবাদিকদের কৌতূহল দেখে অস্ট্রেলিয়ায় একটি সফর সংক্ষিপ্ত করেন এবং জনসমক্ষে আসা বন্ধ করে দেন।

১৯৭৮ সালে তাসমানিয়াতে শেষবার সফরের সময় অনবরত তার পরিচয় নিয়ে প্রশ্ন করা হলে ওবেরন বিরক্ত হয়ে উঠেছিলেন।

কিন্তু তিনি কখনোই সত্যিটা স্বীকার করেননি। ১৯৭৯ সালে তিনি মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণে মারা যান।

১৯৮৩ সালে ‘প্রিন্সেস মার্লে: দ্য রোমান্টিক লাইফ অফ মার্লে ওবেরন’ নামের জীবনীগ্রন্থে তার অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান পরিচয় প্রথমবারের মতো প্রকাশ পায়।

বইটির লেখক বম্বেতে তার জন্মের রেকর্ড, ব্যাপ্টিজমের সনদ এবং ভারতীয় আত্মীয়দের চিঠি ও ছবি খুঁজে পান।

একজন দক্ষিণ এশীয় নারী হিসেবে ওবেরন যে বিশাল চাপের মুখোমুখি হয়েছিলেন তা প্রকাশিতব্য বইয়ের মাধ্যমে তুলে ধরতে পারবেন বলে আশা করেন মায়ুখ সেন।

‘সেসব সংগ্রাম মোকাবিলা করা সহজ ছিল না। তাকে কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর চেয়ে তার প্রতি করুণা এবং সহানুভূতি দেখানোই যথাযথ হবে,’ বলেন মায়ুখ সেন।

সূত্র : বিবিসি

RELATED ARTICLES
- Advertisment -
Google search engine

Most Popular

Recent Comments