ভারী বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে ডুবে আছে সিলেট। পানিবন্দি অন্তত ৩০ লাখ মানুষ। নিরাপদ আশ্রয় খুঁজছেন তারা। খাবারের সংকট। কোথাও মিলছে না বিশুদ্ধ পানি। চারদিকে হাহাকার। বানভাসি মানুষের ভোগান্তি চরমে। এর আগে এমন পরিস্থিতিতে পড়েনি সিলেটের মানুষ। গত মাসেও সিলেট ও সুনামগঞ্জের বিভিন্ন এলাকায় বন্যা হয়েছিল। এর কয়েক সপ্তাহ পর ফের বন্যায় সিলেট ও সুনামগঞ্জ প্লাবিত হয়েছে।
প্রতি বছরই এক বা একাধিকবার বন্যা হচ্ছে। আর এতে ক্ষেতের ফসলসহ ক্ষতি হচ্ছে জানমালের। ঘন ঘন বন্যার জন্য অতিবৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলকে দায়ী করেছেন বিশেষজ্ঞরা।
তারা বলছেন- ভারতের আসাম, মেঘালয়ে অতিবৃষ্টি হলেই বাংলাদেশের ওপর চাপ পড়ে। প্রতিনিয়তই জলবায়ু পরিবর্তন হচ্ছে। পৃথিবী উত্তপ্ত হচ্ছে। গ্রিন হাউজ ইফেক্টে ধ্বংস হচ্ছে বনায়ন। সিলেট অঞ্চলে বন্যা এই জলবায়ু পরিবর্তনের ফল। এ ছাড়া অপরিকল্পিতভাবে রাস্তাঘাট ও অবকাঠামো নির্মাণে পানির প্রবাহে বাধা সৃষ্টি হয়েছে। এতে অতিবৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢল নামলে পানি নিচের দিকে নেমে আসতে সময় লাগছে। এ ছাড়া সিলেট অঞ্চলের নদী ও হাওরের নাব্য কমে গেছে। পলি জমে অধিকাংশ হাওরে পানির প্রবাহ কমে গেছে। অপরিকল্পিতভাবে পাথর উত্তোলন ও খালে ময়লা আবর্জনা ভরাট হওয়ায় পানির ধারণক্ষমতা কমে গেছে। ফলে প্রতি বছর বর্ষার মৌসুমে একাধিকবার বন্যা হচ্ছে।
ইমেরিটাস অধ্যাপক এবং পানিসম্পদ ও জলবায়ু পরিবর্তন বিশেষজ্ঞ ড. আইনুন নিশাত মানবজমিনকে বলেন, সিলেট অঞ্চলের বন্যার পেছনে হাওর এলাকার অবকাঠামো তেমন একটা দায়ী নয়। পানির যে গতি তাতে রাস্তা তেমন একটা বাধা হতে পারে না। সিলেটে বন্যার পেছনে অতিবৃষ্টিই দায়ী। উজান থেকে পাহাড়ি ঢল নেমেছে। যা আমাদের দেশের পানি নয়, অন্য স্থান থেকে আসা পানি। ৩ দিনে ২৫০০ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে। এই পরিমাণ বৃষ্টি ঢাকায় হলে পুরো শহর তলিয়ে যেত। সিলেট ও সুনামগঞ্জে প্রাকৃতিক কারণেই বন্যা দেখা দিয়েছে। আবহাওয়া অধিদপ্তর বলছে আরও ৪/৫ দিন বৃষ্টি হবে। যদি ভারী বৃষ্টিপাত হয় তাহলে পানি আরও বাড়বে। তবে কিছু অবকাঠামো পানির প্রবাহে যে বাধা দিচ্ছে না তাও বলা যাবে না।
বুয়েটের পানি ও বন্যা ব্যবস্থাপনা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক একেএম সাইফুল ইসলাম বলেন, অস্বাভাবিক বৃষ্টির কারণে সিলেট ও সুনামগঞ্জে ভয়াভহ বন্যা হয়েছে। সুনামগঞ্জে এখন পর্যন্ত রেকর্ড পরিমাণ বৃষ্টি হয়েছে। উজান থেকে ঢল আসলেও পানি নামতে বাধা পড়ছে। এ ছাড়া অতিবৃষ্টি সিলেট এলাকায় ধারণক্ষমতার বাইরে। নদীগুলো ভরাট হয়ে যাওয়া, পাথর তোলা, গাছগাছালি কেটে ফেলা এর জন্য দায়ী। এবছর সিলেটে ক্ষতির পরিমাণ বেশি হওয়ার কারণ এর আগে সেখানে এত বেশি বাসাবাড়ি ছিল না। হাওর এলাকাগুলোতে বাঁধ দিয়ে পানির প্রবাহ বাধা দিচ্ছে। এতে পানি নামতে দেরি হচ্ছে।
হাওর অ্যান্ড চর ডেভেলপমেন্ট ইনস্টিটিউটের পরিচালক প্রফেসর ড. মো. আবদুস সালাম মানবজমিনকে বলেন, এবছর সিলেটে বন্যায় বিপর্যয়ের কারণ প্রথমত পরিবেশগত। ভারতের চেরাপুঞ্জিতে ১২২ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ বৃষ্টিপাত হয়েছে। আসাম, মেঘালয় অনেক উঁচু এলাকায়। বাংলাদেশ যেহেতু ডাউনে। এজন্য সেখানকার বৃষ্টির পানি আমাদের দেশে ঢল নেমে আসে। অন্যদিকে আমাদের নদী ভরে গেছে। বিভিন্ন স্থানে খাল-বিল দখল হয়ে গেছে। সেগুলো ভরাট করে ফেলছে। পানি ধারণ করার মতো স্থান সেখানে নেই। হাওর ও বাঁওড়গুলো একটা থালার মতো সেখানেও বাঁধ দিয়ে চাষাবাদ করা হচ্ছে। পানি ঢুকতে দিচ্ছে না। এতে পানির ধারণের জায়গা দিন দিন কমছে। বন্যার পানি বাড়ার কারণ হিসেবে অনেকেই হাওর এলাকার অবকাঠামো ও রাস্তাকে দায়ী করছেন। সেটিও একেবারে ফেলে দেয়া যায় না।
হাওরের উপর বাঁধ নির্মাণ পানির প্রবাহ কিছুটা হলেও কমিয়ে দিচ্ছে। সিলেটের নদীগুলোর পানি মেঘনা নদী দিয়ে নামছে। কয়েকটা নদীর পানি একটা নদী দিয়ে নামতেও সময় লাগছে। এসব কারণে সিলেট অঞ্চলের পানি দ্রুত বেড়েছে। পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের (পবা) চেয়ারম্যান আবু নাসের খান বলেন, ১৯৫৫, ১৯৭৪ ও ১৯৮৮ সালে বড় ধরেনের বন্যা হয়েছে। এবারও সিলেট অঞ্চলে বড় বন্যা দেখলাম। এবছর সেখানে প্রচুর পরিমাণে বৃষ্টি হয়েছে। রেকর্ড পরিমাণ বৃষ্টি হয়েছে গত কয়েকদিনে। একই সঙ্গে পাহাড়ি ঢল নামছে। যে পরিমাণ এসেছে, সেভাবে ভাটি অঞ্চলের পানি নামতে পারেনি। পানির প্রবাহগুলোতে উন্নয়নের নামে বাঁধ দিয়ে রাখা হয়েছে। এতে বিভিন্ন স্থানে পানি নামতে বাধা পড়ছে। হাওর এলাকায় দীর্ঘ রাস্তা নির্মাণ হয়েছে। এটিও একটি বড় বাধা। সরকারকে এখন নতুন করে ভাবতে হবে। পানি বাড়লে সে পানি যাতে দ্রুত সময়ে নেমে যেতে পারে তার জন্য বিকল্প ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
বড় বড় ব্রিজ করা যেতে পারে। বন্যা সময় সময় খারাপ না। তবে এত বড় বন্যা পরিবেশের উপর বিরূপ প্রভাব পড়বে। তিনি বলেন, সিলেট অঞ্চলের বিভিন্ন বাঁধের কারণে উপরের পানি নামতে পারেনি। এতে ভয়াবহ বন্যা দেখা দিয়েছে। বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের নির্বাহী প্রকৌশলী আরিফুজ্জামান ভূঁইয়া মানবজমিনকে বলেন, আসাম, মেঘালয়ে গত কয়েকদিন ধরে ভারী বৃষ্টি হচ্ছে। সেখানকার বৃষ্টির পানিই সিলেটের বন্যার জন্য প্রধান কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে হাওর এলাকার অবকাঠামো নির্মাণের ফলে পানির প্রবাহে বাধা সৃষ্টি হচ্ছে না- এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি মন্তব্য করতে রাজি হননি।