পবিত্র কুরআনে বর্ণিত সেই জুলকারনাইন ছিলেন একজন ক্ষমতাধর ব্যক্তি। তবে তিনি কে, কোন যুগের এ নিয়ে সুস্পষ্ট কিছু জানা যায়নি। তিনি কী নবি, না নবি নন, এ নিয়েও নানা বিতর্ক রয়েছে। আল কুরআনের সূরা কাহাফ-এ বর্ণিত জুলকারনাইনের বিষয়ে প্রাচীন তাফসিরবিদদের মধ্যে ইমাম রাজি (রহ.)-এর মত হলো-জুলকারনাইনের প্রকৃত নাম সিকান্দার। যিনি মূলত আলেকজান্ডার নামে পরিচিত। তিনি দারা ইবনে দারাকে একাধিকবার পরাজিত করেছেন। এ তাফসিরবিদ আরও লিখেছেন, ‘এটা অকাট্যভাবে প্রমাণিত যে, জুলকারনাইন হলেন বাদশাহ সিকান্দার ইবনে ফিলিবুস ইউনানি।’ (আততাফসিরুল কাবির)।
অনেক মুফাসসির বলেছেন, জুলকারনাইন একজন নবি ছিলেন। বিভিন্ন ইতিহাসগ্রন্থ পর্যালোচনা করলে জানা যায়, প্রাচীনকালে আরব উপদ্বীপে এ নামটি একজন উচ্চক্ষমতাধর ব্যক্তির সঙ্গে সম্পর্কিত ছিল। আর ওই ব্যক্তি ছিলেন গোটা দুনিয়ার বাদশাহ। তিনি অল্প বয়সেই এত প্রভাব-প্রতিপত্তির অধিকারী হয়েছিলেন। পবিত্র কুরআন যেমন তার নবি হওয়ার ব্যাপারে কিছু বলেনি, তেমনি তিনি যে নবি নন এ কথাও বলেনি। শুধু বলা হয়েছে, আল্লাহতায়ালা তাকে সব বিষয়ে দিকনির্দেশনা বা কার্যোপকরণ দান করেছেন এবং তিনি দুটি পথ অনুসরণ করলেন। এর মধ্যে এক পথে গিয়ে তিনি ইয়াজুজ-মাজুজের হাতে অত্যাচারিত এক জাতিকে দেখতে পেলেন। তিনি ওদের অত্যাচারের হাত থেকে তাদের রক্ষা করার জন্য গলিত তামা দিয়ে একটি প্রাচীর বানিয়ে দিলেন।
জুলকারনাইন বা ‘দুই শিংবিশিষ্ট’ ব্যক্তি সম্পর্কে সূরা কাহাফের ৮৩-৮৬ নম্বর আয়াতের আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তারা আপনার কাছে জুলকারনাইন সম্পর্কে জানতে চায়। আপনি বলুন, আমি তোমাদের কাছে তার কিছু অবস্থা বর্ণনা করব। আমি তাকে পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠিত করেছিলাম। আর প্রত্যেক বিষয়ের কার্যোপকরণও দান করেছিলাম। অতঃপর তিনি এক কার্যোপকরণ অনুসরণ করলেন। তিনি যখন সূর্যের অস্তাচলে পৌঁছলেন সূর্যকে এক পঙ্কিল জলাশয়ে অস্ত যেতে দেখলেন। আর সেখানে এক সম্প্রদায়কেও দেখতে পেলেন। আমি বললাম, হে জুলকারনাইন, তুমি তাদের শাস্তি দিতে পার। আবার তাদের সদয়ভাবে গ্রহণও করতে পার।’
মজলুম ও নিপীড়িত মানুষদের জালেম শাসকদের হাত থেকে বাঁচানোর জন্য আল্লাহর এ অনুগত বান্দা জুলকারনাইন বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে ঘুরে বেড়াতেন। সূরা কাহাফের ৯৩ থেকে ৯৮নং আয়াতে জুলকারনাইন অরুণাচলে বা যেখান থেকে সূর্য উদিত হয় সেখানে যে দেওয়ালের কথা উল্লেখ আছে তা ইয়াজুজ-মাজুজের অত্যাচার থেকে জনগণকে হেফাজতের জন্য নির্মাণ করা হয়েছিল। যে স্থানটি পাহাড়ের প্রাচীরের মাঝখানে।
এ প্রাচীর নির্মাণের ঘটনা প্রমাণ করে, ওই জাতি ধাতুর ব্যবহার জানত। ফলে তারা ফুঁক নল দ্বারা বায়ু প্রবাহিত করে ধাতুকে উত্তপ্ত করে গলাতেও পারত। তাই তারা লোহার পিণ্ড ও গলিত তামা দিয়ে প্রাচীর নির্মাণের কাজটি সহজে সম্পন্ন করতে পেরেছিল। জুলকারনাইন তাদের এ প্রতিরোধ প্রাচীর তৈরির সব উপাদান ও শ্রম সরবরাহ করতে বললেন। তারা নিজেরাই জুলকারনাইনের পরামর্শ অনুযায়ী সেই দুই পর্বতের মাঝে শক্ত লোহার প্রাচীর তৈরি করল। জুলকারনাইনের পরামর্শে নির্মিত সেই প্রাচীরটি আসলে কোথায় তা সঠিকভাবে কেউই বলতে পারে না। তবে উপরিউক্ত প্রাচীরের বর্ণনার সঙ্গে মিল রেখে এমন একটি দেওয়াল রয়েছে কাসপিয়ান সাগরের উপকূলে।
ইতিহাস থেকে জানা যায়, এ ধরনের একটি দেওয়াল তৈরি করেছেন আলেকজান্ডার। এটি তৈরি করতেও লোহা ও তামার ব্যবহার হয়েছে। একটি তোরণও রয়েছে সেখানে; যা ‘কাসপিয়ান গেট’ বা ‘আলেকজান্ডারের গেট’ নামে পরিচিত। যার ব্যাপ্তি দারিয়াল ও দারবেন্ত নামে দুটি শহরের মাঝে। দারিয়াল রাশিয়া ও জর্জিয়ার সীমান্তে অবস্থিত। এটিকে বলা হয় কাজবেক পাহাড়ের পূর্ব প্রান্ত। দারবেন্ত রাশিয়ার দক্ষিণে অবস্থিত একটি শহর। কাসপিয়ান সাগরের দক্ষিণপূর্ব উপকূলে নির্মিত এ দেওয়ালটি তৈরি করা হয়েছে দুটি পাহাড়ের মধ্যবর্তী ফাঁকে; যা পৃথিবীর উঠান নামেও প্রসিদ্ধ। এ দেওয়ালের উচ্চতা ২০ মিটার আর প্রস্থ ৩ মিটার।
মজলুম মানুষের বন্ধু এ ন্যায়বান শাসক গোটা মানবকুলের জন্য একটি উদাহরণ হয়ে আছেন। কারণ পৃথিবীর এ চাকচিক্য কারও জন্যই স্থায়ী নয়। সবাইকে একদিন শূন্য হাতে ফিরে যেতে হবে। পাড়ি জমাতে হবে সেই অনন্ত পথের দিকে। সেখানে আল্লাহ ছাড়া মানুষের সহায়ক আর কেউ হবে না। দুনিয়ার নেক আমলগুলো শুধু উপকারে আসবে। তাই তিনি মৃত্যুর আগে অসিয়ত করে বলেছিলেন, আমার মৃত্যুর পর যেন আমার দুই হাত কাফনের বাইরে বের করে রাখা হয়। তার কাছে এর কারণ জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, শান-শওকত, ধনসম্পদ, প্রভাব-প্রতিপত্তি কত কিছু ছিল আমার। এখন কিছুই আমি সঙ্গে নিতে পারছি না। খালি হাতে ফিরে যেতে হচ্ছে।
লেখক : প্রাবন্ধিক ও গবেষক