প্রযুক্তির সঙ্গে তাল মিলিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে বিশ্ব। পিছিয়ে নেই বাংলাদেশও। এর ছোঁয়া লেগেছে সবখানে। প্রযুক্তির অন্যতম একটি উপহার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম। এখানে বুঁদ বহু মানুষ। নিজের মধ্যে যোগাযোগ আর দেশ-বিদেশের নানা ঘটনার খোঁজ রাখতে ব্যবহার হচ্ছে এই মাধ্যমগুলো। বাংলাদেশে জনপ্রিয় যোগাযোগের মাধ্যমগুলোর মধ্যে এগিয়ে আছে ফেসবুক ও ইউটিউব। দেশের শোবিজ পাড়াও এখন সেই ‘বেড়াজালে’।
প্রযুক্তির বদৌলতে শোবিজ অঙ্গনের মানুষদের ভাবনা-চিন্তাও বদলেছে। প্রচারে জন্য নির্মাতা, শিল্পী ও প্রযোজকরা এখন বেছে নিয়েছেন ফেসবুক। আর তাদের নতুন কাজগুলো টিভি বা সিনেমার পর্দায় প্রকাশের পরই চলে আসে হাতের মুঠোয়। মুঠোফোনে থাকা ফেসবুক ও ইউটিউব-ই এখন যেন দর্শকদের বিনোদনের প্রধান একটি মাধ্যম। এর প্রমাণ মেলে এই দুই মাধ্যমে চোখ বুলালেই। গত ঈদে দেশের বিভিন্ন চ্যানেলে প্রচারিত নাটক, টেলিছবির ঠাঁই হয়েছে এখন ইউটিউবে।
দর্শকরাও সময় ও বিজ্ঞাপনের বিড়ম্বনা এড়াতে টিভিতে প্রচারিত অনুষ্ঠানগুলো দেখে থাকেন ইউটিউবে। আর এই সুযোগটা কাজে লাগাতে প্রযোজক ও নির্মাতারাও তাদের নাটক, টেলিছবি প্রচারের জন্য নিজস্ব ইউটিউব চ্যানেল খুলে থাকেন। যেখানে বাড়তি আয়ের জন্য প্রকাশ করা হয় সেসব কন্টেনগুলো।
দর্শকরা ভালো গল্পের নাটক দেখার জন্য ‘ভিউ’র ওপর অনেকটাই নির্ভশীল বলা যায়। যেগুলোর ভিউ সবচেয়ে বেশি, তারা সেসব নাটক ও টেলিছবিই বেশি দেখে থাকেন। আর এই সুযোগটা কাজে লাগিয়ে একদল প্রতারকচক্র টাকা দিয়ে ‘ভিউ বাড়িয়ে’ ধোঁকা দিচ্ছেন দর্শকদের। এই ভিউ, লাইক, কমেন্ট কিংবা ফলোয়ার সবই এখন হচ্ছে টাকার খেলায়।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, দেশে এমন অসংখ্য প্রতিষ্ঠান আছে যারা টাকার বিনিময়ে এসব কাজ করে থাকেন। কেউ আবার ফেসবুক ও ইউটিউবকে টাকা (ডলার) দিয়ে তাদের কন্টেট এগিয়ে রাখেন। আবার অনেক প্রতিষ্ঠান আছে যারা কর্মী খাটিয়ে অসৎ উপায়ে আইডি থেকে (ফেসবুক অ্যাকাউন্ট বা ইমেইল ব্যবহার করে) লাইক, ফলোয়ার ও ভিউ বাড়িয়ে থাকে।

পরিচয় গোপন রেখে তেমনই একটি প্রতিষ্ঠানের সন্ধান পেয়েছি আমরা। যেখানে টাকার বিনিময়ে ইউটিউব চ্যানেল ও ফেসবুককে এগিয়ে রাখা হয়। বাড়িয়ে দেওয়া হয় লাইক, ভিউ, ফলোয়ার ও কমেন্ট।
এই প্রতিষ্ঠানের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, তার পাঁচটি ওয়েবসাইট আছে। এর মধ্যে একটি এনএসবুস্টবিডি.কম। এখান থেকে টাকা লেনদেনের জন্য বিকাশ ও রকেট ব্যবহার করে কন্টেন বুস্ট করা হয়। এ ছাড়া অন্য সাইট থেকে ভিসা কার্ড ব্যবহার করে কন্টেন বুস্ট করা যায়। শুধু তাই নয়, ঝড়ের গতিতে সেসব কন্টেনের ভিউ বাড়ানোর কাজও করে থাকেন তারা। একদম নতুন একটি ফেসবুক পেজ বা ইউটিউব চ্যানেল র্যাংকিংয়ে এগিয়ে রাখতে যা যা করার প্রয়োজন, তারা তা করে দেন।
প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তা বলেন, ‘আপনার চ্যানেলে র্যাংকিং কম থাকলে সেটি আগে বাড়াতে হবে। ভিউ বাড়লে র্যাংকিংও বাড়বে। আপনার যে কন্টেন্ট আছে তার একটি লিংক আমাদের পাঠাবেন। আমরা সেখানে ভিউ প্রমোট করব। চ্যানেলে যত ভিউ হবে, চ্যানেল তত র্যাংকিংয়ে এগিয়ে থাকবে। আমরা সরাসরি বেশি কাজ নিয়ে থাকি। আর যদি আপনি অল্প অর্ডার করতে চান, তাহলে ওয়েবসাইট থেকে নিজে নিজেই করতে পারেন।’
তিনি আরও বলেন, ‘দেশে অনেক প্রতিষ্ঠানের কাজ আমরা করেছি। সিডি চয়েজ, জি-সিরিজ, বঙ্গবিডি, ঈগল মিউজিক এমন হাজার হাজার প্রতিষ্ঠানের কাজ আমরা করেছি। শুরুর দিকে ধ্রুব মিউজিকের কাজও করেছি। তারা সবাই আমাদের সাইট থেকেই ভিউ প্রমোট করেছে।’
কত টাকায় কত ভিউ বা লাইক পাওয়া যায়, সে বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আপনি কতটুকু ভিউ নেবেন, ১ লাখ নাকি ১০ হাজার। বর্তমান সময়ে ডলারের দামটা একটু বেশি। ১ লাখ ভিউ নিলে সাত হাজার বা সাড়ে সাত পরবে। আর যদি আপনি ভালো মানের নেন তাহলে ৮ থেকে ৯ হাজার টাকা পরবে। এখানে স্প্রিডের একটা বিষয় আছে, আপনি যদি সাড়ে আট হাজার টাকারটা নেন, তাহলে পার ডে (প্রতিদিন) স্প্রিড হবে ১০-২০ হাজার। সাত দিনের মধ্যে আপনার ১ লাখ ভিউ হয়ে যাবে, তারও আগে হতে পারে। আর সঙ্গে লাইক ফ্রি।’
তিনি বলেন, ‘প্রতি এক হাজারে আপনার লাইক আসবে ৫০-৮০টা করে। আর যদি ফলোয়ার বাড়াতে চান, তাহলে আপনার ১ হাজার ফলোয়ারের দাম পরবে ২ হাজার ৫০০ টাকা; লাইফ টাইমের জন্য। আরও বেশি বাড়াতে চাইলে দাম বেশি পরবে। আপনার শূন্য ফলোয়ারের ইউটিউব চ্যানেল নিয়ে আমরা কাজ করব। শুধু চ্যানেলে লিংকটা দিলেই হবে। আপনার চ্যানেলে ১ বা ১০ হাজার ফলোয়ার দরকার, আপনি টাকা (ডলার) দিয়ে অর্ডার করে দেবেন। কোম্পানি বা আমাদের যে বুস্টিং সাইট আছে, তা কীভাবে সে ফলোয়ার বাড়াবে তা আমাদের ব্যাপার এবং কতদিনের মধ্যে করা হবে, তা আপনাকে বলে দেওয়া হবে। আর ফেসবুকেও যদি কাজ করতে হয়, তাহলেও আমরা কাজ করে থাকি। আপনাকে সকল সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হবে।’
এমন আরও বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের সন্ধান পাওয়া গেছে দেশের নানা স্থানে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, তারা পার্ট-টাইম জব হিসেবে যুব সমাজকে কাজে লাগিয়ে লাইক, কমেন্ট, ফলোয়ার ও ভিউ বাড়িয়ে থাকে। এখানে কেউ আছেন মাসিক বেতনে, আবার কেউ আছেন কাজের গতির ওপর সম্মানিতে। এখন ঢাকার বাইরে এসব প্রতিষ্ঠান অনেক বেশি। কারণ সেখানে অল্প টাকাতেই জনবল পাওয়া যায় খুব সহজে।
মূলত, বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানে এভাবে ফেসবুক ও ইউটিউবে লাইক, কমেন্ট, ফলোয়ার ও ভিউ বাড়ানো হয় বলে জানা গেছে। আর ক্রেতা শুধু দেশীয় প্রতিষ্ঠানই নয়, বিদেশি অনেক প্রতিষ্ঠানও তাদের থেকে এসব কিনে থাকে।