তাবলিগ নিয়ে সৌদি নির্দেশনা
গত ৬ ডিসেম্বর ২০২১ তাবলিগ জামাতের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করে সতর্কতা জারি করে সৌদি আরব। এক টুইট বার্তায় জুমার নামাজের খুতবায় এ সংগঠন সম্পর্কে মানুষকে সতর্ক করার নির্দেশ দেন দেশটির ইসলাম বিষয়ক মন্ত্রী ডা. আব্দুল লতিফ আল শেখ। দেশটির এই নির্দেশনায় সারা বিশ্বের শীর্ষ আলেমরা ক্ষোভ ও হতাশা প্রকাশ করেছেন। ভারতের দারুল উলুম দেওবন্দসহ একাধিক প্রতিষ্ঠান সৌদি আরবকে সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার আহ্বান জানিয়েছে। চলমান ইস্যুতে বাংলাদেশের শীর্ষ আলেমরাও নিজেদের অবস্থান স্পষ্ট করেছেন। তাঁদের সঙ্গে কথা বলেছেন আবরার আবদুল্লাহ
সৌদি আরবের উচিত উপমহাদেশের আলেমদের সঙ্গে কথা বলা
আল্লামা মাহমূদুল হাসান
চেয়ারম্যান, আল-হাইয়াতুল উলিয়া লিল-জামিয়াতিল কওমিয়া বাংলাদেশ
ইসলামী ভাবনার তাবলিগ তথা ঈমান-আমলের দাওয়াতের কাজের নিন্দা করার আগে এর ভালোমন্দ সবদিক বিবেচনা করা চাই। বর্তমান পৃথিবীতে কোটি কোটি মানুষ ঈমান ইসলাম ও ইহসানের দিকে ধাবিত হচ্ছে তাবলিগের মেহনতের ফলে। সৌদি আরবের আলেমদের উচিত তাবলিগি কাজ সম্পর্কে উপমহাদেশীয় আলেমদের সঙ্গে কথা বলে মন্তব্য করা। আওলাদে রাসুল (সা.) মাওলানা মুহাম্মাদ রাবে হাসানি নদভি, মাওলানা সাইয়েদ আরশাদ মাদানি, মাওলানা মুফতি তাকি উসমানিসহ বিশ্বের সেরা আলেমদের সঙ্গে পরামর্শ করতে হবে। সৌদি সরকারের নির্দেশনা, অভিযোগ ও খুতবা প্রচারের বিষয়ে আমাদের মূল্যায়ন সৌদি বড় আলেমদের কাছে পৌঁছেছে। ঢাকায় নিযুক্ত সৌদি রাষ্ট্রদূতের মাধ্যমে শাসক পর্যায়েও পৌঁছে যাবে ইনশাআল্লাহ।
প্রচলিত তাবলিগের কাজে তাঁরা সমালোচনা বা সংশোধনী দিতে পারেন, কিন্তু শতবর্ষী একটি দ্বীনি আন্দোলনকে এভাবে একতরফা নিন্দা ও নিরুৎসাহ করতে পারেন না। অতীতের হুসামুল হারামাইন ফাতাওয়ার দুঃখজনক ঘটনার মতো কোনো মহলের মিথ্যা প্রচারণা বা একতরফা অপবাদ শুনে তাবলিগি কাজের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা দিতে পারেন না। ফলে বিশ্বে এই কাজে নিষেধাজ্ঞা জারির প্রবণতা দেখা দিতে পারে। সৌদি আরবের প্রজ্ঞাপনটির বক্তব্যে ভারতীয় উপমহাদেশের আহলে হক আলেম ও সর্বস্তরের তাওহিদি জনতা মর্মাহত হয়েছে। এ প্রসঙ্গে দারুল উলুম দেওবন্দ থেকে যে বিবৃতি প্রকাশ পেয়েছে, আমরা তার প্রতি সমর্থন জানাই।
তাবলিগ জামাতের কোনো রাজনৈতিক অভিলাষ নেই
আল্লামা আবদুল হালিম বোখারি
মহাপরিচালক, জামিয়া ইসলামিয়া পটিয়া, চট্টগ্রাম
তাবলিগ জামাত একটি ঐতিহ্যবাসী দল। এই দলের ঐতিহ্য হলো তারা কখনো রাজনীতি করে না এবং তাদের কোনো রাজনৈতিক অভিলাষও নেই। তারা দ্বিনি উদ্দেশ্য নিয়ে কাজ করে। মানুষকে ঈমান শেখানো, দ্বিন শেখানো, আমল শেখানো, সুন্নতি জীবন শেখানোই তাদের কাজ। তাবলিগ জামাত আদর্শ মানুষ বানায়। সুতরাং সৌদি আরব সরকার তাদের ব্যাপারে যে অভিযোগগুলো এনেছে তা ভুল ধারণাবশতই এনেছে। তাদের আরো অনুসন্ধান ও তদন্ত করা প্রয়োজন ছিল বলে আমি মনে করি। সামগ্রিক বা দলবদ্ধভাবে তাবলিগ জামাত শিরক ও বিদআতের চর্চা করে না। তাদের কার্যক্রমে শিরক ও বিদআত নেই। এরা আল্লাহমুখী ও আল্লাহওয়ালা জামাত। তাবলিগ জামাতের কার্যক্রম বন্ধ হলে উম্মতের দ্বিনি ক্ষতি বাড়বে। তাই সৌদি সরকারের প্রতি আমার আহ্বান থাকবে, তারা যেন বিষয়টি আরো তদন্ত ও অনুসন্ধান করে এবং যদি তাদের ব্যাপারে উত্থাপিত অভিযোগ প্রমাণিত না হয়, তবে তাদের ব্যাপারে গৃহীত সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করে।
বিশ্বের মানুষ জানে তাবলিগ জামাতের সঙ্গে চরমপন্থার কোনো সম্পর্ক নেই
মাওলানা বাহাউদ্দিন যাকারিয়া
সহসভাপতি, বাংলাদেশ কওমি মাদরাসা শিক্ষা বোর্ড (বেফাক), ঢাকা
তাবলিগ জামাতের ব্যাপারে সৌদি আরবের উত্থাপিত অভিযোগগুলোকে আমি সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন মনে করি। এর কোনো সত্যতা নেই। আমার ধারণা, সৌদি সরকারের কাছে তাবলিগ জামাত সম্পর্কে সঠিক তথ্য নেই। তারা অন্য কারো ইন্ধনেও এটা করে থাকতে পারে। আমি তাদের অভিযোগ ভিত্তিহীন বলছি—এর কারণ হলো, তাবলিগ জামাত দ্বিনের একেবারে মৌলিক বিষয় নিয়ে কাজ করে। যেসব বিষয়ে মতভিন্নতা আছে, যা মানুষের ভেতর বিভেদ ও বিরোধ উসকে দিতে পারে—এমন বিষয়গুলো তারা পরিহার করে। যেমন তারা আকিদার ভেতর শুধু ঈমানের মৌলিক বিষয় যে ব্যাপারে কোনো মতভিন্নতা নেই সে বিষয়ে আলোচনা করে, তারা ফিকহি বিষয়গুলোর আলোচনা পরিহার করে, তারা ইসলামী রাজনীতি বিষয়ে কোনো আলোচনা করে না। এমন একটি দলের ব্যাপারে চরমপন্থার অভিযোগ সত্যিই বিস্ময়কর। আর সৌদি আরবের রাষ্ট্র যা মুসলিম বিশ্বের প্রাণকেন্দ্র তার থেকে এমন অভিযোগ অত্যন্ত দুঃখজনক।
তাবলিগ জামাতের প্রতিষ্ঠাতা মাওলানা মুহাম্মদ ইলিয়াস কান্ধলভি (রহ.)। তিনি দারুল উলুম দেওবন্দের ছাত্র। আর দেওবন্দের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্যই হলো ধর্মীয় ক্ষেত্রে ভারসাম্য রক্ষা করা এবং আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাতের মতবাদ অনুসরণ করা। তাবলিগি কাজের সঙ্গে শিরক, বিদআত ও কবর পূজার কোনো সম্পর্ক নেই; বরং আলেমদের ভাষায় তাবলিগ হলো কালেমার আন্দোলন। যা মানুষকে কালেমা তথা বিশুদ্ধ আকিদা-বিশ্বাস, সুন্নতি জীবন ও শরিয়তের বিধি-বিধান শিক্ষা দেয়। তাবলিগের মাধ্যমে বিশ্বে একটি ঈমানি জাগরণের সৃষ্টি হয়েছে। এ কাজের মাধ্যমে মুসলিম যেমন দ্বিনের পথে আসছে, তেমন অমুসলিমরা ইসলামের পরিচয় লাভ করছে। সুতরাং পৃথিবীর সর্বত্র তাবলিগের কাজ হওয়া দরকার।