আদিম গুহাবাসী মানুষ থেকে আজকের জ্ঞানে-গুণে উন্নত সভ্য মানুষ, যাদের দৃষ্টি পৌঁছে গেছে অতি সূক্ষ্ম পরমাণুর অভ্যন্তর থেকে কোটি কোটি আলোকবর্ষ দূরের নতুন নতুন গ্যালাক্সির সন্ধানে; নিজের পরিচয়টুকু ছিল যাদের কাছে অস্পষ্ট তারাই আজ খুঁজে চলেছে সৃষ্টির মহাতত্ত্ব। আর এ থেকেই তৈরি হলো সাহিত্য, দর্শন, বিজ্ঞান।
বিশিষ্ট মার্কিন পদার্থ বিজ্ঞানী ড. খন্দকার রেজাউল করিম বিজ্ঞানের অধ্যাপক হয়েও বিজ্ঞানের সঙ্গে দর্শন ও সাহিত্যের চমৎকার সমন্বয় ঘটিয়েছেন তার ‘কাল্পনিক বিতর্ক’ বইটিতে; যা গতানুগতিক ধারার লেখার থেকে বেশ ব্যতিক্রম। ফলে পাঠক এ বই পাঠে ভিন্ন এক উৎকৃষ্ট স্বাদের সাক্ষাৎ পাবেন বৈকি। লেখক বিভিন্ন সময়ের বিভিন্ন দেশের বড় বড় বিজ্ঞানী, সাহিত্যিক, দার্শনিকদের জড়ো করেছেন কাল্পনিক এক চমৎকার বিতর্কে, যাদের মধ্যে আছেন-ডেমোক্রিটাস, প্লেটো, অ্যারিস্টটল, ওমর খৈয়াম, গ্যালিলিও, নিউটন, লালন, রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র, রবার্ট ফ্রস্ট, আইন্সটাইন, জীবনানন্দ দাশসহ অনেকই।
বইটিতে রয়েছে ডেমোক্রিটাসের সময় থেকে আজ পর্যন্ত বিজ্ঞানের জগতে যা যা ঘটেছে, সেই সঙ্গে বিজ্ঞানীদের জীবনে ঘটে যাওয়া গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার সারসংক্ষেপ। প্রচুর শ্রম আর মেধা খরচায় লেখক দর্শন, বিজ্ঞান, সাহিত্যের যে অপূর্ব মেলবন্ধন ঘটিয়েছেন তা অভূতপূর্ব। ১৬৮ পৃষ্ঠায় পদার্থবিজ্ঞানের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো আলোচনা করা হয়েছে কোন জটিল সমীকরণ ছাড়া, সঙ্গত কারণেই পাঠ্যবইয়ের সাহায্যকারী হিসাবে বইটি পঠিত হতে পারে দ্বিধাহীনভাবে। বইটিতে জগদ্বিখ্যাত লেখক-বিজ্ঞানী-দার্শনিকদের সঙ্গে লেখক নিজে কাল্পনিক বিতর্কে জড়িয়ে সাহিত্য ও দর্শনের চমকপ্রদ উপস্থাপনায় কাঠখোট্টা বিজ্ঞানকে করেছেন আকর্ষণীয়। যেমন-
“রবীন্দ্রনাথ : আমারই চেতনার রঙে পান্না হলো সবুজ, /চুনি উঠল রাঙা হয়ে / আমি চোখ মেললুম আকাশে, / জ্বলে উঠল আলো/ পুবে পশ্চিমে। /গোলাপের দিকে চেয়ে বললুম ‘সুন্দর’ / সুন্দর হলো সে।
আইনস্টাইন : তোমার কবিতাটি সুন্দর, তবে তোমার সঙ্গে আমি একমত নই। পান্না এবং চুনি কয়েকটি বিশেষ তরঙ্গদৈর্ঘের আলো প্রতিফলন করে, তোমার চেতনার সঙ্গে কোনো সম্পর্ক নেই। কাচের গ্লাস ভর্তি পানিতে একটি লোহার রড রেখে পাশ থেকে দেখলে রডটি বাঁকা মনে হবে। তোমার পঞ্চইন্দ্রিয় এবং তোমার চেতনা তোমাকে মিথ্যা খবর দিচ্ছে।…তুমি তো জানো আমি তোমার মতোই ঈশ্বরে বিশ্বাস করি।… তুমি এবং আমি না জন্মালেও ঈশ্বর সত্য এবং সুন্দর হতেন।
নিউটন : সত্য এবং সুন্দর! দুটি অর্থহীন শব্দ। যা মাপা যায় না তার কোনো অর্থ নেই। এখানে আলোর প্রতিফলন এবং প্রতিসরণের কারণেই রডটিকে বাঁকা লাগছে। সবকিছু মেপে বুঝিয়ে দেওয়া যায় যে রডটি বাঁকেনি।… তোমাদের দুজনের মতো আমিও ঈশ্বর বিশ্বাসীর দলে, তবে বিজ্ঞানের জগতে বিশ্বাস শব্দটিকে টেনে না আনাই ভালো। আমার প্রিন্সিপিয়া বইটিতে ঈশ্বর শব্দটি ব্যবহার করার প্রয়োজন একবারও হয়নি।
বোর : চিরন্তন সত্য এবং সুন্দর বলতে কিছুই নেই।…
প্লেটো : ধরা যাক এক গুহার ভেতর এক ধরনের প্রাণী বাস করে। জন্ম থেকে ওরা ওখানেই বন্দি হয়ে আছে। সূর্যের আলোয় গুহার গায়ে ওদের ছায়া পড়ে। গুহার বাইরে তাকানো বারণ। ওই ছায়া দেখেই ওরা সূর্যের সত্যিটা জানতে চায়। এ অভিশপ্ত প্রাণীদের নাম মানুষ। বিজ্ঞানীদের দল এবং ওদের যন্ত্রপাতির সাধ্য নেই গুহার বাইরের সত্য খবর সংগ্রহ করার।
লেখক : তোমাদের লেখা পড়ে জীবনের সিংহভাগ পার করেছি। মূর্খ লোকেরও চেঁচানোর অধিকার আছে। সেই অধিকারে এ যুগের হালচাল কিছু শোনাই। ১৯৬০ সালের দিকে লেসার আলো আবিষ্কারের পর আইনস্টাইনের কোয়ান্টাম বাস্তবতার এক্সপেরিমেন্টগুলো সহেজই করা গেছে। কোয়ান্টাম জড়াজড়ি (quantum entanglement) একেবারে সত্যি ঘটনা। প্লেটোর গুহায় বন্দি হয়েও আমি বাইরের জগতের সঙ্গে যুক্ত।…”
আত্মাকে চেনার উপলব্ধি থেকে সৃষ্টি হয়েছে দর্শন, সাহিত্য, বিজ্ঞান। আরও একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এ উপলব্ধি থেকে বিকাশ লাভ করেছে, আর তা হলো ধর্ম। তবে দুর্ভাগ্যবশত ধর্ম আর বিজ্ঞান চিরকালই উল্টো স্রোতে প্রবাহিত হয়েছে। কিন্তু তাতে বেচারা ধর্ম বা বিজ্ঞান কাউকেই দোষ দেওয়া যায় না। কারণ ধর্ম মোড়লরা বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রার পথে যতটা বাধা দিতে সক্ষম হয়েছে ততটা বোধহয় আর কেউ পারেনি। তাই ধর্ম আর বিজ্ঞানের বন্ধুত্বও হয়তো কখনোই হয়নি। ধর্ম মোড়লদের অন্ধত্ব আর স্বার্থপরতার বলি হতে হয়েছে অনেক প্রতিভাময় বিজ্ঞানীদের। ‘কাল্পনিক বিতর্ক’ বইটিতে লেখক বিজ্ঞানীদের নিজের মুখ দিয়ে বলিয়ে নিয়েছেন তাদের দুর্দশার ইতিহাস। গ্যালিলিও বলছেন, ‘মনে পড়ছে অনেকদিন আগে এক রোববার গির্জায় গিয়েছিলাম। আমি তখন পাডুয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। পাদরি সাহেব ভাষণ দিচ্ছিলেন, স্বর্গে যাওয়ার উপায় বাতলে দিচ্ছিলেন, খুব ভালো ভালো সব কথা। সেটাইতো ভালো, ‘The Bible shows the way to go to
heaven, not the way the heavens go.’। ধর্মের চাঁইরা দ্বিতীয় দায়িত্ব ঘাড়ে নিলেই যত গণ্ডগোল বাধে! ‘আমি খেপে যাই যখন ধর্মপুস্তকের দোহাই দিয়ে ওরা বিজ্ঞানের গলায় ফাঁস লাগাতে চায়, অথচ নিজেরা যুক্তিতর্কের ঊর্ধ্বে বসে থাকে’। ‘উল্লেখ্য, গ্যালিলিওকে জীবনের শেষ দশ বছর কারাগারে বন্দি হয়ে কাটাতে হয়েছে এ কথা বলার অপরাধে যে পৃথিবী সূর্যের চারদিকে ঘোরে। শুধু গ্যালিলিও নয়, ধর্মের চাঁইদের সঙ্গে লড়াইয়ে পরাজিত হয়ে ব্রুনোকে আগুনে পুড়ে মরতে হয়, যিনি ছিলেন একাধারে কবি, দার্শনিক এবং জ্যোতির্বিজ্ঞানী। আরেক জ্যোতির্বিজ্ঞানী হাইপেশিয়াকে বিবস্ত্র করে পাথর ছুড়ে হত্যা করা হয়, বিজ্ঞানী কেপলারের মাকে ডাইনি অপবাদ দিয়ে করা হয় কারারুদ্ধ। এখন দিন বদলেছে, তবে ধর্মের মোড়লরা এখনো থামেনি, শুধু দায়িত্বটুকু হাতবদল হয়েছে।
ওমর খৈয়ামকে উদ্দেশ করে লেখক বলছেন, “খৈয়াম, মুসলমানদের স্বর্ণযুগ শেষ হয়ে গেছে,‘ওরা এখন বিবি তালাকের ফতোয়া খোঁজে কুরআন কেতাব পড়ি।’
তোমাদের সময় ছিল খ্রিষ্টানদের অন্ধকার যুগ, এখন চলছে মুসলমানদের অন্ধকার যুগ। অন্ধকার যুগের খ্রিষ্টানরা জ্ঞানী লোকদের খুন করত, স্বাধীনচেতা মেয়েদের ডাইনি বলে পুড়িয়ে মারত, এখন মুসলমানরা ওইসব কাজের ভার নিয়েছে!” কিন্তু সত্য তো লুকিয়ে থাকে না, বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রাও থামেনি। বইয়ের প্রথম অধ্যায়েই ডেমোক্রিটাস প্লেটোকে তাচ্ছিল্য করে বলছেন, ‘যত খুশি হেসে নাও। ভবিষ্যৎই বলে দেবে কে শেষ হাসি হাসবে, তুমি না আমি!’
গ্রিক দার্শনিক এবং বিজ্ঞানী ডেমোক্রিটাসকে বলা হয় পরমাণু তত্ত্বের জন্মদাতা। অপরদিকে প্লেটোও ছিলেন একাধারে দার্শনিক ও বিজ্ঞানী। তবে দর্শনশাস্ত্রের এ মহারথী বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে যা যা ধারণা দিয়েছেন, দুর্ভাগ্যবশত তার প্রায় সবই ছিল ভুল। ডেমোক্রিটাস, প্লেটোর যুগ পেরিয়ে গেছে দুই হাজার বছরেরও বেশি সময় হয়েছে। প্রশ্ন কি তবু ফুরায়? মানুষ আরও কতদূর যাবে কে জানে… তাই লেখক যখন প্রশ্ন করলেন-‘তোমরা এতগুলো পণ্ডিত এখানে জড়ো হয়েছ, কেউ কি আমাকে বোঝাতে পার ইলেকট্রনের চক্কর কী?’ বিজ্ঞানী ডিরাক তখন উত্তর দিলেন-‘আমার সমীকরণে এই চক্কর কোথা থেকে এসে জুড়ে বসেছে, ল্যাবে ওটাকে মাপা গেছে। দেখো হে ছোকরা, বেশি প্রশ্ন করো না। মুখ বন্ধ করে অঙ্ক করতে থাকো!’
মুখ কি তবু বন্ধ হয়? চন্দ্রবিজয়ের গল্প এখন পুরোনো হয়ে গেছে, দৃষ্টি এখন শুধু কোটি কোটি আলোকবর্ষ দূরের গ্যালাক্সিতে থেমে নেই, মানুষের অবিনশ্বর কৌতূহলী সত্ত্বা হয়তো একদিন পেয়ে যাবে এক মহাবিশ্ব পেরিয়ে অন্য এক মহাবিশ্বের সন্ধান। বিজ্ঞান, দর্শন, সাহিত্যের প্রতি যাদের আগ্রহ আছে তাদের জন্য সংগ্রহে রাখার মতো একটি চমৎকার বই, সংগ্রহমূল্য ৩৩৫ টাকা।
কাল্পনিক বিতর্ক
বিজ্ঞান-দর্শন-সাহিত্য। লেখক খন্দকার রেজাউল করিম
প্রচ্ছদ দেওয়ান আতিকুর রহমান
প্রকাশক সৃজন, পরিবেশক ঐতিহ্য