Friday, June 9, 2023
spot_img
Homeধর্মকারাগারে কালজয়ী ইসলামী গ্রন্থের রচয়িতা

কারাগারে কালজয়ী ইসলামী গ্রন্থের রচয়িতা

মুসলিম মনীষা

আল্লাহ তাআলা এ পৃথিবীতে এমন কিছু মানুষ পাঠিয়েছেন, যাঁরা কৃতির মাধ্যমে যুগ যুগ ধরে বেঁচে আছেন মানুষের মণিকোঠায়। যাঁরা কারাগারের চার দেয়ালে বন্দি থেকেও উম্মতের জন্য এমন কিছু কাজ করেছেন, যার থেকে উপকৃত হচ্ছে জগতের হাজারো মানুষ। তেমনি প্রসিদ্ধ চার মনীষী নিয়ে নিচের এ লেখা।

ইমাম সারাখসি (রহ.)

(১০০৯-১০৯০)

শামসুল আইম্মা শামসুদ্দিন আবু বকর মুহাম্মাদ বিন আহমদ সারাখসি।

হানাফি মাজহাবের ইমামদের মধ্য থেকে অন্যতম একজন ছিলেন তিনি। তিনি হিজরি পঞ্চম শতাব্দীর সেই সব আলেমের অন্যতম যাঁদের আল্লাহ তাআলার নিদর্শনাবলির অন্যতম নিদর্শন বলা যায়। তৎকালীন শাসক তাঁকে কোনো সত্য কথা বলার অপরাধে কঠিন পরীক্ষায় ফেলেছিল। বাদশা তাঁকে অন্ধকার কূপে বন্দি করে। ফলে দীর্ঘ সময় কূপের মতো একটি গর্তে তাঁকে বন্দিজীবন কাটাতে হয়েছে। আর সেখানে বসেই তিনি তাঁর সুপ্রসিদ্ধ গ্রন্থ ‘আল-মাবসুত’ রচনা করেন। অথচ সাহায্য নেওয়ার জন্য তাঁর কাছে অন্য কোনো কিতাব ছিল না। তাঁর শিষ্যরা কূপের আশপাশে থেকে রচনাবলির কাজ চালিয়ে যেতেন। তিনি যে শিষ্যদের গ্রন্থনা করাতেন তা ছিল একান্তই তাঁর স্মৃতিনির্ভর। আর এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে একটি কূপের মধ্যে বন্দি অবস্থায় অন্যান্য কিতাবপত্রের সাহায্য নেওয়া সম্ভব ছিল না। ১৫ খণ্ডের আল-মাবসুত কিতাব তিনি কারাগারে বসেই রচনা করেন। তাঁর রচনা তাঁর শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করে।  যাঁরা মাবসুত পড়েছেন তাঁরাই এই কালজয়ী রচনা সম্পর্কে যথাযথ উপলব্ধি করতে পেরেছেন। এত গবেষণালব্ধ ও শক্তিমান রচনা, যা পরবর্তী সময়ে হানাফি ফিকহের নির্ভরযোগ্য উৎস হিসেবে সবার কাছে সমাদৃত হয়েছে। (আল-মাবসুত-এর ভূমিকা, ৪/১৯২)

আজ সেখানে সেই গর্ত নেই, কূপের নিশানাও নেই, যেখানে তিনি বছরের পর বছর বন্দিজীবন যাপন করেছেন। যে শাসক এমন পূতপবিত্র একজন ব্যক্তিকে অন্যায়ভাবে শাস্তি দিয়েছিল তার কোনো নাম-নিশান নেই। কিন্তু ইমাম সারাখসি (রহ.)-এর নাম আজও বেঁচে আছে, তিনি অমর হয়ে আছেন কোটি মানুষের হৃদয়ে। কিয়ামত পর্যন্ত মানুষ তাঁর প্রশংসা করে যাবে, তাঁর জন্য মানুষ রহমতের দোয়া করে যাবে।

শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া

(১২৬৩-১৩২৮)

ইসলামের ইতিহাসে প্রতি শতাব্দীতে মুসলিম বিশ্বে এমন কিছু মনীষীর আগমন ঘটেছে যাঁরা প্রতিকূল অবস্থার সঙ্গে লড়ে দাওয়াত ও সংস্কারকাজ করেছেন। এরই ধারাবাহিতায় অষ্টম হিজরিতে মুসলিম ইতিহাসে সংস্কার, বিপ্লবের নেতৃত্ব দিয়েছেন শায়খুল ইসলাম ইমাম তাকিউদ্দিন আহমদ ইবনে তাইমিয়া (রহ.)। যাঁকে এই উম্মতের শ্রেষ্ঠ মেধাবী বলা হয়। যিনি একাধারে সব বিষয়ের পাণ্ডিত্য অর্জন করেছেন। ইমাম ইবন তাইমিয়া (রহ.) পারিবারিকভাবেই মেধাবী ছিলেন। যোগ্যতা আর দ্বিনের বুঝ নিজের পরিবার থেকেই অর্জন করেছেন। ইতিহাসের পাতায় সেরা গুণীজনদের মধ্যে এক অনন্য নাম ইবনে তাইমিয়া। জ্ঞান ও মেধায় তিনি ছিলেন প্রবাদতুল্য। যিনি সারা জীবন কোরআন বোঝার পেছনে নিজের জীবনকে বিলীন করে দিয়েছেন। কোরআনের জন্য নিবেদিত এই ইমাম তৎকালীন সরকারের রোষানলে পড়েন। তাই জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সময় কাটাতে হয় কারাগারে। তিনি তাঁর অনেক রচনা কারাবন্দি অবস্থায় লিখেছেন। নিঃসন্দেহে তাঁর এই কাজ ছিল আমাদের জন্য বিশাল নিয়ামতস্বরূপ। কারাগারের চার দেয়ালে বসে অসংখ্যবার তিনি কোরআন খতম করেছেন। জীবনের সেই অন্তিম মুহূর্তে কোরআন তিলাওয়াত অবস্থায় আল্লাহর ডাকে সাড়া দিয়ে চলে যান। (আল-উকুদুদ দুররিয়্যাহ : ২৬)

সাইয়েদ কুতুব

(১৯০৬-১৯৬৬)

মিসরের বিখ্যাত আলেম সাইয়েদ কুতুব। সাহিত্যিকদের মধ্যে তিনি ছিলেন অন্যতম। বিশেষ করে শিশুসাহিত্যে হাত ছিল ঈর্ষণীয়। জীবনের সূচনা শিশুসাহিত্য দিয়ে। শিশুদের জন্য আকর্ষণীয় বিষয় নবীদের কাহিনি লিখে প্রতিভার স্বাক্ষর রাখেন। ছোটদের মনে ইসলামের বীজ জাগিয়ে তোলার জন্য তিনি অনন্য কিছু গল্প লেখেন। সরকারের নানা অপরাধের জাঁতাকলে পিষ্ট হয়ে তিনি দীর্ঘকাল কারাবরণ করেন। আর এই কারাবরণের সময় তিনি তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ তাফসিরে জিলালুল কোরআন রচনা করেন। আট খণ্ডে রচিত এক অনবদ্য জ্ঞানের সাগর। মনের মাধুরী মিশিয়ে কোরআন তিলাওয়াতের সময় মনের মধ্যে যেসব ভাব উদয় হয়েছে, তিনি তা কাগজের বুকে অঙ্কিত করেছেন। প্রতিটি আয়াতের মূল্যবান মণি-মুক্তাকে তিনি আমাদের সামনে রেখে গেছেন। (সাইয়েদ কুতুব মিনাল মিলাদ ইলাল ইসতেশহাদ : ৫৪৪)

শায়েখ নাসিরুদ্দিন আলবানি

(১৯১৪-১৯৯৯)

তিনি ছিলেন বিগত শতাব্দীর আরববিশ্বের প্রসিদ্ধ আলেম। জীবনের শুরুতেই তাঁর বংশের লোকেরা ইউরোপের মুসলিম অধ্যুষিত শহর আলবেনিয়া থেকে হিজরত করে শামের দামেস্কে বসবাস শুরু করেন। ব্যক্তিগত পড়াশোনার ভিত্তিতে সেখানেই তাঁর ইলমি ব্যক্তিত্ব গঠিত হয়। তাঁর বিশেষ শাস্ত্র ছিল ‘ইলমে হাদিস’। যৌবনের প্রারম্ভেই এই শাস্ত্রের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক হয় এবং মৃত্যু অবধি এতেই নিমগ্ন থাকেন। নিজের কিছু বিচ্ছিন্ন মতামতের কারণে শায়েখ সমকালীন আহলে ইলমের কাছে সমালোচিত হয়েছেন। ১৯৬৯ সালে তিনি কারাগারে বন্দি হন। সেখানে বসে রাত-দিনের অনবরত চেষ্টায় মাত্র তিন মাসে মুখতাসারু সহিহ মুসলিম লেখেন। (মুকদ্দামায়ে মুখতাসার সহিহ বুখারি, পৃষ্ঠা : ১২)

RELATED ARTICLES
- Advertisment -
Google search engine

Most Popular

Recent Comments