মানুষের দৈনন্দিন জীবনে কাগজ অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। আধুনিক সভ্যতার বিকাশে যার ভূমিকা অপরিসীম। ধারণা করা হয়, চীনে সর্বপ্রথম কাগজের উৎপাদন শুরু হয়। তবে মুসলিমদের হাতেই সূচনা হয় আধুনিক কাগজশিল্পের।
প্রায় ১১ শ বছর আগে বাগদাদে কাগজ উৎপাদন শুরু হলে তা সর্বসাধারণের নাগালে আসে এবং কাগজের বহুল ব্যবহার শুরু হয়। মুসলিমরাই আফ্রিকা ও ইউরোপ মহাদেশের মানুষকে কাগজের ব্যবহার শিখিয়েছে।
মুসলিম বিশ্বে কাগজ : ৭৫১ খ্রিস্টাব্দে চীনের হান রাজার সঙ্গে আব্বাসীয় খলিফার যুদ্ধ হয়। ‘তালাস’ নামক নদীর পারে তা সংঘটিত হওয়ায় তাকে তালাসের যুদ্ধ বলা হয়। এই যুদ্ধে চীনা বন্দিদের মধ্যে দুজন দক্ষ কাগজের কারিগর ছিল। যাদের মাধ্যমে মুসলিমরা কাগজ তৈরির প্রক্রিয়া জানতে পারে।
কাগজের ব্যবহার : চীনাদের কাছ থেকে কাগজ উৎপাদনের প্রক্রিয়া জানার পর মুসলিমরা কাগজের উৎপাদন ও তার মানোন্নয়নে মনোযোগ দেয়। আব্বাসীয় খলিফা আল-মানসুর (৭৫৪-৭৭৫ খ্রি.) সর্বপ্রথম রাষ্ট্রের সব আমলাতান্ত্রিক কাজে কাগজ ব্যবহারের নির্দেশ দেন। খলিফা হারুনুর রশিদের সময় ৭৯৪ খ্রিস্টাব্দে বাগদাদে মতান্তরে সমরকান্দে মুসলিম বিশ্বের প্রথম কাগজের কল প্রতিষ্ঠিত হয়। হারুনুর রশিদ তাঁর প্রধানমন্ত্রী ফজল ইবনে ইয়াহইয়াকে এই দায়িত্ব অর্পণ করেন। এটা ছিল চীনের বাইরে প্রথম কোনো কাগজ কল। এরপর ধীরে ধীরে দামেস্ক, ত্রিপলি, কায়রো, কর্ডোভা, হামা, মানবিজসহ অন্যান্য শহরেও কাগজের কল প্রতিষ্ঠিত হয়।
ইউরোপ ও আফ্রিকায় কাগজ : মিসরের মুসলিম শাসকরা ৮৫০ খ্রিস্টাব্দে কায়রোতে আফ্রিকার প্রথম কাগজ কল প্রতিষ্ঠা করেন এবং ৯৫০ খ্রিস্টাব্দে মুসলিম স্পেনে প্রতিষ্ঠিত কাগজ কলটিও ছিল ইউরোপের মাটিতে প্রথম কাগজ কল। প্রকৃতপক্ষে দ্বাদশ শতাব্দীর আগে ইউরোপে কাগজে লেখা কোনো বইয়ের অস্তিত্ব পাওয়া যায় না। একাদশ শতকে ইউরোপে প্রথম কাগজের ব্যবহারের প্রমাণ পাওয়া যায়। দীর্ঘদিন পর্যন্ত ইউরোপে কাগজ পরিচিত ছিল চার্টা ডেমাস্কেনা (ঈযধত্ঃধ উধসধংপবহধ), যার অর্থ দামেস্কের কাগজ।
প্রথম ক্রুসেডে (১০৯৬-১০৯৯ খ্রি.) মুসলিমদের পরাজিত করে জেরুজালেম দখল করার পর ইউরোপীয়রা প্রথম কাগজ কল ব্যবহারের সুযোগ পায়। তবে ১২৪৪ খ্রিস্টাব্দে স্পেনের ইয়াতিভা দখল করলে সেখানে থাকা কাগজের কলটির পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ পায় এবং মুসলমান কারিগরদের কাছ থেকে কাগজ তৈরির কৌশল রপ্ত করে। এ ছাড়া ইতালির সিসিলি মুসলিমদের হাতছাড়া হলে সেখানে স্থাপিত কাগজের কলটি থেকেও ইতালিয়ানরা কাগজ নির্মাণের কৌশল রপ্ত করে।
সেরা কাগজের উৎস : দশম খ্রিস্টাব্দে রচিত ‘হুদুদুল আলম’ নামক গ্রন্থে কাগজ উৎপাদনে সমরকান্দের শ্রেষ্ঠত্ব দাবি করা হয়েছে। লেখকের মতে, সমকালীন মুসলিম বিশ্বের সবচেয়ে উন্নত কাগজ সমরকান্দে উৎপাদিত হতো এবং সেখান থেকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হতো। কাগজ উৎপাদনে সমরকান্দের পর ছিল দামেস্কের স্থান। ইউরোপের কাগজের প্রধান উৎস ছিল দামেস্ক।
জ্ঞানচর্চায় কাগজ : বাগদাদে কাগজ উৎপাদন শুরু হওয়ার আগে মুসলিম বিশ্বে জ্ঞানচর্চায় ‘পার্চমেন্ট’ (চামড়া থেকে তৈরি কাগজবিশেষ) ছিল জ্ঞানচর্চা ও গ্রন্থ রচনার প্রধান অবলম্বন। অবশ্য প্রাচীন গ্রিক ও মিসরীয় সভ্যতায় ‘প্যাপিরাসের’ ব্যবহার ছিল। বাগদাদে কাগজ কল স্থাপিত হওয়ার পর জ্ঞানচর্চায় কাগজের ব্যাপক ব্যবহার শুরু হয়। আল্লামা ইবনে খালদুন বলেন, অষ্টম খ্রিস্টাব্দে জ্ঞানচর্চায় পার্চমেন্টের ব্যবহার বিরল হয়ে যায়। মুসলিমরাই প্রথম কাগজের তৈরি, মলাট বিশিষ্ট ও এক পাশে বাঁধাই করা বই উৎপাদন শুরু করে। ৫০০ পৃষ্ঠার কাগজের সমষ্টিকে যে ‘রিম’ বলা হয় তা-ও আরবি ‘রিজমা’ শব্দ থেকে এসেছে। সাধারণ বই-পুস্তকের মতো পবিত্র কোরআন ও হাদিস গ্রন্থও কাগজে লেখা হতো। এখন পর্যন্ত আবিষ্কৃত কোরআনের সর্বপ্রাচীন কাগজের অনুলিপিটি ৯৭১ খ্রিস্টাব্দে আলী ইবনে সাদান আল-রাজি প্রস্তুত করেন ।
তথ্যঋণ : মুসলিম হেরিটেজ, ১০০১ ইনভেনশনস, রোর মিডিয়া (বাংলা) ও উইকিপিডিয়া