Friday, April 19, 2024
spot_img
Homeধর্মকর্মক্ষেত্রে যথাযথ দায়িত্বপালনে আল্লাহর সন্তুষ্টি

কর্মক্ষেত্রে যথাযথ দায়িত্বপালনে আল্লাহর সন্তুষ্টি

শরিয়তের অন্যতম লক্ষ্য হচ্ছে, জগৎকে এমনভাবে আবাদ করা যা সমাজ ও ব্যক্তিজীবনে সামগ্রিকভাবে মানুষের কল্যাণ বয়ে আনে। নিজের ও সবার মঙ্গল সাধিত হয় এবং সবার ওপর থেকে ফেতনা ও ব্যাপক অকল্যাণ প্রতিহত করা যায়। তাই সামাজিক কল্যাণ ও ব্যক্তিগত জীবনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কিছু দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে স্মরণ করিয়ে দেওয়া জরুরি। এই দায়িত্ব-কর্তব্যগুলো সেই ব্যক্তিদের যারা সমাজের কল্যাণ সাধনের উদ্দেশ্যে সরকারি-বেসরকারি দায়িত্বে নিয়োজিত। কেননা এসব দায়িত্বে ত্রুটি-বিচ্যুতি উন্নতি, অগ্রগতি ও উৎকর্ষের পথে বড় প্রতিবন্ধক।

সরকারি-বেসরকারি প্রত্যেক কর্মচারীর জন্য আবশ্যক হলো, সে আল্লাহর সামনে জবাবদিহির কথা অনুধাবন করবে এবং মনে রাখবে, আল্লাহতায়ালা, শাসক ও সমাজের পক্ষে সে বড় আমানতের দায়িত্ব গ্রহণ করেছে। হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘তোমাদের প্রত্যেকেই দায়িত্বশীল, আর প্রত্যেকেই তার দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে।’ -সহিহ বোখারি

সুতরাং হে চাকরিজীবী! মহান আল্লাহর সামনে আপনার অবস্থানের কথা স্মরণ করুন এবং মুসলিমদের ব্যাপারে আল্লাহকে ভয় করুন। জেনে রাখুন! পদ-পদবির মজার সঙ্গে বিরাট ক্ষতিও সংশ্লিষ্ট, যা হজরত আবু জার (রা.)-এর প্রশ্নের পরিপ্রেক্ষিতে নবী কারিম (সা.) আমাদের স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। তিনি হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে বলেছিলেন, ‘আপনি কি আমাকে কোনো পদে নিয়োজিত করবেন না? অর্থাৎ আমাকে প্রশাসক নিয়োগ করবেন না। তখন রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, হে আবু জার! তুমি দুর্বল, আর এটি একটি আমানত। কেয়ামতের দিন তা লাঞ্ছনা ও অনুশোচনার কারণ হবে। তবে যে এটি যথাযথভাবে গ্রহণ করবে এবং তার হক সম্পূর্ণরূপে আদায় করবে তার কথা ভিন্ন।’ -সহিহ মুসলিম

জনগণের জন্য কল্যাণকর প্রকল্প ও পরিকল্পনা উত্তম পন্থায় ও পরিপূর্ণভাবে বাস্তবায়নের দায়িত্ব পালন করা প্রত্যেক দায়িত্বশীলের আমানত। দেশের সর্বোচ্চ ব্যক্তি থেকে নিম্ন পর্যায়ের দায়িত্বশীলদের এটা পালন করতে হবে। সর্বাবস্থায় বিশ্বাসঘাতকতা থেকে মুক্ত থাকা কর্তব্য। আমানত আদায়ের নির্দেশ ও আমানতের বিষয়ে উদাসীনতার ভয়াবহতা সম্পর্কে কোরআন-হাদিসে অসংখ্য দলিল রয়েছে। সুতরাং হে দায়িত্বশীলরা! আপনারা আল্লাহর কাছে জিজ্ঞাসিত হবেন। আপনারা চুক্তি সম্পাদন, টেন্ডার আহ্বান ও প্রকল্প সম্পর্কে আমানতদার। এ আমানত রক্ষায় ব্যক্তিগত স্বার্থরক্ষার জন্য কোনো ধরনের অনিয়মের পরিণতি অত্যন্ত ভয়ংকর। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী করিম (সা.) বলেছেন, ‘নিশ্চয় তোমরা নেতৃত্বের লোভ করো, অথচ কিয়ামতের দিন তা অনুতাপের কারণ হবে। কেননা তা কত উত্তম দুগ্ধদায়িনী এবং কত মন্দ দুগ্ধপানে বাধাদানকারিনী অর্থাৎ এর প্রথম দিক দুগ্ধদানের মতো তৃপ্তিকর, আর পরিণাম দুধ ছাড়ানোর মতো বেদনাদায়ক হয়।’ -সহিহ বোখারি

ঘুষের লেনদেনে জড়িত হওয়া বিরাট ক্ষতি ও মহাবিপর্যয়ের কারণ। এটা নিকৃষ্টতম অপরাধ, যা সত্যকে মিথ্যা ও মিথ্যাকে সত্যে পরিণত করে এবং দায়িত্বশীলকে জনগণের কল্যাণের বিপরীতে ঘুষদাতার খারাপ লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে প্ররোচিত করে। এটা সেই হারাম যা গ্রহণ ও তাতে জড়িত হওয়ার জন্য আল্লাহতায়ালা বনি ইসরাঈলকে তিরস্কার করেছেন। ঘুষ বান্দার ওপর অভিশাপের কারণ। হজরত আবদুল্লাহ বিন আমর (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী কারিম (সা.) বলেছেন, ‘আল্লাহতায়ালা ঘুষদাতা ও ঘুষ গ্রহীতা উভয়কেই অভিসম্পাত করেছেন।’ -সুনানে আবু দাউদ

অন্য একটি হাদিস যা ইবনে জারির বর্ণনা করেছেন তাতে এসেছে, ‘সুহুত (তথা হারাম) থেকে উৎপাদিত প্রতিটি মাংসপিন্ডের জন্য জাহান্নাম অধিক উপযুক্ত। জিজ্ঞেস করা হলো, সুহুত কী? তিনি বললেন, বিচারের ক্ষেত্রে ঘুষের আদান-প্রদান।’ প্রতিটি কর্মের ক্ষেত্রে ঘুষের আদান-প্রদান এই অর্থের অন্তর্গত। শরিয়তের দৃষ্টিকোণ ও স্বীকৃত নীতি অনুযায়ী ঘুষের অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে যে ব্যক্তি তার পেশাগত দায়িত্ব পালন করে না সেবা প্রত্যাশীদের কাছ থেকে অর্থ গ্রহণ ছাড়া, অথবা সে তা গ্রহণ করে তার পেশাগত দায়িত্বে ত্রুটির লক্ষ্যে। ঘুষ শুধু অর্থ গ্রহণের সঙ্গে সম্পর্কিত নয় বরং তা অন্তর্ভুক্ত করে প্রত্যেক লাভ এবং সুবিধাকে যা ঘুষগ্রহীতা পেশাগত দায়িত্বে ত্রুটি করার লক্ষ্যে গ্রহণ করে থাকে। ঘুষের অন্তর্গত হলো, কর্মকর্তা কর্র্তৃক কোনো ব্যক্তির অধিকার বঞ্চিত করা এবং কোনো কাজের অবৈধ অনুমোদন প্রদান। প্রত্যেক দায়িত্বশীল ব্যক্তি, সমাজের প্রতিটি সদস্য এবং সংবাদ মাধ্যমের ওপর কর্তব্য হলো ঘুষের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিকে চিহ্নিত করে তাদের মুখোশ উন্মোচন করা এবং দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির মাধ্যমে এ ঘৃণ্য অপরাধকে মোকাবিলা করা।

ওই সমাজের ওপর দুর্ভোগ, যে সমাজের সদস্যরা একে অন্যকে ঘুষের বিষয়ে নিষেধ করে না এবং তা প্রতিরোধে ও মূলোৎপাটনে পরস্পরে সহযোগিতা করে না। অথচ হাদিসে ইরশাদ হয়েছে, ‘যে জাতির মধ্যে সুদ ছড়িয়ে পড়বে তারা দুর্ভিক্ষ ও অভাব-অনটনে পতিত হবে। আর যে জাতির মধ্যে ঘুষের ব্যাপক প্রচলন শুরু হবে তারা ভয়ভীতিতে আক্রান্ত হবে।’

মহাঅপরাধ এবং সুস্পষ্ট অন্যায় হলো স্বার্থসিদ্ধির জন্য পদ-পদবির অপব্যবহার ও জনগণের সম্পদ আত্মসাৎ করা। মহান রব বলেন, ‘কেউ অন্যায়ভাবে কিছু গোপন করলে, যা সে অন্যায়ভাবে গোপন করবে কেয়ামতের দিন সে তা সঙ্গে নিয়ে আসবে।’ -সুরা আলে-ইমরান : ১৬১

নবী কারিম (সা.) বলেছেন, ‘আমি যাকে যে কাজের জন্য নিয়োগ করব এবং তার জন্য যে বেতন নির্ধারণ করব, এর অতিরিক্ত যদি সে কিছু গ্রহণ করে; তবে তা আত্মসাৎরূপে গণ্য হবে।’ -সুনানে আবু দাউদ

সব কর্মকর্তা-কর্মচারীর ওপর আবশ্যক হলো তারা সততার পথ অবলম্বন করবে, জনগণের ওপর কোনো কাজ অহেতুক কঠিন করে চাপিয়ে দেবে না এবং সমাজের কল্যাণ সাধনের লক্ষ্যে শাসকের তরফ থেকে নির্ধারিত নিয়মানুসারে তাদের কাজগুলোকে সহজ করবে। হজরত আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে আমার এ ঘরে বলতে শুনেছি, ‘হে আল্লাহ! যে আমার উম্মতের কোনোরূপ কর্র্তৃত্বভার লাভ করে এবং তাদের প্রতি রূঢ় আচরণ করে তুমি তার প্রতি রূঢ় হও, আর যে আমার উম্মতের ওপর কোনোরূপ কর্র্তৃত্বভার লাভ করে তাদের প্রতি নম্র আচরণ করে তুমি তার প্রতি নম্র ও সদয় হও।’ -সহিহ মুসলিম

সরকারি-বেসরকারি প্রকল্প, অফিস-আদালত থেকে শুরু করে যে যে পর্যায়ের দায়িত্বশীল, আপনারা আল্লাহর কাছে প্রতিটি দায়িত্বপ্রাপ্ত কাজের জন্য জিজ্ঞাসিত হবেন। এমন একদিন আসবে যেদিন আপনারা দায়িত্বে অবহেলার জন্য লজ্জিত হবেন। পাবলিক প্রকল্প বাস্তবায়নে ধীরগতি অবলম্বন করা, জনগণের স্বার্থসংশ্লিষ্ট ও জীবনযাত্রার জন্য কল্যাণকর প্রকল্প হস্তান্তরে বিলম্ব করা, অফিসের ফাইল অযথা আটকে রাখা, নানাভাবে দায়িত্বপালনে অবহেলা, ফাঁকি এবং ইচ্ছাকৃতভাবে কাজে জটিলতা সৃষ্টি মহাঅন্যায়। নবী কারিম (সা.) বলেছেন, ‘যে আমাদের ধোঁকা দেয় সে আমার দলভুক্ত নয়।’ -সহিহ মুসলিম

সরকারের পক্ষ থেকে বিভিন্ন নজরদারি সংস্থার দায়িত্বশীল কর্তাদের ওপর অবশ্য কর্তব্য ও ওয়াজিব হলো আল্লাহকে ভয় এবং ছোট-বড় সব বিষয় নজরদারি করা। অনুরূপভাবে প্রত্যেক প্রকল্পের দায়িত্বশীলদের ছোট-বড় সব বিষয়ে যথাযথ জবাবদিহির আওতায় রাখা, অনুসন্ধান ও জিজ্ঞাসাবাদের ভিত্তিতে আসল রহস্য উদঘাটন এবং ত্রুটি, বিচ্যুতি ও অপরাধের ধরন নির্ণয়ে প্রচেষ্টা করা। হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) ইবনে লুতবিয়া (রা.)-এর জবাবদিহি গ্রহণ করেন, যখন ইবনে লুতবিয়া (রা.) জাকাত উত্তোলন করে আগমন করেন এবং বলেন এগুলো আপনাদের আর এগুলো আমাকে হাদিয়া দেওয়া হয়েছে। তখন রাসুল (সা.) মিম্বরে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘সে কর্মচারীর কী হলো যাকে আমি নিয়োগ দিয়ে প্রেরণ করলাম, আর সে ফিরে এসে বলে এগুলো আপনাদের, আর এগুলো আমার? সে তার পিতা-মাতার ঘরে বসে থেকে দেখে না কেন যে, তাকে উপঢৌকন দেওয়া হয় কিনা?’ -সহিহ বোখারি

কোনো কোনো বর্ণনায় এসেছে, নবী কারিম (সা.) তাকে জবাবদিহির আওতায় এনেছিলেন। এটাই হলো নবী কারিম (সা.) ও পরবর্তী খোলাফায়ে রাশেদার সুন্নত।

২০ জানুয়ারি শুক্রবার মসজিদে নববিতে প্রদত্ত জুমার খুতবা। অনুবাদ মুহাম্মদ আতিকুর রহমান

RELATED ARTICLES
- Advertisment -
Google search engine

Most Popular

Recent Comments