ড. মো. নূরুল আমিন : আল্লাহর পথে যারা বীর মুজাহিদ, ঈমানদার; তাদের ডাকে আল্লাহ সাড়া দেন। অনেকে কথাটা নিছক অনুমিত ধারণা মনে করলেও বেশিরভাগ মানুষ এর সত্যতা প্রত্যক্ষ করেছেন। ব্যক্তিগতভাবে বাস্তব জীবনে আমি এর প্রমাণ পেয়েছি। তথাপিও অনেকেই এর বৈজ্ঞানিক দিকটি খুঁজে বেড়ান। চীনে মরণব্যাধি করোনাভাইরাস সংক্রমণ নিয়ে কথা উঠেছে। কথা উঠেছে যে, চীন সরকার মুসলমানদের নামাজ-রোজা বন্ধ করে দিয়েছিল, মসজিদে তালা দিয়েছিল, কুরআন শিক্ষা ও তেলাওয়াত নিষিদ্ধ করে দিয়ে কুরআনসহ কতিপয় ধর্মগ্রন্থ সংশোধনের পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিল এবং সর্বোপরি মুসলমানদের উপর চরম অত্যাচার, অবিচার চালাচ্ছিল, সেই চীনের প্রেসিডেন্ট স্বয়ং কেন মুসলমানদের মসজিদে গিয়ে করোনাভাইরাস থেকে মুক্তি পাবার জন্য দোয়ার আহ্বান জানালেন? কেন তিনি মুসলিম পল্লীতে ঘরে ঘরে গিয়ে মুসলিম জীবনাচার প্রত্যক্ষ করে তা অনুসরণের জন্য দেশবাসীকে আহ্বান করলেন? এই কেন’র উত্তর খুঁজতে যে কারণটি পাওয়া গেল সেটা হচ্ছে উইঘুরসহ সারা চীনের মুসলমানদের উপর চীন সরকার ও চীনা নাস্তিক বৌদ্ধদের অমানুষিক নির্যাতন। এর একটি আশু কারণও পাওয়া গেছে, যা করোনা গযবের অযুহাত হিসাবে গণ্য হতে পারে।
উইঘুরের সম্ভ্রান্ত একটি মুসলিম পরিবারে আয়েশা নামে একটি মেয়ে ছিল। মেয়েটি ছিল অত্যন্ত পরহেজগার ও অনিন্দসুন্দরী। ঐ এলাকায় টহল ডিউটিতে নিয়োজিত কিছু চীনা সৈন্যের কুনজর তার উপর পড়ে। তাদের মধ্যে পাঁচজন মেয়েটির সম্ভ্রমহানির সিদ্ধান্ত নেয়। ঘটনার দিন মেয়েটি কুরআন তেলাওয়াত করছিল। এ সময় এই পাঁচজন সৈন্য তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। তাদের তিনজন জোরপূর্বক তাকে ধর্ষণ করে, দু’জন পাহারায় থাকে। মেয়েটির আর্তনাদে আকাশ-পাতাল কেঁপে উঠে। মেয়েটি মৃত্যুবরণ করে। সম্ভবতঃ আল্লাহর গযবও ঐ সময় নেমে আসে। সংশ্লিষ্ট পাঁচজন সৈন্য পর্যায়ক্রমে করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়। প্রথমে তিনজন, পরে দু’জন। তাদের হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। তারা মারা যায় এবং যে ডাক্তার তাদের চিকিৎসা করেছিলেন তিনিও মারা যান। ভাইরাস চিহ্নিত হয় এবং সর্বত্র আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। এই খবরটি আমি একজন আলেমের মুখে শুনেছি। কিন্তু এর সত্যতা যাচাই না করে মন্তব্য করতে ইতস্তত: করছিলাম।
চীনা মুসলমানদের ঈমানের দৃঢ়তা সম্পর্কে আমার কিছু ধারণা ইতোপূর্বে আমার বেইজিং সফর প্রসঙ্গে আলোচনা করতে গিয়ে আমি এই স্তম্ভে উল্লেখ করেছিলাম। তারা অত্যন্ত ভাল মুসলমান এবং সংগ্রাম করেই ঈমানকে টিকিয়ে রাখছেন। বৃটেনের লাফব্যুরো বিশ্ববিদ্যালয়ে সিমেন টাং ও লিউ সাও ঝাং নামে আমার দু’জন চীনা সহপাঠী ছিলেন। তাদের সাথে আমার নিয়মিত যোগাযোগ রয়েছে। আমি বিষয়টির সত্যতা যাচাইয়ের জন্য তাদের শরণাপণ্ন হলাম এবং দুই সপ্তাহ পর তারা আমাকে জানালেন যে, ঘটনাটি সত্য। উল্লেখ্য যে, লাফব্যুরোতে আমরা স্টান্ডফোর্ড হলে থাকতাম এবং একই ডাইনিং হলে খেতাম। আমরা যারা মুসলমান তাদের জন্য একটি হালাল টেবিল নির্ধারিত ছিল। ছয় আসনবিশিষ্ট এই টেবিলে আমরা মুসলমান ছিলাম ৪ জন। বাকি দুই চেয়ারে বিভিন্ন দেশের খৃস্টান বন্ধুরা প্রায়ই বসে আমাদের সাথে খেতেন। একদিন গভীর রাতে টাং এবং লিও ডর্মিটরিতে আমার সাথে সাক্ষাৎ করলেন এবং অত্যন্ত মার্জিতভাবে বললেন যে, পরদিন সকালে তাদের রাষ্ট্রদূত (চীনা রাষ্ট্রদূত) ইউনিভার্সিটিতে আসবেন। সাথে তার স্ত্রী থাকবেন। তারা দু’জনই মুসলমান এবং আমরা যদি হালাল টেবিলে তাদের নাস্তা ও দুপুরের খাবারের অনুমতি দেই তাহলে খুবই খুশি হবেন। আশ্চর্য হলাম তাদের নিষ্ঠা ও একাগ্রতা দেখে। লিউ ও টাং দু’জনই বিষয়টি গোপন রাখতে চেয়েছেন এবং সে জন্য রাতের বেলায় চুপি চুপি এসে তাদের মুসলমান রাষ্ট্রদূত ও তার স্ত্রীর জন্য হালাল টেবিলের দুটি চেয়ার নিশ্চিত করতে অনুরোধ করতে এসেছিলেন। আমার এই দুই বন্ধুর কাছ থেকে মর্মান্তিক ঘটনাটির সত্যতার সার্টিফিকেট পাবার পর আমার আর কোন সন্দেহ রইলো না কেন হঠাৎ করে চীনা প্রেসিডেন্ট মুসলমানদের উপর সদয় হয়ে উঠলেন। কেনই বা তার সরকার মুসলমানদের কাছ থেকে দোয়া প্রার্থনার জন্য মসজিদ ও মুসলিম পাড়ার বাড়ি বাড়ি চারণের মতো ঘুরছেন। আমার বিশ্বাস, আত্মোপলব্ধির এটি একটি পর্যায়, একটা উন্নতি। আল্লাহ যদি চান তাহলে তারা ফিতরাতেও ফিরে যেতে পারেন।
দুনিয়াব্যাপি করোনা ভাইরাসের বিস্তার বেড়েই চলেছে। প্রতিদিন আক্রান্ত ব্যক্তি এবং মৃতের সংখ্যা বাড়ছে। বিভিন্ন দেশের গুরুত্বপূর্ণ নেতা, কর্মকর্তা, ক্রীড়া ও বিনোদন জগতের তারকা প্রমুখসহ রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরাও এতে আক্রান্ত হচ্ছেন এবং মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পসহ অনেকে করোনা সংক্রমণ নিয়ে আতঙ্কের মধ্যে আছেন। কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোর স্ত্রী, স্পেনের রাণী, অস্ট্রেলিয়ার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন এবং এ প্রেক্ষিতে অনেকেই স্বেচ্ছা কোয়ারেনটাইনে আছেন। চেলসির ফুটবলার ও আর্সেনালের ম্যানেজার মাইকেল আটেটা, পর্তুগীজ ফুটবল তারকা ক্রিস্টিয়ানো রোনাল্ডো, অস্কার পুরস্কারপ্রাপ্ত অভিনেতা টম হ্যাংকস, তার স্ত্রী রিতা উইলসনও করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন।
বিশ্বে অনেক নেতা ঘরে বসে দেশ চালাচ্ছেন। সর্বশেষ প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী করোনায় সারা বিশ্বের প্রায় দেড় লাখ লোক আক্রান্ত হয়েছে এবং মারা গেছে ছয় সহস্রাধিক রোগী। আক্রান্ত দেশের সংখ্যা ১৩৫। পরিবেশিত তথ্যানুযায়ী বাংলাদেশে আক্রান্তের সংখ্যা ৫ জন এবং করোনাভাইরাস সংক্রমণ সন্দেহে ২৪ জেলায় প্রায় দুই হাজার লোক হোম কোয়ারেনটাইনে আছেন। বিবিসির প্রতিবেদন অনুযায়ী করোনা আক্রান্ত দেশসমূহ থেকে লাখ লাখ মানুষ বাংলাদেশে ফিরে আসছে কিন্তু তারা কোনও প্রকার পরীক্ষার সম্মুখীন হচ্ছেন না।
এদিকে গত বুধবার বিশ্ব স্বাস্থ্যসংস্থা করোনাকে বৈশ্বিক মহামারী হিসাবে ঘোষণা করেছে। আবার ১৩ মার্চ শুক্রবার তারা ইউরোপকে এই মহামারীর কেন্দ্রস্থল হিসাবে উল্লেখ করে আরেকটি ঘোষণা পত্র জারী করেছে। স্পেনের প্রধানমন্ত্রী দেশব্যাপী জরুরী অবস্থা ঘোষণা করেছেন, করোনার কারণে দুনিয়ার প্রায় সব দেশ স্বাস্থ্যগত ও অর্থনৈতিক ঝুঁকিতে রয়েছে। এর ফলে বৈশ্বিক জিডিপিতে দেড় ট্রিলিয়ন ডলার ক্ষতির আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। করোনার প্রভাবে বাংলাদেশের অনেক রফতানী আদেশ স্থগিত হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের ক্রেতাদের পণ্য না পাঠানোর পরামর্শ পাওয়া গেছে। কেউ কেউ পোশাক তৈরির প্রক্রিয়া আপাতত বন্ধ রাখার অনুরোধ করেছেন। ধর্মীয়, শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে এর প্রভাব অভূতপূর্ব। সওদী আরব, তুরস্ক, মালয়েশিয়া, আরব আমীরাতসহ অনেক মুসলিম দেশে জুমআর নামাজের খুতবা সংক্ষিপ্ত করা হয়েছে এবং যারা মসজিদে না এসে ঘরে নামাজ পড়তে চান তাদের তা করার জন্য উৎসাহিত করা হচ্ছে। আবার কোথাও কোথাও মসজিদের পরিবর্তে খোলা জায়গায় নামাজের জামায়াত অনুষ্ঠিত হচ্ছে। বৃটেনের প্রাচীন পত্রিকা দি গার্ডিয়ানের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্বের হাজার হাজার ধনী ব্যক্তি আগাম পরীক্ষা ও উন্নত চিকিৎসার জন্য ছুটাছুটি করছেন। কেউ কেউ বাংকারেও লুকাচ্ছেন। করোনা রোগীদের কাছ থেকে রোগ সংক্রমণের আশঙ্কায় নিতান্ত আপনজনরাও রোগীদের কাছ থেকে দূরে সরে থাকছেন। রোগীর চিকিৎসা ও পরিচর্যাকারী ডাক্তার-নার্সদের পরিবর্তে রোবট ব্যবহারও শুরু হয়েছে।
মানুষ মৃত্যুকে ভয় পায়। মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচার জন্য মানুষের চেষ্টার সীমা পরিসীমা কখনো ছিল না, এখনো নেই। কিন্তু মৃত্যুকে কেউ রুখতে পারেনি। এই শতাব্দিতে বৈজ্ঞানিক উৎকর্ষের এই পর্যায়ে এসেও মানুষ মৃত্যু নয় শুধু, মৃত্যুর কারণ হতে পারে। আল্লাহর এমন আজাব মহামারীকেও এত ভয় করে, তা বিশ্বাস করা যায় না। এই মহামারী থেকে বাঁচার জন্য যদি তারা সামান্যতম চেষ্টাও করতেন তাহলে এই মহামারীর শিকার হয়ে হয়ত তাদের যন্ত্রণার মৃত্যুর মুখোমুখি হতে হতো না। চীন থেকে করোনা ভাইরাস শুরু হয়েছে। সারা দুনিয়ার আস্তিক-নাস্তিক সবাই এখন স্বীকার করছেন যে, এটি একটি গযব। দুনিয়ার প্রায় সব দেশ এই গযবের উপযোগী হয়ে পড়েছে। প্রতিটি দেশের অবস্থা পর্যালোচনা করে বিশ্লেষকরা যে কারণগুলো চিহ্নিত করেছেন তার মধ্যে রয়েছে :
মানুষের বিশেষ করে রাষ্ট্রসমূহের আল্লাহবিমুখতা, প্রতিটি দেশে বুদ্ধিজীবী এবং রাজনীতিকদের মধ্যে খোদাদ্রোহিতা চরম আকার ধারণ করেছে। বাংলাদেশের মতো একটি মুসলিম দেশে তো প্রকাশ্যে আল্লাহ, তার নবী, রাসুল (দ.)-এর স্ত্রীগণ, সাহাবায়ে কেরাম প্রমুখ অশ্লীল গালাগালির শিকার হচ্ছেন। রাষ্ট্রীয়ভাবে তাদের পৃষ্ঠপোষকতা করার অভিযোগ উঠেছে। কোন কোন দেশে আল্লাহ ও কুরআনের বিচারের নামে কুৎসিত নাটক মঞ্চস্থ করা হচ্ছে। ইসলামপ্রিয় মানুষ যারা আল্লাহর দেয়া বিধান মেনে চলতে চান তাদের বিরুদ্ধে নগ্ন রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস চলছে। জেল, জুলুম, জরিমানা ও বানোয়াট অভিযোগে মিথ্যা সাক্ষ্যের ভিত্তিতে খ্যাতনামা আলেম উলামাদের ফাঁসি দিয়ে হত্যা করা হচ্ছে। অন্ধকার কারাকোষ্ঠে তারা ধুকে ধুকে মরছেন। নির্লজ্জতা ও ব্যভিচার চরম আকার ধারণ করেছে। পারস্পরিক সম্মতিতে ব্যভিচার হচ্ছে। জোর করে নারীদের ধর্ষণ করা হচ্ছে। ৩ বছরের শিশু এবং ৭০ বছরের বৃদ্ধাও ধর্ষকদের হাত থেকে রেহাই পাচ্ছে না। পত্র-পত্রিকা, টিভি চ্যানেলসমূহ অশ্লীলতার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। এমনকি নিকট আত্মীয়দের মধ্যেও অনৈতিক কাজ ছড়িয়ে পড়েছে। মেয়েদের যৌনসামগ্রী হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। হালাল-হারামের অনুভূতি মানুষের মন থেকে উধাও হয়ে গেছে। ঘুষ-রিসওয়াত, চুরি, ডাকাতি, আত্মসাৎ, অন্যের সম্পত্তি জবর দখল, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি সুদ, জুয়া প্রভৃতি সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রবেশ করে সমাজব্যবস্থাকে ধ্বংস করে দিচ্ছে। সমাজের ভাল মানুষরা অসহায় হয়ে পড়েছেন। এই গযবের হাত থেকে বাঁচার পথ একটিই এবং সেটি হচ্ছে আল্লাহর পথে ফিরে আসা। এ ব্যাপারে সৎ লোকদেরই নেতৃত্ব দিতে হবে।