Wednesday, March 22, 2023
spot_img
Homeসাহিত্যকথাসাহিত্যে কালের প্রতিধ্বনি

কথাসাহিত্যে কালের প্রতিধ্বনি

দিলারা হাশেম

বিশিষ্ট কথাশিল্পী দিলারা হাশেম সাহিত্যর সাধনা শুরু করেছিলেন ষাটের দশক থেকে। প্রথম উপন্যাস ঘর মন জানালা প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৬৫ সালে। এবং ঘর মন জানালা এ অঞ্চলের পাঠকেরা বিপুলভাবে গ্রহণ করেছিল। উপন্যাসটি রুশ ভাষায়ও অনূদিত হয়েছিল। সম্ভবত দিলারা হাশেমের ঘর মন জানালা রুশ ভাষায় অনূদিত বাংলাদেশের প্রথম উপন্যাস। এখানেই শেষ নয়, ১৯৭৩ সালে ঘর মন জানালা উপন্যাস অবলম্বনে চলচ্চিত্র নির্মাণ করা হয়েছিল একই নামে। ২০০১ সালে মাওলা ব্রাদার্স থেকে প্রকাশিত উপন্যাস হামেলার ফ্ল্যাপ থেকে জানা যায় ঘর মন জানালা উপন্যাসটি ১৯৯৬ সালে চীনা ভাষায়ও অনুবাদ হয়েছে। দিলারা হাশেম জন্মেছিলেন ২১ আগস্ট ১৯৩৬ সালে, যশোরে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে বি এ অনার্স। প্রতিভার বিচ্ছুরণ ঘটেছিল দিলারা হাশেমদের তিন বোনের মধ্যে। বাংলা কবিতার নতুন নির্মাতাদের একজন কবি সুরাইয়া খানম ছিলেন দিলারা হাশেমের বোন। অন্য বোন দিলশাদ খানম ছিলেন রেডিও টিভির খ্যাতিমান অভিনয় শিল্পী। দিলারা হাশেম তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের বেতারে ও টেলিভিশনে সংবাদ পাঠ শুরু করেন। ১৯৭২ সালে তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে চলে যান এবং নিজেকে ভয়েস অব আমেরিকার সঙ্গে যুক্ত করেন।

আমলকীর মৌ উপন্যাস প্রকাশিত হয় ১৯৭৮ সালে। বলা হয়, স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম নারীবাদী উপন্যাস আমলকীর মৌ। কেনো নারীবাদী উপন্যাস আমলকীর মৌ? উপন্যাসের নায়িকা বন্ধুর সঙ্গে ঝগড়া করে সন্ধ্যার পর ঢাকা ক্লাব থেকে বের হয়ে রিকশায় ওঠে। এবং সিগারেট ধরায়। আমলকীর মৌ শুরুই করেন এই ভাবে-আজ থেকে প্রায় পঁয়তাল্লিশ বছর আগে। তালিকানুসারে দিলারা হাশের উপন্যাসের প্রকাশ তালিকা-ঘর মন জানালা-১৯৬৫, একদা এবং অনন্ত-১৯৭৫, স্তব্ধতার কানে কানে-১৯৭৭, আমলকির মৌ-১৯৭৮, বাদামী বিকেলের গল্প-১৯৮৩, কাকতালীয়-১৯৮৫, মিউর‌্যাল-১৯৮৬, শঙ্খ করাত-১৯৯৫, অনুক্ত পদাবলী-১৯৯৮, সদর অন্দর-১৯৯৮, সেতু-২০০০, হামেলা-২০০১, চন্দ্রগ্রহণ ২০০২, এবং মুক্তিযুদ্ধের উপন্যাসসমূহ ২০১১।

গল্পের বই তিনটি যথাক্রমে-হলদে পাখির কান্না-১৯৭০, সিন্ধু পারের উপাখ্যান-১৯৮৮ এবং নায়ক ১৯৮৯ সালে প্রকাশিত। কবিতার বই-ফেরারি-১৯৭৭ সাল। অল্প সময়ের মধ্যে কথাশিল্পী দিলারা হাশেমের রচনালির এই নিদর্শন পাওয়া গেছে। হয়তো খুঁজলে আরও পাওয়া যাবে।

ঘর মন জানালা সময়ের প্রেক্ষিতে অনেক সাহসী উপন্যাস। নগর জীবনের আখ্যান তুলে ধরেছেন এ উপন্যাসে। উপন্যাসের নায়িকা নাজমা। অনেক কষ্ট করে নামজা প্রেবেশিকা পাশ করার পর একটা চাকরি শুরু করে। ভালোবাসে মালেককে। দুজনের মধ্যে চমৎকার বোঝাপাড়া। কিন্তু ছোট বোন আসমা প্রেমে প্রতারিত হয়ে অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়ে। নাজমা পড়ে অকূল পথে। কিন্ত নিজেকে উৎসর্গ করে ছোট বোন আসমাকে রক্ষা করতেও বদ্ধ পরিকর। প্রেমিক মালেককে প্ররোচিত করে ছোট বোন আসমাকে বিয়ে করার জন্য। প্রেমিকার প্রস্তাবে মালেক বিস্মিত। কিন্ত নাজমার তাগাদায় বাধ্য হয়ে আসমাকে বিয়ে করে বিদেশে চলে যায় মালেক। দিলারা হাশেম চমকের পর চমক সৃষ্টি করেন ঘর মন জানালা উপন্যাসে। আসমা এক সময়ে মারা যায়, উপন্যাসের শেষের দিকে। মালেকও সমাজে প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায় শ্রমে ও মেধায়। নাজমা কী করবে? ছোট বোনের জন্য নিজের আত্মত্যাগ শেষ পর্যন্ত বিন্দুতে পরিণত হয়।

কিন্তু দিলারা হাশেম কুশলী ও কৌশলী ঔপন্যাসিক। তিনি শেষ করেন আসমার মৃত্যুশয্যার পাশে মালেক ও নাজমার উপস্থিতির ইঙ্গিত ময়তার মধ্য দিয়ে। জীবনের ক্যানভাস শেষ হওয়ার পরও নতুন করে অঙ্কুর উদগমের সুযোগ রাখেন। প্রকৃতপক্ষে, জীবনের পাশেই তো জীবনের বিকাশ…

‘আমলকীর মৌ’ উপন্যাসে সামাজিক-পারিবারিক জীবনকে উপজীব্য করে তুলেছেন। যুদ্ধ শেষ হয়েছে বলে যারা নিশ্চিন্ত হয়ে বসলেন কেবল তাদের চোখে আঙুল দিয়ে দিলারা দেখিয়ে দিলেন একটা যুদ্ধের মীমাংসা হতে এখনো বাকি-যুদ্ধটা নারী স্বাধীনতার যুদ্ধ কিংবা আরও পরিষ্কার করে বললে, মানবতার মুক্তির যুদ্ধ। দেশ স্বাধীন হলো, নারী স্বাধীন হয়েছে কি? মুক্ত হতে পেরেছে কি সমাজের বোধ-বুদ্ধি? এমন সব প্রশ্ন নিয়েই যেন হাজির হলো ‘আমলকীর মৌ’। দিলারা হাশেম একটা নব্য স্বাধীন দেশের স্বাধীন কিছু বায়বীয় চরিত্র নিয়ে দেখিয়ে দিলেন, পুরুষকেন্দ্রিক সভ্যতাসৃষ্ট এথিকস, ভ্যালুস,-সর্বোপরি একটি আপাদমস্তক সমাজ ব্যবস্থা-তার হাতে যেমন নারীরা জিম্মি, জিম্মি তেমন পুরুষরাও। ‘আমলকীর মৌ’ চরমভাবে রাজনৈতিক একটি উপন্যাস। মোজাফ্ফর হোসেনের লেখা থেকে।

যৌনতা-মানুষের জীবনে সমগ্র সত্তা ও জীবন-জিজ্ঞাসার সঙ্গে নিবিড়ভাবে জড়িত এক জটিল অনুভূতি। ক্ষুধা, তৃষ্ণা, আনন্দ, ক্রোধের মতো যৌনতাও এক স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। তবুও আহার নিদ্রার মতো যৌনতা স্বাভাবিক হলেও সাধারণ নয়, অসাধারণ। স্থান, বিশেষ করে বাঙালি জীবন ব্যবস্থায় যৌনতা থাকে আড়ালেই। যতই আড়ালে থাকুক যৌনতার ডালিম, মানুষের অহর্নিশ চলে এ অনুভূতির দাপাদাপি। মানুষের মনের মতোই যৌনতা এক বিস্ময়ের আকর। কিন্তু অন্তর্লীন এ অনুভূতিকে বাংলা সাহিত্যে উপজীব্য করে, সাহিত্যের সোপানে গোপনের দ্বার উদঘাটন করা হয়েছে খুব কম। হয়তো সামাজিকতার পারিপার্শ্বিকতায় গল্পকার বা ঔপন্যাসিকেরা সাহস পাননি। কিন্তু দিলারা হাশেম সেই সাহসের নৌকায় মানব অনুভূতির করতলে দাঁড়িয়ে লিখেছেন হামেলা উপন্যাস। দেখিয়েছেন, মানব মনের বিচিত্র খেলার স্রোত ও বিপন্ন সময়ের আগুন খেলা।

প্রায় তিনশ পৃষ্ঠার তিন খণ্ডের বিশাল উপন্যাসের ক্যানভাসজুড়ে আছেন ছিষট্টি বছরের চরিত্র-দানেশ মীর্জা। দানেশ মীর্জা গ্রামীণ ধনবান গৃহস্থ। স্ত্রী ফজিলার সঙ্গে সংসার করেছেন ত্রিশ বছরের অধিক। পুত্র বাসেত বিদেশে পড়ালেখা করে চাকরি করছে। মেয়েদের বিয়ে দিয়েছেন। চারদিকে নাতি নাতনি-কিন্তু এক ঝড়ের বিকালে দানেশ মীর্জার গোটা মন করোটি পাল্টে গিয়ে, নতুন এক বাঁধভাঙা জোয়ারে ভেসে যেতে থাকেন।

হামেলা উপন্যাসের প্রথম পৃষ্ঠা থেকে-জানালাটা বন্ধ করতে গিয়ে থমকে দাঁড়ালেন দানেশ মীর্জা। হাত দুটি তার অনড়। উঠোনে ছোটাছুটি করছে করে শুকনো কাপড় তুলছে এক নারী। খোঁপা খুলে প্রায় গোড়ালি ছোঁয়া চুলের ঢল তাকে প্রায় ঢেকে দিয়েছে। চুলগুলো বাতাসের ঝাপটা খেয়ে দুলছে শত শত ফণা তোলা গোখরের মতো। দানেশ মীর্জা তাকিয়ে দেখলেন অন্ধকারের সঙ্গে লেপ্টে যাওয়া তার চুলের আড়াল থেকে বিদ্যুচ্চমকের সঙ্গে ফুটে উঠল দেহের আদল। দানেশ মীর্জার চোখ ঝলসে দিয়ে যেন আর একটা বিদ্যুৎ চমকাল। ক্ষণিকের জন্য চোখে পড়ল সেই রমণীর উদ্ধৃত শরীরের বাঁক। অজান্তার গুহাকন্দরের ফ্রেস্কো যেন কায়া ধরেছে রক্তমাংসে… মেয়েটি কাজের হামেলা।

পরের ঘটনা, অনেক ঘটনার জন্ম দিয়ে দানেশ মীর্জা বিয়ে করেন হামেলাকে। রাতে বাসরঘরে হামেলাকে নিয়ে হামলে পড়লেও, সকালে ত্রিশ বছরের স্ত্রী ফজিলা বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করেন। গোটা সংসারে রেগে যায় আগুন. জ্বলে উঠতে থাকে ধিকিধিকি। কেনো এই জ্বলে ওঠা?

কারণ, যৌবন, যৌনতা…যা মানব জীবনের চিরকালের অনিয়ন্ত্রিত রহস্যের সমুদ্র। সেই রহস্যের চাবিকাঠি খুঁজতে চেয়েছেন অসামান্য ঔপন্যাসিক দিলারা হাশেম।

বড় দুঃখ ও বেদনার প্রসঙ্গ-দিলারা হাশেমের জন্য এ লেখাটা লিখলাম, মৃত্যুর পর। বেঁচে থাকতে আমরা কেউ খুঁজিনি দিলারা হাশেমকে।

RELATED ARTICLES
- Advertisment -
Google search engine

Most Popular

Recent Comments