Thursday, March 28, 2024
spot_img
Homeসাহিত্যকঁচি ইচ্ছের বাগান

কঁচি ইচ্ছের বাগান

প্রকৃতি নাতিশীতোষ্ণ। অতি শীতলও নয়, অতি উষ্ণও নয়। যা বেশি গরম বা ঠাণ্ডা নয়, নাতিশীতোষ্ণ মণ্ডল। এই শহরের বাতাসে মিশে আছে দূষিত বায়ু। নদী-নালা আর লেকগুলো যেন ময়লার বাগার। কানে ভেসে শব্দ দূষণে মহাপ্রলয়। পত্রিকার পাতা খুললে দেখা মিলে খুন, ধর্ষণ, হত্যা আর বিভীষিকাময় ঘটনার মহড়া। পুরো শহরটা যেনো মানব চিড়িয়াখানা। মানুষের মুল্য নেই। দেহে মানব। মনে মানুষ হওয়ার কোন উপাদান নেই। যে যার মতো করে সাজিয়ে নিয়েছে এই শহর আঙিনা। 

তপু এ শহর গর্ভে সবুজের বিশালতার কোন চাপ অনুভব করেনি। সে শহীদ সাংবাদিক সেলিমা রহমান উচ্চ বিদ্যালয়ের ৬ষ্ঠ শ্রেণীর ছাত্রী। সে মায়ের কাছ থেকে গ্রামের অনেক গল্প শুনেছে । কিন্তু বাস্তবে তা কখনও দর্শন করেনি। অনেক সুযোগ থাকা সত্ত্বেও তাদের গ্রামের বাড়ীতে যাওয়া হয়নি কখনো। কারণ আশির দশকে তার বড় বোনের জন্মের পর পারিবারিক বিবাদের জন্য যে চলে এসেছে ঢাকায়। তারপর থেকে আর গ্রামে যাওয়া হয়নি। তার বাবার অক্লান্ত পরিশ্রমের মাধ্যমে ঢাকা শহরে স্থায়ী আবাস করে নিয়েছে। তবুও ফেলে আসা গ্রামের মানুষের প্রতি তার অসীম ভালবাসা। এ শহরে এসে অনেকে বিপদে পড়ে। কিন্তু তিনি তাদের সাহায্য করতে পিছু হটেননি। তবে অভিমানে-দুঃখে গ্রামে ক্ষণিকের জন্য ফিরে যেতে ইচ্ছে হয়নি। 

তপুর বড়বোন শ্যামলি ঢাকা কলেজের অনার্স ২য় বর্ষের ছাত্রী। তার সাথে গ্রামের বাড়ির ফারহানা লেখা-পড়া করছে। কিন্তু হোস্টেলে থেকে লেখা-পড়া খুবই কষ্ট কর। তাই শ্যামলি বন্ধুত্বের এক পর্যায় বাবা-মাকে রাজি করিয়ে বাসায় নিয়ে আসে। ফারহানা তাদের পরিবারে আগমনে তপুর বাবা-মার চিন্তা-চেতনা পরিবর্তন হতে শুরু করে। ধীরে ধীরে আত্মীয় স্বজনের সাথে সম্পর্ক শীতল হয়। স্কুল-কলেজে গুলো স্বাধীনতা দিবসের জন্য বন্ধ ঘোষনা করা হয়েছে। এই ছুটিতে ছাত্র-ছাত্রীরা যার যার মত করে পারিবারিক আনন্দে মেতে উঠে। 

ফারহানা গ্রামে চলে যাওয়ার প্রহর গুনছে। তপু বায়না ধরেছে সেও গ্রামে যাবে। বাবা-মাকে তার ইচ্ছার কথা জানিয়েছে। কিন্তু দুজন-ই কিছু বলছেন না। এদিকে শ্যামলি গ্রামে ছুটি কাটানোর কথা বাবা-মাকে বলার সাহস পাচ্ছে না। তাদেরও গ্রামে বেড়ানোর ইচ্ছা আছে। তবুও দুঃখে যেতে ইচ্ছে করছেন না। সেই চিন্তাময় মুহুর্তে ঘরে ফারহানা এসেছে। সে প্রবেশ করে বললো- চাচা আগামীকাল বাড়ী চলে যাবো। তিনি বললেন-ঠিক আছে মা, যাও। তাড়াতাড়ি ফিরে এসো। কিন্তু চাচা! মাগো থামলে কেন? তোমার কোন অসুবিধা। তা নয়, তবে শ্যামলি ও তপুকে সঙ্গে করে নিয়ে যেতে চাইছি।

মা-মণি কিন্তু…। না, চাচা কিন্তু বলবেন না। আমার বাড়ি ছাড়া আর অন্য কোন বাড়িতে যেতে দেবো না। আচ্ছা ঠিক আছে নিয়ে যাও, তবে দুদিনের বেশি থাকা চলবেনা। ঠিক আছে। ফারহানা রুম থেকে চলে এসে পাশের কক্ষে অপেক্ষমান দুজনকে রাজি হওয়ার সংবাদ দেয়া মাত্র তপু হৈ-চৈ আরম্ভ করে দিয়েছে। তার খুশিতে যেন আকাশের প্রতিটি তাঁরা মাটিতে খসে পড়ছে।

পরদিন ৬টা ৪০ মিনিটে সিলেটের উদ্দেশ্যে কমলাপুর রেলস্টেশন থেকে পারাবত ট্রেনটি যাত্রা করবে। ইতোমধ্যে টিকেট বুকিং দেয়া হয়েছে। পবিত্র ফজরের নামাজ আদায় করা হয়েছে। ভোর পাঁচটা বাজে, তিন জনই গ্রামে ফিরে যাওয়ার উদ্দেশ্যে তৈরি হয়ে গেছে। শ্যামলির বাবা এসেছেন কমলাপুর রেলস্ট্শনে গাড়িতে নিরাপদে তুলে দেওয়ার জন্য।

নির্দিষ্ট সমেয় ট্রেনটি ছেড়ে দিলো। তপু জানালার পাশে বসে আছে। বাহিরের দৃর্শ্য গুলো অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখছে। কিন্তু রেললাইনের পাশে দরিদ্র লোকের আবাসস্থল দেখে বুবুকে নানা প্রশ্ন করছে।

বিমানবন্দর রেলস্টেশন থেকে মাহিন ট্রেনে উঠেছে। একটি কামরার মাঝে চারটি আসনের মধ্যে একটি তার সীট পড়েছে। সে অবশিষ্ট সীটে তুপরা বসে থাকতে দেখে তল্পি-তল্পা নির্দিষ্ট স্থানে রেখে অন্য কামরায় চলে যায়। ক্যান্টিনে সকালের হালকা নাস্তা খেয়ে সীটে ঘুমাচ্ছে। কয়েকঘন্টা পর আখাউড়া রেলষ্টেশন ট্রেন অতিক্রম করে। তখন এক লোক তাকে জাগিয়ে তুললো। স্যারি ভাই-বিরক্ত করার জন্য,সিটটা আমার। নো, থ্যাঙ্কস্, আপনি বসুন। অন্য কামরায় সিট আছে আমার। 

মাহিন চল আসলো তার নির্দিষ্ট সিটে। তখন এসে দেখলো তার সিটে তপুরা দখল করে বসে আছে। শ্যামলি তাকে দেখতেই সিটটা ছেড়ে দিয়ে বসুন বলে পাশের বসে পড়লো। তপু, ফারহানার কোলে মাথা রেখে শুয়ে আছে।

মাহিন সংকোচবোধ নিয়ে সিটে বসলো। সে ব্যাগ থেকে মোস্তফা সেলিম সম্পাদিত ‘মুক্তিযুদ্ধে বড়লেখা‘ ইতিহাস গ্রন্থটি বের করে পড়ছে। ফারহানা সামনের সিট থেকে মাহিনকে লক্ষ করে বললো-আপনার সাথে পরিচিত হতে পারি কি? জ্বি, আমাকে বলছেন, হ্যাঁ, আপনাকে বলছি। অবশ্যই, আমার নাম মাহিন রহমান আর ব্রাক বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংবাদিকতায় অধ্যায়ন করছি। আপনি কি করছেন?

আমি ফারহানা, ঢাকা কলেজে আমরা দুজনই অনার্সে পড়ছি। মাহিন ভাই আপনার হাতের বইটা কোথায় পেয়েছেন? কেন? না,এই লেখকের বাড়ি আমাদের এলাকায়। এজন্য প্রশ্ন করছি। 

ও, তাই। আমি গত বছর তিন বন্ধু মাধবকুন্ডে বেড়াতে গিয়েছিলাম আর তখন সেই এলাকার শহরের বঙ্গবীর লাইব্রেরী থেকে স্থানীয় লেখকদের নানা বই সংগ্রহ করেছি। এলাকার ইতিহাস ও ঐতিহ্য সমৃদ্ধ প্রকাশিত বইয়ের মধ্যে এটা এনেছি। তখন তপুর ঘুম ভেঙ্গে গেলো। সে জেগে উঠেই বলে-ভাইয়া বইগুলো আমি কিভাবে সংগ্রহ করতে পারি? মাহিন বইগুলো সংগ্রহ করার তথ্য দিয়ে দিলো। এতোক্ষণ পাশে বসা শ্যামলি চুপ করে বসেছিল। এই মাত্র কথা বললো, কিন্তু আপনার ব্যাপারে সবজানা হল,তবে বাড়িটা জানা হলো না। মাহিন প্রশ্ন করলো, আপনি কথা বলছেন? কেন ? অবাক হলেন। না সংশয়ে ছিলাম। আর বাড়িটা প্রকৃতির লীলা নিকেতন শ্রীমঙ্গলে। কিন্তু আপনার নামটা জানা হলো না । কেন-এতো কি জানা প্রয়োজন? যতোটা ভাবছেন ততোটা নয়। যাক, নামটা শ্যামলি আর বাড়িটা সিলেটে হলেও এই প্রথম এখানে আগমন। তবে স্থায়ীভাবে ঢাকায় বসবাস করছি। তপু জানালা দিয়ে পাহাড়ি দর্শনের সময় বার বার প্রশ্ন করছে।

শ্যামলি অনেক গুলো প্রশ্নের উত্তর সম্পর্কে ধারণা নেই। মাহিনের সাহায্য চাইলো। মাহিন তাকে পাশে বসিয়ে বিভিন্ন স্থান সম্পর্কে ধারণা দিয়ে চলছে। তখন মাহিনের ফোন বেজে উঠলো। সে ফোনটা রিসিভ করতেই দুঃসংবাদ। মাহিন তুই কোথায়? আমি-তো ট্রেনে আসছি। তুই ট্রেন থেকে থানায় আসিস। কেনো কি হয়েছে? আর বলিস নারে, কি বলবো? তোর বাবার লাশ পাওয়া গেছে। চাচাকে সন্ত্রাসীরা হত্যা করেছে। মাহিন, চাচা আর বেঁচে নেই। কি বলিস? হ্যাঁ, সত্যিই বলছি।
 
মাহিনের চোখ দিয়ে অবিরাম ধারায় জল ঝরছে। এতো সুন্দর হাঁসিমাখা মুখটা লাল হয়ে গেল। সে সেখান থেকে অন্যত্র চল গেলো। তপু তার কান্না দেখে নীরব দর্শক হয়ে গেল। শ্যামলি তার অবস্থা দেখে প্রশ্ন করার ইচ্ছা তাকলেও আর করেনি। মাহিন, ক্যান্টিনে ফিরে গিয়ে আনমনা ভাবে পানি দিয়ে মুখটা ধুয়ে এক কাপ রং চা পান করলো। অল্প কিছুক্ষণের মধ্যে ট্রেনটি শ্রীমঙ্গল স্টেশনে পৌছবে বলে মাইকে ঘোষণা করা হলো। মাহিন চলে আসলো সিটে। ব্যাগগুলো গুছিয়ে নিলো। বিদায় ক্ষণে,তপুকে সাংবাদিক সৈয়দ ফারুক আহমদ রচিত “মানবতায় সাংবাদিক’’বইটি উপহার হিসেবে দিয়ে বললো এই বইটির লেখক আমার বাবা। শ্যামলি আনমনা হয়ে গেল। কৌতুহল রয়ে গেল । জানা হলো না অশ্র সিক্ত নয়নের অদৃশ্য রচনা। মাহিন উভয়ের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে গন্তব্যে চলে গেল। ফারহানা বুঝতে পারলো শ্যামলি অন্তরের আবেদন। তবুও অবুঝের মতো পাশ কাটিয়ে গেল। 

শ্যামলিরা কুলাউড়া রেলস্টেশনে নেমে একটি সিএনজি ভাড়া করে বড়লেখার লঘাটি গ্রামে নিজ বাড়িতে পৌঁছলো। পরদিন তপু গ্রামে ঘুরতে বেরিয়েছে। শত শত বছরের পুরাতন খোঁজার মসজিদটি তাকে মুগ্ধ করেছে এবং এর পাশে বাগান গুলো সৌন্দর্য্য আরো আকর্ষণ করেছে। তপু তার বুবুকে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নামকরণ নিয়ে প্রশ্ন করলো। এই রাস্তা, সেই রাস্তা কেন শহীদরে নামে নামকরণে করা হলো না। কেন ? এরা কি এটার সমতুল্য? কোন প্রতিষ্ঠানের নামে অন্তর্ভুক্ত হলো না ইত্যাদি- ইত্যাদি। 

তপুরা নির্দিষ্ট সময় ব্যয় করে আনন্দ উপভোগ করে ফিরে আসলো। সে ঢাকায় ফিরে তার আম্মুকে জানালো একটা ফুলের বাগান করবে। আর এ বাগানের নাম একজন শহীদ মুক্তিযোদ্ধার নামে নামকরণ করা হবে। তবে এ বাগান অন্য দিয়ে নয়, সে নিজের হাতে করবে। তার আম্মু বলেছেন-বাবা তুমি এখনো ছোট, তুমি কিভাবে বাগান করবে? আরেকটু বড় হও, তখন না হয় করো। তপু রবীঠাকুরের ছুটি গল্পের নায়কের মত বেপরোয়া। সে বাগান করবেই। কি আর করা। তপুর আম্মু বাসার ছোট্ট একটা জায়গা নির্ধারণ করে দিলেন বাগান করার জন্য। তারপর তপু তার আব্বুসহ বুবুদের সহযোগিতায় ছোট্ট জায়গাটিকে গাছ রোপণের উপযোগি করলো। এরপর বিভিন্ন জাতের পাঁচটি ফুলের চারা লাগালো ও সে আব্বুর সহযোগিতায় আরো গাছ লাগালো। সেই থেকে প্রতিদিন সকালে ও বিকালে তপু বাগানে পানি দেয় এবং সপ্তাহে একবার গাছের আগাছা পরিষ্কার করে। কয়েক মাস পর দেখা গেলো প্রায় প্রতিটি গাছে দু-তিনটা করে ফুল ফুটেছে। তপু এখন মহাখুশি।

মুহাম্মদ বিন কাশেম সিন্ধু জয় করে যতটুকু কৃতিত্ব অর্জন করেছিলেন ও বখতিয়ার খলজি বঙ্গ বিজয় করে যতটুকু সাফল্যের হাসি হেসে ছিলেন । তেমনি তপুর বাগানে ফুল ফোটায় সে তাদের চেয়ে বেশি খুশি হয়েছে। তপুর বাবা-মাও খুব খুশি তার সাফল্য দেখে।

RELATED ARTICLES
- Advertisment -
Google search engine

Most Popular

Recent Comments