বৈশ্বিকভাবে নানা আন্তর্জাতিক সংস্থা প্রাচীন ঐতিহ্যগুলোর ডিজিটাল সংরক্ষণের উদ্যোগ নিয়েছে। এর মধ্যে জাতিসংঘের সংস্কৃতিবিষয়ক সংস্থার ‘ডিজিটাল প্রিজারভেশন অব কালচারাল হেরিটেজ’ অন্যতম। আমাদের দেশে ঐতিহ্যবাহী স্থাপনাগুলোর সংরক্ষণ এবং সেগুলো জনমানুষের, বিশেষ করে ছোট শিশুদের কাছে পৌঁছে দেওয়ার মতো কাজ করছেন স্থপতি দম্পতি ইমামুর হোসেন ও ফারিবা সামিয়া অমি। এই কাজে তাঁরা ব্যবহার করছেন হালের ক্রেজ অগমেন্টেড রিয়ালিটি (এআর) প্রযুক্তি।
পেছনের গল্প
ইমামুর হোসেন বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) থেকে স্থাপত্য বিষয়ে পড়াশোনা করেছেন এবং কর্মজীবনে তিনি একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে একই বিষয়ে শিক্ষকতা করছেন। গবেষণার ক্ষেত্রে তাঁর আগ্রহের জায়গা হলো ঐতিহ্যবাহী স্থাপনা ও সেগুলোর সংরক্ষণ। এ বিষয়ে তিনি ব্রিটেনের লেস্টার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চতর পড়াশোনাও শুরু করেছেন। একাডেমিক পড়াশোনা, গবেষণার বিষয়বস্তু ও ব্যক্তিগত আগ্রহের জায়গা থেকে তিনি ডিজিটাল মাধ্যমে ঐতিহ্য সংরক্ষণের কাজে অগ্রসর হন।
ঐতিহ্য সংরক্ষণে অগমেন্টেড রিয়ালিটি যেভাবে ব্যবহৃত হয়
যেকোনো স্থাপনার ডিজিটাল সংরক্ষণের ক্ষেত্রে বেশ কিছু জটিল ধাপের মধ্য দিয়ে যেতে হয়। প্রথমে ড্রোনের মাধ্যমে স্থাপনাটির অনেক ছবি ও ভিডিও চিত্র ধারণ করা হয় বিভিন্ন অ্যাংগেল থেকে। ফটোগ্রামেট্রির মাধ্যমে স্ক্যান করা বিল্ডিংগুলোর ওয়্যারফ্রেম ডিটেইলস, ফরম এবং সেগুলোর টেক্সচার আরো পরিশীলিত করার জন্য ব্লেন্ডার, সিনেমা ফোরডির মতো সফটওয়্যারগুলো ব্যবহার করে থাকেন তাঁরা। তাঁদের তৈরি করা এই মডেলগুলো ভার্চুয়াল ও ফিজিক্যাল—এই দুই স্পেসের সঙ্গে সমন্বয় করে এতটাই নিখুঁত হাইপার-রিয়াল স্পেস তৈরি করে যে চাইলে এটা পড়ার টেবিলে রাখতে পারবে শিক্ষার্থীরা।
আমার ঐতিহ্য
২০২২ সালে তাঁরা ইএমকে সেন্টার থেকে ‘আমার ঐতিহ্য’ নামে এক প্রজেক্টের জন্য ফান্ড পেয়েছেন। এই প্রজেক্টের উদ্দেশ্য বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী স্থানগুলো ডকুমেন্ট করে সেগুলো একটি অ্যানড্রয়েড অ্যাপ্লিকেশনের মাধ্যমে সবার কাছে ছড়িয়ে দেওয়া। এই অ্যাপ্লিকেশনটির ডেভেলপমেন্ট কাজ এখন প্রায় শেষের দিকে এবং সেপ্টেম্বরে এই প্রজেক্ট চালু করা হবে। তাঁরা আশা করছেন, এ ধরনের হাইপার-রিয়ালিস্টিক মাধ্যম প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের একটি আউটকাম বেইসড শিক্ষা কার্যক্রম হিসেবে সমৃদ্ধিশালী ইতিহাস, ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতি সম্পর্কে শুধু একটি ধারণাই দেবে না, বরং তাদের ভবিষ্যতে ঐতিহ্য কিভাবে সংরক্ষণ করা যায় সে সম্পর্কে উৎসাহিত করবে আর দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করবে। পুরো প্রকল্পটিতে প্রজেক্ট লিড হিসেবে কাজ করছেন ইমামুর হোসেন। অন্যদের মধ্যে আছেন স্থপতি ফারিবা সামিয়া অমি, তাশদীদ হোসেন (প্রগ্রামার) ও আতিকুল ইসলাম (অ্যাপ ডেভেলপার)।

মোবাইল অ্যাপটি যেভাবে কাজ করবে
বাংলাদেশের প্রচলিত কাগুজে টাকার নোটগুলোতে বেশ কিছু ঐতিহ্যবাহী স্থাপনার ছবি রয়েছে। অ্যাপটি চালু করে এমন কোনো নোটের সামনে ধরলে ওই নোটে থাকা স্থাপনাটির বিস্তারিত দেখা যাবে। তাঁরা এমনভাবে এটিকে ডিজাইন করেছেন, যাতে যেকোনো অবস্থায় থাকা নোট স্ক্যান করে কাঙ্ক্ষিত ফল পাওয়া যায়।
এরই মধ্যে তাঁরা বেশ কিছু স্থাপনাকে নিজেদের ডাটাবেইসে যুক্ত করেছেন। এসবের মধ্যে আছে—ঐতিহ্যবাহী হাজী খাজা শাহবাজ মসজিদ, মুসা খানের মসজিদ, তারা মসজিদ, ষাট গম্বুজ, সাত গমু্বজ মসজিদ, ঢাকা গেট, পরি বিবির মাজার, লালবাগ কেল্লার হাম্মাম, কুসুম্বা মসজিদ, খান মোহাম্মদ মির্ধা মসজিদ, তিন নেতার মাজার ও ধানমণ্ডি শাহী ঈদগাহ। স্থাপনাগুলো অগমেন্টেড রিয়ালিটিতে নিয়ে আসতে প্রথমে তাঁরা স্থাপনার অনেক ছবি ও ভিডিও নেন ড্রোন ব্যবহার করে। এ ছাড়া ম্যানুয়াল ড্রয়িং পদ্ধতিতেও কিছু কাজ করা হয়। ঐতিহাসিক স্থাপনাগুলো যেহেতু প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের অধীন, তাই সেগুলো থেকে তথ্য সংগ্রহের ক্ষেত্রে অধিদপ্তর থেকে প্রয়োজনীয় সহায়তা পাচ্ছেন বলে জানিয়েছেন প্রকল্পটির প্রধান ইমামুর হোসেন। প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহের পর সেগুলোকে সমন্বয় করে অ্যাপে অগমেন্টেড রিয়ালিটি হিসেবে প্রদর্শন উপযোগী করে তৈরি করা হয়। সর্বশেষ ধাপের কাজটি তাঁদের টিমের অ্যাপ ডেভেলপার ও প্রগ্রামাররা করেন।
হবে শিক্ষা ও গবেষণায় সহায়ক
তাঁরা প্রাথমিক পর্যায়ের বইগুলোতে থাকা ঐতিহ্যবাহী স্থাপনাগুলোও যুক্ত করবেন অ্যাপে। এর ফলে শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার ক্ষেত্রে তা নতুন মাত্রা যুক্ত করবে। ঐতিহ্য সংরক্ষণের এই প্রচেষ্টা একদিকে যেমন শিক্ষার্থীদের জ্ঞানের ক্ষেত্রে সহায়ক হবে, ঠিক তেমনি যাঁরা ঐতিহ্য নিয়ে গবেষণা করেন, তাঁদের ক্ষেত্রেও উপকারী হবে।
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা
ইএমকে সেন্টারের অর্থায়নে শুরু হওয়া অলাভজনক এই প্রকল্প বর্তমানে একেবারে শুরুর পর্যায়ে আছে। এটিকে নিয়ে বড় স্বপ্ন প্রকল্প-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের। তাঁরা দেশের আনাচকানাচে ছড়িয়ে থাকা সব ঐতিহ্য তাঁদের প্ল্যাটফরমে নিয়ে আসতে চান আর সেগুলো শিক্ষার্থীদের মাঝে ছড়িয়ে দিতে চান। এ জন্য সরকারি-বেসরকারি পর্যায় থেকে সহায়তা আশা করেন তাঁরা।
প্রয়োজন সমন্বয় সাধনের
সরকারের পক্ষ থেকে এসব প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের অনুসন্ধান, খনন, সংস্কার, সংরক্ষণ, প্রদর্শন এবং গবেষণার মাধ্যমে ইতিহাস পুনরুদ্ধারের কাজে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর নিয়োজিত রয়েছে। বর্তমানে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের আওতায় ৫১৭টি সংরক্ষিত পুরাকীর্তি রয়েছে। তন্মধ্যে মহাস্থানগড়, ময়নামতি, শালবন বিহার, পাহাড়পুর বৌদ্ধ বিহার, সীতাকোট বিহার, কান্তজীর মন্দির, ছোট সোনা মসজিদ, ষাট গম্বুজ মসজিদ, ভাসুবিহার, বারোবাজার, লালবাগ দুর্গ প্রভৃতি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পুরাকীর্তি ও প্রত্নস্থল।
সরকারের পক্ষ থেকে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরই যেহেতু দেশীয় ঐতিহ্যের দেখভাল করে, তাই সেগুলোর ডিজিটাল সংরক্ষণের এই উদ্যোগকে বৃহৎ পরিসরে নিয়ে যেতে এবং তা সবার মাঝে ছড়িয়ে দিতে অধিদপ্তরের সহায়তা আশা করেন ইমামুর রহমান। তিনি বলেন, ‘আমরা দেশীয় ঐতিহ্যের সংরক্ষণে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের সঙ্গে কাজ করতে আগ্রহী। ’