র্যাবে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট থাকাকালে দেশব্যাপী একের পর এক সাহসী অভিযান চালিয়ে আলোচনায় আসা মো. সারওয়ার আলমকে এবার ‘তিরস্কার’সূচক লঘুদণ্ড দিয়েছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। এর আগে তিনি পদোন্নতিবঞ্চিত হয়েছিলেন।
আলোচিত এই কর্মকর্তা বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারের ২৭তম ব্যাচে যোগদান করেন। গত বছরের ৮ মার্চ সারওয়ার তার ফেসবুকে ‘পদে পদে বঞ্চিত ও নিগৃহীত হওয়া’ নিয়ে একটি স্ট্যাটাস দেন। একে ‘অকর্মকর্তাসুলভ’ আচরণ এবং সরকার ও কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে ইঙ্গিতপূর্ণ মন্তব্য ধরে নিয়ে তাকে লঘুদণ্ড দিয়েছে জনপ্রশাসন। গত ২১ এপ্রিল জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব কেএম আলী আজম স্বাক্ষরিত প্রজ্ঞাপনে সারওয়ারকে শাস্তি দেওয়ার বিষয়টি জানানো হয়। তিনি বর্তমানে সিনিয়র সহকারী সচিব পদে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ে কর্মরত।
শাস্তির প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, “মো. সারওয়ার আলম ২০২১ সালের ৮ মার্চ বেলা ১২টা ১০ মিনিটে তার ফেসবুক আইডিতে ‘চাকুরীজীবনে যেসব কর্মকর্তা-কর্মচারী অন্যায়, অনিয়মের বিরুদ্ধে লড়েছেন তাদের বেশিরভাগই চাকুরীজীবনে পদে পদে বঞ্চিত ও নিগৃহীত হয়েছেন এবং এদেশে অন্যায়ের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়াটাই অন্যায়’ বলে মন্তব্য করেন। একজন সরকারি কর্মচারী হয়ে সরকার ও কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে এ ধরনের ইঙ্গিতপূর্ণ মন্তব্য করার মাধ্যমে ‘অকর্মকর্তাসুলভ’ আচরণ করেছেন। এতে জনপ্রশাসনের ভাবমূর্তি ক্ষুণœ হওয়ায় সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা, ২০১৮ এর ৩ (খ) বিধি অনুযায়ী ‘অসদাচরণ’-এর অভিযোগে তার বিরুদ্ধে ০১৫/২০২১ নম্বর বিভাগীয় মামলা রুজু করে গত বছরের ৩০ জুন অভিযোগনামা ও অভিযোগ বিবরণী প্রেরণ করে কৈফিয়ত তলব করা হয়। যেহেতু, অভিযুক্ত কর্মকর্তা নির্ধারিত বা বর্ধিত সময়ের মধ্যে আত্মপক্ষ সমর্থনে কোনো লিখিত বক্তব্য দাখিল করেননি এবং অভিযোগের বিষয়ে তদন্তের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে মর্মে প্রতীয়মান হওয়ায় তদন্ত কর্মকর্তা নিয়োগ করা হয়। তদন্ত কর্মকর্তা প্রতিবেদন দাখিল করলে তা পর্যালোচনায় মো. সারওয়ার আলমের বিরুদ্ধে ‘অকর্মকর্তাসুলভ’ আচরণ এবং জনপ্রশাসনের ভাবমূর্তি ক্ষুণেœর অভিযোগ প্রমাণ হয়েছে। এজন্য তাকে তিরস্কারসূচক লঘুদ- দেওয়া হয়েছে” বলে জনপ্রশাসনের প্রজ্ঞাপনে উল্লেখ করা হয়েছে।
কর্মকর্তারা জানান, গত বছরের ৭ মার্চ বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারের ২৭তম ব্যাচের কর্মকর্তাদের সিনিয়র সহকারী সচিব থেকে পদোন্নতি দিয়ে উপসচিব করে সরকার। পদোন্নতির ক্ষেত্রে মূল বিবেচ্য ছিল বিসিএসের ২৭তম ব্যাচ। এ ব্যাচের প্রশাসন ক্যাডারের ২৪০ জনকে (ইকোনমিক ক্যাডার বিলুপ্ত হওয়ায় প্রশাসন ক্যাডারে অন্তর্ভুক্ত হওয়া কর্মকর্তাসহ) পদোন্নতি দেওয়া হয়; কিন্তু তিন শতাধিক সফল অভিযান পরিচালনাকারী র্যাবের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মো. সারওয়ার আলমকে পদোন্নতি দেয়নি সরকার। এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপক সমালোচনা হয়। পরদিন ৮ মার্চ সারওয়ার তার ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাস দেন। ওই স্ট্যাটাসকে অসদাচরণ হিসেবে আমলে নিয়ে তাকে শাস্তি দিয়েছে জনপ্রশাসন।
২০০৮ সালের নভেম্বরে চাকরিতে যোগ দেন সারওয়ার। ২০১৪ সালের ১ জুন পদোন্নতি পেয়ে সিনিয়র সহকারী সচিব হন তিনি। উপসচিব পদে পদোন্নতির শর্ত পূরণ হয়েছে তার। এ ছাড়া তার বিরুদ্ধে কোনো বিভাগীয় অভিযোগও ছিল না। তার পরও সারওয়ারের পদোন্নতি না হওয়ায় ওই সময় অনেকে হতাশা প্রকাশ করেন।
পদোন্নতি প্রসঙ্গে সারওয়ার আলম গণমাধ্যমকে বলেছিলেন, ‘আমি সবসময় জনগণের জন্য কাজ করেছি। যেসব জায়গায় জনগণ প্রতারিত হচ্ছিল, সেগুলো ধরে ধরে কাজ করে মানুষের মনে স্থান করতে পেরেছি। সততা, কর্মদক্ষতা কোনো দিক দিয়েই পিছিয়ে ছিলাম না। আমার প্রমোশন হয়নি- এটা কেউই বিশ্বাস করতে পারছেন না।’
কর্মকর্তারা জানান, র্যাব থেকে সরিয়ে ২০২০ সালের ৯ অক্টোবর সারওয়ার আলমকে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ে বদলি করা হয়। তিনি ২০১৫ সাল থেকে র্যাবের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। খাদ্যপণ্যে ভেজালবিরোধী আন্দোলন ও দুর্নীতিবিরোধী বিশেষ অভিযানের সময় ব্যাপক সাহসী ভূমিকা রেখে আলোচিত হন এই কর্মকর্তা। যুবলীগ নেতা ইসমাঈল হোসেন সম্রাট, ঠিকাদার ও যুবলীগ নেতা জিকে শামীমসহ বেশ কয়েক প্রভাবশালীর বাসা ও অফিসে অভিযান চালান তিনি। তিন শতাধিক ‘সফল’ অভিযান পরিচালনাকারী সারওয়ারের আলোচিত অভিযান ছিল ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে ফকিরাপুলে ক্যাসিনোতে অভিযান। ফকিরাপুলের ইয়ংমেনস ক্লাব, ওয়ান্ডারার্স ক্লাব, মুক্তিযোদ্ধা সংসদে অভিযান চালান। এ সময় ১৪২ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেন সারওয়ার।
এদিকে, পদোন্নতিবঞ্চিত হওয়ার পর নতুন করে তিরস্কারসূচক লঘুদণ্ড দেওয়ায় সারওয়ারের মতো অন্য সাহসী কর্মকর্তারা ভবিষ্যতে নিষ্ঠা ও সততার সঙ্গে কাজের ক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়বেন বলে মনে করেন প্রশাসন বিশেষজ্ঞরা। সারওয়ার আলমের শাস্তি নিয়ে প্রকাশ্যে বক্তব্য দিতে চাননি কোনো কর্মকর্তা।